X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইন্দিরার শততম জন্মদিনে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
৩০ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:২১আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:৩৯

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গেল ১৯ নভেম্বর ছিল ইন্দিরা গান্ধীর শততম জন্মদিন। আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়ে একটা ছোট সংবাদ পরিবেশন করেছে মাত্র। কেউ বিশেষ কোনও লেখা ছাপেনি। অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পত্রিকাগুলোতেও বিশেষ মর্যাদা দিয়ে কোনও লেখা প্রকাশিত হতে দেখলাম না। বাংলাদেশে ওই সময় সংসদ অধিবেশন চলছিল, সেখানেও তাকে স্মরণ করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বিস্মৃত হয়েছেন— এটা ভেবেই কষ্ট পেয়েছি।
ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের মানুষ বিস্মৃত হয় কিভাবে? ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যখন ভারতে গিয়েছিলাম, তখন ভারতের অবস্থাও ভালো নয়। সীমাহীন ভাতের অভাব। পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি মাড়ে-ভাতে উদরপূর্তির ব্যবস্থা। এমন অবস্থায় এ মহিয়সী নারী এক কোটি বাঙালিকে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, খাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন। এত অভাবের সময়ে আমরা এক কোটি মানুষ গিয়ে উপস্থিত, তাই বলে পশ্চিম বাংলার মানুষকেও বিরক্ত হতে দেখিনি।
ত্রিপুরায় স্থানীয় মানুষের চেয়ে শরণার্থী বেশি ছিল। আসামেও কম ছিল না। কলকাতায় আমরা অনেক সময় পয়সার অভাব হলে জয় বাংলা পত্রিকার হকারি করেছি। পশ্চিম বাংলার মানুষ আমাদের কথা শুনলে বুঝতে পারতেন, আমরা জয় বাংলার মানুষ। জয় বাংলা পত্রিকার মূল্য পরিশোধের সময় অনেকে অতিরিক্ত পয়সা ফেরত নিতো না। এমন সহানুভূতির কথা ভুলে যাবো কিভাবে!
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। মানুষে মানুষে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব নষ্ট করবে কেন! দুইটা রাষ্ট্রের মাঝে মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আমেরিকার সাধারণ মানুষের সহানুভূতি এত বেশি ছিল যে, মানুষের ভয়ে নিক্সন পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করতে পারেননি। আমেরিকার সিনেটররা দেশটির বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতা দিতেন। সিনেটে আনীত পাকিস্তানের পক্ষে নিক্সনের ২৪টি প্রস্তাবের মাঝে ২২টি সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল বলে সিনেট তা বাতিল করে দেয়। মানুষে মানুষে সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হলে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বৈধতা নিষ্ফল হয়ে যায়।
ইন্দিরা গান্ধী জন্মেছিলেন উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ শহরে ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। তার পিতা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ছিলেন তার পিতামহ পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর একমাত্র পুত্র সন্তান। আর ইন্ধিরা গান্ধী ছিলেন জওহরলাল নেহরুর একমাত্র কন্যা। পিতা, পিতামহ ও নিজে— এরা তিনজনই ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর; ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’। এদের প্রতিজনের বীরত্বগাঁথা লিখতে এক প্রবন্ধে কুলাবে না। প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র বই লিখে ফেলতে হবে।
স্বাধীনতার জন্য শুধু এ তিনজন নয়, ইন্দিরা গান্ধীর জননী কমলা নেহরু এবং তার ঠাকুরমা স্বরূপ রানীও বৃটিশের কারাগারে ছিলেন। যেন পরিবারটা ছিল ভারতের স্বাধীনতার জন্য উৎস্বর্গকৃত। এ পরিবারটা স্বাধীনতার জন্য এত উৎসুক ছিলে যে সব ত্যাগকেই তারা তুচ্ছ মনে করেছিলেন।
নেহরু ছিলেন সক্রেটিসের দার্শনিক রাজা। স্বাধীনতার পর নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি দর্শনের আলোকে ভারতকে সাজিয়েছিলেন স্তরে স্তরে। তিনি বৈচিত্র্যের মাঝে সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বৈচিত্র্যের মাঝে সমন্বয় সাধন করতে না পারলে ভারতের ঐক্য টিকবে না এবং সমন্বয়ের জন্য গণতন্ত্রের সফল প্রয়োগের কথা তিনি চিন্তা করেছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি ভারতে গণতন্ত্রের সফল প্রয়োগও করেছেন। আর এ কারণেই ভারতে গণতন্ত্রের ভিত অনেক গভীরে প্রোথিত হয়েছে।
বৈচিত্র্যের মাঝে সমন্বয় এবং গণতন্ত্রের সফল প্রয়োগ ছিল নেহরুর সময়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভারতের ভিত্তিকে নেহরুর এ সফলতা মজবুত করেছিল। নেহরু জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনেরও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ইন্দোনোশিয়ার বান্দুং শহরে এশিয়া-আফ্রিকার ২৯টি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ একত্রিত হয়ে নিরপেক্ষ জোট গঠন করেছিল। নেহরু ও সুকর্ণ ছিলেন এ জোটের মুখ্য নেতা। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পাল্টাপাল্টি রণসংস্কারের মুখে এ নিরপেক্ষ জোটটি বিশ্বে শান্তি স্থাপনে সহায়তা করার চেষ্টা করেছিল। দুইটি বৃহৎ শক্তির মধ্যেও এ জোট নিতান্ত অকার্যকর ছিল না।
১৯৫২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর নেহরুর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তারপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রীরও মৃত্যু হয়। ইন্দিরা ছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভার তথ্য ও বেতার দফতরের মন্ত্রী।
অতুল্য ঘোষ, কামরাজ, ত্রিপাঠিদের সমর্থনে ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী হলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন খুবই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মোরারজি দেশাই। এক সময় মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী এবং পরে তার পিতার মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রীও ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হলো। ইন্দিরা কংগ্রেসের সভাপতি হলেন জগজীবন রাম। ১৯৭১ সালে নির্বাচনে ইন্দিরা গরীবী হটানোর স্লোগান তুললেন, আর আদি কংগ্রেস বললো গণতন্ত্রের কথা। ইন্দিরার কংগ্রেস পেলো ৩৫২ আসন, আদি কংগ্রেস পেলো ১৬ আসন। অন্যদের মধ্যে সিপিআই ২৩ আসন, সিপিএম ২৫ আসন, পিএমপি ২ আসন, এসএসপি ৩ আসন, জনসংঘ ২২ আসন, স্বতন্ত্র ৮ আসন, নির্দল ১৪ আসন ও অন্যান্যরা পেয়েছিল ৫৩ আসন। ইন্দিরার সুদিন-দুর্দিনে কখনও সিপিআই ইন্দিরাকে ত্যাগ করে যায়নি।
১৯৭১ সালের নির্বাচনের পর এলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ইন্দিরার গৌরবের ইতিহাসের সব ঘটনাই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভারতীয়রা বিশ্বাস করে, রাজযোগ যখন কারো পক্ষে যায় তখন তার সব পদক্ষেপই অভ্রান্ত হয়। তখনকার সব পদক্ষেপই ইন্দিরা আর শেখ মুজিবের ইতিহাসে অভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছিল।
তাজউদ্দীন সাহেব ২৫ মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসায় বসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বের হওয়ার জন্য। তখন বঙ্গবন্ধুর ভারতে চলে যাওয়ার বিষয়টা স্থির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভারতে চলে যাওয়ার জন্য বের হননি। এ বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারাও বহু কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরাও বিষয়টিকে ‘আত্মসমর্পণ’ বলে আখ্যায়িত করতেন। অথচ সিদ্ধান্তটি ছিল সর্বাংশে সঠিক।
আন্দোলনের মুখ্য নেতা ভারতে অবস্থান নিলে বাংলাদেশের জনসাধারণ তা কোন দৃষ্টিতে দেখবেন, সে সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হওয়া ছাড়া শত্রুর হাতে কারাবরণের সিদ্ধান্তই তো ছিল উত্তম। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু ভারতে গিয়ে ময়দানে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিলে তাদের সরাসরি প্রতিপক্ষ হয়ে যেতেন। পাকিস্তানের কারাগারে থাকায় বরং তাদের সহানুভূতি পেয়েছিলেন।
কিসিঞ্জার তার বইতে লিখেছেন, তার পরামর্শেই পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করে স্থগিত রেখেছিলেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বজাতির স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন নিয়ে বিরাট এক জুয়া খেলা, যিশুর মতো খৃস্ট সমাজের পাপের জন্য নিজেকে বলিদান।
গয়ায় অস্থায়ীভাবে বসতি গড়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। দালাইলামা ভারতে লক্ষ তিব্বতিকে নিয়ে এসেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন, তিব্বতকে মুক্ত করে তারা ফিরে যাবেন। কিন্তু ফিরে যেতে পারেননি। তিব্বতকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেছিল চীন। বঙ্গবন্ধুরও অনুরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। সেই দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর ভারতে না যাওয়াটা ছিল সুচিন্তিত ও উত্তম একটি সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ইন্দিরার সাহস-মনন-মেধার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ক্ষেত্র। পাকিস্তানের ইয়াহিয়া-ভুট্টো, চীনের মাও সেতুং-চৌন এন লাই আর আমেরিকার নিক্সন-কিসিঞ্জারের সম্মিলিত রণকৌশলকে ইন্দিরা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সঠিক পথে পরিচালনা করে সম্ভব করে তুলেছিলেন। বাংলাদেশ নিয়ে ইন্দিরার পরিকল্পনাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম প্রথম মনযোগ দিয়ে দেখেনি। বরং বাংলাদেশের বিষয়টি উত্থাপন করা হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরক্ত হতো। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী কৌশলে সোভিয়েতকে তার অবস্থানে থাকতে দেননি। অবশেষে ৯ আগস্ট ভারতের সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদের সামরিক চুক্তি সম্পাদন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিসিঞ্জার তার ‘হোয়াইট হাউস ইয়ারস’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করে সোভিয়েত ইউনিয়ন বারুদের স্তূপে একটি জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি ছুঁড়ে দিয়েছিল।’ চুক্তির পরেই চীন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছিলে সোভিয়েত। চীন বুঝেছিল, তারা যদি পাকিস্তানের পক্ষে কিছু করতে যায়, তবে সোভিয়েতের প্রতিশোধ মোকাবিলা করতে হবে। এমনিতেই তখন দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না।
১৯৭১ সালে শেষের দিকে সফরে বের হন ইন্দিরা। নভেম্বর মাসে তিনি ওয়াশিংটন পৌঁছান। নভেম্বরের ৪ ও ৫ তারিখে ইন্দিরার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক হয় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের। বৈঠক সম্পর্কে নিক্সনের দুই খণ্ডে লেখা স্মৃতি কথার ‘দ্য মেমোয়ার্স অব রিচার্ড নিক্সন’-এ বিস্তারিত তথ্যও রয়েছে। কিন্তু কিসিঞ্চার তার বইতে এ আলোচনাকে ‘ডায়ালগ অব দ্য ডেফ’ বা ‘দুই বধিরের সংলাপ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
নিক্সনের সঙ্গে দুই দিনের আলোচনায় কেউ কাউকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ‘কনভিন্স’ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। কিন্তু আমি আগেই বলেছি, আমেরিকার মানুষ, কংগ্রেস, মিডিয়া— সবই ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। ইন্দিরার এ সফর সবার সমর্থনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ কারণেই খোদ আমেরিকায় একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন নিক্সন-কিসিঞ্জার। নিক্সন আর কিসিঞ্জারের লেখা বই পড়লে এমনই মনে হয়। কিসিঞ্জার ১৭টি বই লিখেছেন, নিক্সনের বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। দু’জনেই কিন্তু প্রথম জীবনে অধ্যাপনা করতেন।
বাংলাদেশ সরকারকে তখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দেননি ইন্দিরা। তিনি বলতেন, পাকিস্তান-বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে তাদের বিষয়টি মীমাংসা করতে পারেন। অথচ বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তখন প্রবাসে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করেছিলেন। আর এপ্রিল মাসে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় এয়ার কভারেজ ও ভারতীয় বাহিনীর সতর্ক পাহারায় বাংলাদেশের একখণ্ড জমিকে ‘মুজিবনগর’ নাম দিয়ে সেখানে বাংলাদেশ সরকার শপথবাক্য পাঠ করেছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার বিষয়টা তখন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছিল। আবার হাজার হাজার বাঙালি যুবককে সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধে নিয়োজিত করার কাজও অব্যাহতভাবে চলছিল। বাঙালি তরুণ, পক্ষত্যাগী সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য, পুলিশ, বিডিআরের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ১১ সেক্টরে বিভক্ত হয়ে ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে সুশৃঙ্খলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। সেই যুদ্ধে তারা সফলও হয়েছিলেন।
কিসিঞ্জারের বইতে দেখা যায়, তারা একবার প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও সংসদ সদস্য জহুরুল কাইয়ুমের সঙ্গে সমাধানের বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা সফল হননি।
লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পর যখন ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পরিণতি স্মরণ করে উত্তর সীমান্তে ভারতের সামরিক উপস্থিতি মজবুত করেছিলেন। এরপরও তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের জন্য ডিসেম্বর মাসকে উপযুক্ত সময় বলে বিবেচনায় রেখেছিলেন। কারণ তখন হিমালয়ে বরফ গলার কারণে চীন-ভারত যুদ্ধ প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। চীনের পক্ষ থেকে তখন যুদ্ধের ভয় থাকে না। যদিও সোভিয়েতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি সেই সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছিল আগেই।
ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা সফরে এলেন ১ ডিসেম্বর। ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি কলকাতায় ছিলেন। তাজউদ্দীন সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যৌথ অভিযানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত তখনই হয়েছিল। ওইসময় এই যৌথ অভিযানের কমান্ড নিয়েও মতবিরোধ হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী তাদের একক কমান্ড চেয়েছিল। কিন্তু প্রবাসী সরকার ও বাংলাদেশের বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানীর বিরোধিতার ফলে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের বিষয়টি স্থির হয়েছিল।
জে-এন দীক্ষিত ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব। ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-ইন-ওয়্যার অ্যান্ড পিস’ নামক বইয়ে তিনি এসব বিষয় তুলে ধরেছেন। কলকাতা সফর শেষে দীক্ষিত ও ডিপি ধরকে নিয়ে ইন্দিরা ৩ ডিসেম্বর প্লেনে দিল্লির পথে রওনা হন। মাঝপথে খবর পেয়ে পাইলট ইন্দিরা গান্ধীকে জানালেন, পাকিস্তান পশ্চিম সীমান্তে আকাশ পথে আক্রমণ করেছে। আম্বালা, অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর ও আগ্রায় বোম্বিং করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের এ আক্রমণ ছিল আত্মহত্যার সামিল। সম্ভবত পাকিস্তান সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে পাকিস্তান যদি ধ্বংস হয় বা খণ্ডিত হয়, তবে যুদ্ধ করেই হবে।
যুদ্ধ চললো মাত্র ১৩ দিন। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করলেন নিয়াজি। অভ্যুদয় হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। এটা ছিল ইন্ধিরা গান্ধীর জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এ কাজের মধ্য দিয়ে তিনি ভারতের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইন্দিরা গান্ধীর আরও বহু অর্জন ছিল। সবকিছু এক প্রবন্ধে লেখা সম্ভব নয়। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী তার দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসে ইন্দিরা অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
[email protected]

/টিআর/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ