X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের এখন কী হবে?

আনিস আলমগীর
২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:১০আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:১৫

 

আনিস আলমগীর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া নিয়ে চুক্তি করতে না করতেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। চুক্তিটি কার স্বার্থে গেলো, বাংলাদেশ কী পেলো আর রোহিঙ্গাদের জন্য সেটা কতটা সুফল বয়ে আনবে, নাকি আন্তর্জাতিক মহলে মিয়ানমারকে ফেস সেভিংয়ের সুযোগ করে দেওয়া বাংলাদেশ-মিয়ানমারের বন্ধুদের তৎপরতার ফল এই চুক্তি—সেটাই বিতর্কের বিষয়।
গত ২৩ নভেম্বর নেপিদোয় বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এই চুক্তি হয়েছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার গত ৯ অক্টোবর ২০১৬ ও ২৫ আগস্ট ২০১৭-এর পরে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী বাস্তুচ্যুত রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের ফেরত নেবে। এই চুক্তির অধীনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পর ৯ অক্টোবর ২০১৬-এর আগে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী বাস্তুচ্যুত রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ লক্ষ্যে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে ও টার্মস অব রেফারেন্স চূড়ান্ত করা হবে। মাঠপর্যায়ে প্রত্যাবাসন বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত Physical Arrangement for Repatriation স্বাক্ষরিত হবে। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ এই চুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করবে।
চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কোনও সময়সীমা রাখা হয়নি। রোহিঙ্গাদের সেখানে নিরাপদে অবস্থানের গ্যারন্টি কোথাও নেই। নাগরিকত্বের বিষয়টিও উপেক্ষিত। এই প্রেক্ষাপটে এই চুক্তিও কতটা কেউ মনে করছেন খুব কার্যকর হবে প্রশ্ন দেখে যাচ্ছে।
চুক্তি করতে গিয়ে বাংলাদেশ তাড়াহুড়ো করলো কিনা, সেটাও ভাবার বিষয়। শুনছি আমাদের সরকারের দিক থেকে চুক্তি করার জন্য তাড়াহুড়ো থাকলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলারা বিষয়টি নিয়ে তেমন খুশি নন। যারা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে, তাদের হাতেই এই রোহিঙ্গাদের তুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে চুক্তিতে। শক্তপোক্ত কথাবার্তা না হলে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জীবনের নিরাপত্তা বলে কিছুই থাকবে না। আবারও বাংলাদেশে আসা অব্যাহত রাখবে তারা।

চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও রোহিঙ্গাদের সেখানে নিরাপত্তার এই দিকটি বেশি আলোচিত হচ্ছে। হবেই না কেন! ২৩ নভেম্বর, যে দিন চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, সেদিনও উখিয়ায় ৫০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে।

মাত্র ক’দিন আগে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বসনিয়ার সার্ব বাহিনীর সাবেক সামরিক কমান্ডার রাতকো ম্লাদিচকে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছে। ওই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। সার্বরাও বলেছিল, কসভোর মুসলমানরা আলবেনিয়া থেকে বসনিয়ায় এসেছে। সুতরাং তাদের আলবেনিয়ায় চলে যেতে হবে। মুসলমানদের ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়েছিল সার্বরা। কসোভোর হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছিল তারা। রাতকো ম্লাদিচ কারও কথা শোনেননি। ১৯৯৯ সালে বাধ্য হয়ে আমেরিকা ৯০ দিন সার্বদের ওপর বোমা বর্ষণ করেছিল। এটি ছিল সার্বদের উপযুক্ত পাওনা। তারপর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হয়।

কসভোর মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ  নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করেছিল। এখানে দুর্ভাগ্য যে, বিশ্ববিবেক সোচ্চার হওয়ার পরও রোহিঙ্গাদের যারা নির্বিচারে হত্যা করলো, সেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অধরা রয়ে গেলো। চীন আর ভারতের কারণে তাদের বিচার করা গেলো না।

সার্বের সেনা নায়কদের বিচারের ব্যাপারে যেভাবে বিশ্ব সোচ্চার হয়েছিল, সেভাবে ঠিক মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ব্যাপারেও সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু চীন, রাশিয়া ও ভারত হস্তক্ষেপ না করলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীরও বিচার হতো। এখন উল্টো রোহিঙ্গাকে রাখাইনে পাঠাতে হলে মিয়ানমারের শর্ত মেনে পাঠাতে হবে। অথচ তথ্য-উপাত্ত-স্যাটেলাইটে ধারণ করা ছবি থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জাতিগত নিধন চালিয়েছিল।

জাতিসংঘের সিনিয়র কর্মকর্তারা 'জাতিগত নিধন' শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন বার বার। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনও একই শব্দ ব্যবহার করেছেন।  মিয়ানমার রোহিঙ্গা নিতে বলছে, এটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এই পর্যন্ত আমরা যত খবর পেয়েছি ও সদ্য আগত রোহিঙ্গাদের সরবরাহ করা তথ্য থেকে যা জেনেছি, তাতে যে সব রোহিঙ্গা রাখাইনে এখনও রয়েছে, তাদের সঙ্গে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ভিনগ্রহের মানুষের মতো আচরণ করছে। তারা এখনও নিয়মতান্ত্রিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। রাখাইনের স্থানীয় মগেরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্বাভাবিক কথা বলে কিলঘুষি মেরে। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটা কথা বলেছেন যে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছুক, এ কথা বিশ্বাস করা অর্থহীন।

গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে তখন থেকে চীন এ বিষয়টা নিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ফোরামে তৎপরতা চালাতে নিষেধ করেছিল। চীনের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের কথা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। চীন ও ভারত—এই দু’টি দেশ বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র। গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরের সময় ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। একই রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষে আর বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ১৭ শত মাইল দীর্ঘ সীমান্ত। ভারতের অবস্থানও মিয়ানমারের পক্ষে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গার পক্ষে কোনও কথাই বলেননি। ভোটাভুটিতে বিরত ছিলেন। বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে চীন। গত কয়দিন আগেও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন। তিনি তখনও বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের কথা বলেছেন। অথচ দ্বিপক্ষীয়ভাবে এই সমস্যা সমাধান করতে গেলে মিয়ানমারের কথার ওপর ভরসা করা যায় না। চীন চুক্তি স্বাক্ষরে যে ভূমিকা রেখেছে, সেটা এখন স্পষ্ট। কারণ চীন কখনও এই অঞ্চলে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রদের অবস্থান পছন্দ করে না। সে কারণেই শুরু থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছিল চীন।

অং সাং সু চি র আসলে কোনও ক্ষমতা নেই। সেনাবাহিনীর বাইরে অং সাং সু চি যেতে পারেন না। বিষয়টা পশ্চিমা বিশ্ব ভালোভাবে অনুধাবন করেছে। চীন পাগল হয়ে হয়েছে মিয়ানমারকে রক্ষা করতে। কারণ আরাকান উপকূলের তেল-গ্যাস চীনের প্রয়োজন। সর্বপোরি চীন নিজ মালিকানায় আকিয়াব উপকূলে বন্দর নির্মাণ করছে এবং ১২ হাজার ৯২০ কোটি ডলার তারা আকিয়াবে এখনও পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে। চীনও মিয়ানমারকে নিয়ে কম কষ্টে নেই। কারণ চীনও নাকি পরিপূর্ণভাবে মিয়ানমারকে আস্থায় নিতে পারছে না। পেছন পেছন ভারতও রয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় বোঝা গেলো ভারতের আগ্রহেরও সীমা নেই। ভারত পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কর্মসূচি আরম্ভ হলে ভারত তাদের অস্থায়ীভাবে থাকার জন্য তৈরি বাড়ি দেবে। একই কথা নাকি চীনও বলেছে! দুই বড় রাষ্ট্রের প্রতিযোগিতামূলক সহায়তাই প্রমাণ করে তারা মিয়ানমারকে পশ্চিমা বিশ্বের রুদ্ররোষ থেকে বাঁচাতে তারা কত উদগ্রীব।

অথচ ভারত, চীন—কেউই মিয়ানমারকে আনান কমিশনের পরামর্শ অনুসারে সমস্যাটা সমাধানের পরামর্শ দিচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অতীতের নেওয়া উদ্যোগতো একইভাবে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। নাগরিকত্বহীন কতগুলো লোক এভাবে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আর বাংলাদেশ থেকে রাখাইনে আর কত ঘোরাফেরা করতে থাকবে?

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় বোঝা গেলো মিয়ানমারের ইচ্ছা অনুযায়ী ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসারে সব কিছু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এও বলেছেন, সিদ্ধান্ত তো হলো কার্যকর হয় কিনা, দেখুন। কথায় বোঝা গেলো যে, রোহিঙ্গারা যে যাবে, এ সিদ্ধান্ত যে কার্যকর হবে—তা নিয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সংশয়ে আছেন। আবার জাতিসংঘ মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পর বলেছে যে, রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়ার সময় এখনও হয়নি।

আগস্টে শরণার্থী সমস্যা শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার ঘটনাটা অস্বীকার করার পথ নিয়েছে। মিয়ানমার আন্তরিক হলে ৭/৮ লাখ শরণার্থী কখনও আসতো না। তারা অব্যাহত অত্যাচার চালিয়েছে বলে শরণার্থীর ঢল নেমেছে এবং যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শরণার্থী নিয়ে মিয়ানমার প্রচণ্ড একচাপের মাঝে ছিল এবং বিভিন্ন দেশ তাদের সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। চাপের কারণে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে এই চুক্তি সম্পাদন করেছে। তারা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এ চুক্তিটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে। অনুরূপ বিবেচনায় মিয়ানমার লাভবান হয়েছে।

সেনা কর্মকর্তাদের বিচার, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির সম্মুখীন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই চুক্তিটি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একটা অস্ত্র হিসেবে মিয়ানমার হয়তো ব্যবহার করতে পারবে। যদিও বা বিশ্বের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা যথেষ্ট পরিমাণে কমেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যাওয়া না যাওয়া এখনও অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তার বিচার চাওয়ার বিষয়টা অব্যাহত রাখতে হবে। সুখের বিষয়, আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব এই ব্যাপারে তাদের মত বদলায়নি।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

 

/এমএমআর/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ