X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সভ্যতার অ-সভ্যতা

দাউদ হায়দার
০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:৪১আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:৪৭

দাউদ হায়দার নাম শুনে ঘাবড়ে যাই, গ্যুয়েন্টার হেসলিংগার। আর্জেন্টিনার উত্তর-পূর্ব প্রদেশ পাটাগোনিয়ায় জন্ম। আর্জেন্টাইন নাম এরকম হয় না। গ্যুয়েন্টার হেসলিংগার খাঁটি জার্মান নাম।
গুয়েন্টারের সঙ্গে পরিচয় বছর পাঁচেক আগে, ল্যাটিন কালচারাল ফেস্টিভ্যালে। ফ্লেমেঙ্কো (ফ্লেমেঙ্গো) নর্তক তিনি। অতীব সুদর্শন চেহারা। ফুটবলার মেসির চেয়ে আকর্ষণীয়। হাতের মুদ্রা, পায়ের ছন্দ ‘তা তা থৈ থৈ।’ চুল ঈষৎ কোঁকড়ানো, ঘন। চাহনি মিকোলেঞ্জোর ছবির অ্যাপোলো যেন।
লম্বায় ছ’ফুটের বেশি, চোখ দুটি রবি ভার্মার আঁকা কৃষ্ণের। হাসি মদনের (রবি ভার্মার ছবিতে যেমন)। তো, তরুণীরা কাবু হবে, মায়ায় জড়াবে। আঁকুতিমাখা প্রণয়পত্রে লিখবে ‘প্রাণেশ্বর’।
পরিচয়ের বছর দেড়েক পরে ঘনিষ্ঠতা, তার আগে এখানে ওখানে কোনও পার্টিতে দেখা। সঙ্গে ইসাবেলা, বান্ধবী। বয়স বত্রিশ (আন্দাজ)। মুখ ও চোখ যেন যামিনী রায়ের আঁকা।
দুজন সবসময়েই একসঙ্গে। নাছোড়। দেখা হলেই বলি ‘কপোত-কপোতী’।
গ্যুয়েন্টারের মুখেই শুনেছিলুম, বাবা জার্মান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, জুলাইয়ে, ১৯৪৫ সালে, ফুলজ থেকে পালিয়ে আর্জেন্টিনায় (পাটাগোনিয়ায়) আশ্রিত। দশ বছর পরে আর্জেন্টিনিয়ান নাগরিকত্ব। বাবার বয়স তখন ১৭, হিটলারের যুব বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ১৫ বছর বয়সে। একটি মানুষও ‘নাকি’ মারেননি, কিন্তু মিত্রবাহিনী, যুদ্ধশেষে, হিটলারের ‘এ টু জেড’ বাহিনী-কে গ্রেফতার করছিল, তখন, অনেকেই পালিয়ে যায় ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশে, গ্যুয়েন্টারের বাবাও।– বলছিলেন। আরও বলছিলেন, ‘নাৎসিবাহিনীতে বাবার কী ভূমিকা, যুদ্ধে কী করেছেন, আমেরিকান সেনারা সব খতিয়ে দেখে বাবার কোনও দোষ পায়নি। নিছকই সৈন্য ছিলেন। মুক্তি পান।’

গ্যুয়েন্টারের রসিকতা, ‘মুক্তি পেয়ে মুক্ত বিহঙ্গ। জুটে যায় বিহঙ্গী। ষাটের দশকে (কোন বছর বলেননি) বিয়ে করেন। কোনও সন্তান হয়নি। বাবার কথা, ‘আমরা বিহঙ্গ-বিহঙ্গী সুখী।’ সুখে ভাঁটা। ১৯৮০ সালে মারা যান বাবার বিলাভেড। এক বছর পরে আবার বিয়ে। আমি বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। প্রথম সন্তান কন্যা। বাবা জার্মান, পদবি জার্মান, আমার নামও জার্মান, বাবার পদবি নিয়ে। কিন্তু আমি আর্জেন্টিনার নাগরিক।”

গ্যুয়েন্টার হেসলিংগারের বয়স ৩৫ বছর ৩ মাস। ওঁর ৩৫ জন্মদিনে খুব ধুমধাম করলুম বন্ধুকুল মিলে, ওঁরই আস্তানায়। গ্যুয়েন্টার এবং ইসাবেলার ফ্লেমিঙ্কো নাচে আমরাও ‘নৃত্যশিল্পী’। নাচিয়ে।

গত সপ্তাহে গ্যুয়েন্টারের বাড়িতে এসে হাজির, টেলিফোন না করেই। মলিন চেহারা। কারণ কী? বললেন, “আমার জন্মদিনে, তোমাদের সামনেই, ইসাবেলা আমাকে একটি স্মার্টফোন উপহার দিয়েছিল। দাম ৯শ ৯৫ ইউরো। ওই ফোনে হরেক কেতা (প্রোগ্রাম)। ফেসবুক-টেসবুক কী সব ছাইটাই। কে একজন, অচেনা তরুণী ‘মাইন সুস, মাইন লিবে’ (মাই সুইটি, মাই লাভ-আমার সুমিষ্ট, আমার প্রেম, প্রাণাধিক) ফেসবুকে মেসেজ পাঠিয়েছে, সঙ্গে ছবি, নিপোশাক। ইসাবেলা স্মার্টফোন নিয়ে দেখলে, অত”পর ‘অ্যাঁ?, এইসব?!’”

যতই বলি মেয়েটিকে আমি চিনি না, কক্ষনো দেখিনি, আমার হদিসই-বা কী করে পেল অজানা। নিশ্চই কোনও ঝামেলা আছে। চক্রান্ত হতে পারে। ইসাবেলা কিছুই শুনবে না। ভয়ঙ্কর কাণ্ড বাধিয়েছে। প্রায় উন্মাদিনী। পারলে আমাকে হত্যা করে। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস ডুবে-ডুবে জল খাচ্ছি। ফাঁকি দিচ্ছি ওঁকে। স্মার্টফোন, হোয়াটস-অ্যাপ, বিজ্ঞান সভ্যতার অবদান অবশ্যই, কিন্তু অসভ্যতার চূড়ান্ত। উটকো বিপদ। প্রাইভেসি থাকছে না।

বললুম, মুঠোফোন-স্মার্টফোন আবিষ্কারর বহু-বহু বছর আগে আমাদের রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, গোপন কথাটি রবে না গোপনে।

গ্যুয়েন্টার ।। নিকুচি করি স্মার্টের। গৃহের শান্তি, মনের শান্তি, প্রেমের শান্তি সব বরবাদ।

জিজ্ঞেস করলুম, কোথায় ফোন?

বললেন, সঙ্গে আনিনি, ইসাবেলার কাছে।

স্বীকার করলেন  গ্যুয়েন্টার, ‘স্মার্টফোনের বিস্তর সুবিধা, উপকারিতাও আছে, অপকারিতাও কম নয়। বিজ্ঞান অবশ্যই উপকারের জন্যই আবিষ্কার করেছে, জনজীবন সহজ এবং সামাজিক যোগাযোগের চটজলদি মাধ্যমও তৈরি করেছে কিন্তু অহেতুক ঝামেলাও পাকাচ্ছে। যাকে দুই চোক্ষে দেখতে পারিনে, যে আমার পরম শত্রু, তার ছবি ফেসবুকে ঢুকে পড়ছে। শত্রু হয়তো আমার বন্ধুর বন্ধু, বন্ধুর সঙ্গে আমার শত্রুর শত্রুতা নেই, তার মাধ্যমে আমার ফেসবুকে। যদিও, শত্রুদের ছবি, মেসেজ, বন্ধ করা যায়, করার কারিগরিও শিখেছে ইসাবেলা। তাও রক্ষে নেই। নিপোশাকের মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী, কুৎসিত হলে ইসাবেলা হয়তো ক্ষমাঘেন্না করে ক্ষমা করতো।

সমস্যা কেবল গ্যুয়েন্টার-ইসাবেলার নয়। স্মার্টফোন নিয়ে ‘সামাজিক ব্যাধি’ ক্রমশ ঘটায়মান। বিশেষত উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। যেমন খোদেজা। বাংলাদেশের। বার্লিনে বাসা। ওঁর স্বামী একটি রেস্তোরাঁয় পাঁচক। ওঁদের কন্যা খাদিজা। বয়স পনের। গোটা পরিবারই ধার্মিক। খোদেজা ও ওঁর মেয়ে খাদিজা ঘরের বাইরে হিজাব পরেন।

খাদিজা হিজাব পরে স্কুলে যায়, সহপাঠী/পাঠিনীর আড়চোখ, দূরত্ব, বন্ধুতায় চিড়। মাঝেমধ্যে কুকথাও শোনে খাদিজা। স্কুল থেকে ফিরে মাকে বলে।

খোদেজার কথা, “বলুক। কান দিও না। তুমি সাচ্চা মুসলমান। হিজাব মুসলিম নারীর সৌন্দর্য।”

—     এইটুকু বলে খোদেজা চুপ, বিমর্ষ।

কারণ কী? ভাবছি, খাদিজা কী আইএস (ইসলামিক স্টেট)-এর দিকে জঙ্গির দিকে ঝুঁকছে? জার্মানিসহ ইউরোপের কয়েকজন ছেলেমেয়ে আইএস-এর মতাদর্শে প্রভাবিত, যোগও দিয়েছেন অনেকে, খাদিজা কী সেই দলে? বয়সটাই প্রভাবিত হওয়ার।

খাদিজাকে জন্মের পর থেকে জানি। হাসিখুশি। নানা ধরনের বই পড়ে। পড়ে প্রশ্ন, তর্ক। ১৪/১৫ বছরের ছেলেমেয়েরা যেমন করে।

খোদেজা বললেন, “এই বছরের মার্চে ওর (খাদিজা) জন্মদিনে  স্মার্টফোন উপহার দিয়েছিলাম। পেয়ে খুব খুশি। মাসখানেক পরেই দেখি খাদিজা স্কুল থেকে ফিরে নাকেমুখে কিছু খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে, দরজা বন্ধ করে লেখাপড়ায় মশগুল। মহাখুশি আমরা। একদিন সন্দেহ হলো, দরজার টোকা দিয়ে, ডাকাডাকি করেও সাড়া নেই। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে বললে, পড়ালেখায় ব্যস্ত আছি। আগে তো এরকম ছিল না। গত পরশু খাদিজা স্নানঘরে, ওর ফোন বাজলে, খাদিজার বাবা (খাদেমুল) ফোন ‘টিপে, ওপেন করে’ দেখলেন, হাত থেকে ফোন পড়ে যায়, তিনি কাঁপতে থাকেন, মৃগী রোগী যেন। ফোনে দেখি ভয়ানক ব্যাপার। খাদিজার এক সহপাঠীর ছবি, ছেলেটিকে চিনি, ছেলেটির পরনে কাপড় নেই।..... আরেকবার টিপ দিলাম, দেখি খাদিজার ছবি। পোশাক ছাড়া। মা হয়ে কী আর বলবো। স্মার্টফোন কী নিষিদ্ধ করা যায় না?”

— বন্ধের আকুতি কেবল খোদেজার নয়, ইউরোপসহ গোটা বিশ্বের বহু বাবা মার। যাদের ছেলেমেয়ের উঠতি বয়স। সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) দফতরের সামনে শতাধিক নরনারী সমবেত হয়ে দাবি জানান, আঠারো বছরের কম ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্টফোন/হোয়াটসঅ্যাপ নিষিদ্ধ করা হোক।

সমস্যা হচ্ছে, কীভাবে নিষিদ্ধ করবে। এও এক সামাজিক সমস্যা। মানবাধিকার সমস্যা। ব্যবসা সমস্যা। আঠারো বছরের আগে ধূমপান নিষিদ্ধ কিন্তু ১৬ বছরের ছেলেমেয়ে কনডম কিনতে পারবে, নিষিদ্ধ নয়। এই ক্ষেত্রে বাবা-মা সমাজও মৌন।

এই সভ্যতা-অ-সভ্যতার নানা ঘূর্ণাবতন, মানতেই হবে এবং মানতে হবে গ্যুয়েন্টার, খাদিজার ফেসবুকের কালচার। হোক তা বিজ্ঞানের সভ্যতার অ-সভ্যতা।

স্মার্টফোন নিয়ে বাবা-মার যতো আপত্তিই থাক, বিজ্ঞানের এই সভ্যতার অ-সভ্যতার নানা গুণও আছে। বড়ো গুণ প্রায়-প্রত্যেকের হাতেই মুঠোফোন। বাসে -ট্রেনে- ট্রামে- মেট্রোরেলে পাশাপাশি বসা বন্ধুর সঙ্গেও কথা বলে না। সারাক্ষণ স্মার্টফোন টেপাটেপি। পড়ছে, দেখছে, নিঃশব্দ হাসাহাসি। কখনও গম্ভীর। কখনও কান্নাকাটিও। চোখে জল। সবই নীরবে। বড্ডো শান্তিতে আছি। শূন্যতার যেমন অস্তিত্ব আছে, নিঃশব্দতারও নানা রূপ, না-বলা বাণী আছে।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

/টিএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ