X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয় বন্ধু আনিসুল হক ও তাঁর সততার শপথের সাক্ষী

স্বদেশ রায়
০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৩৯আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:২৫



স্বদেশ রায় মতিয়া চৌধুরীর বাসা থেকে বেরিয়েই আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরেন তিনি (আনিসুল হক)। এরপর অনেকটা টেনেই তাঁর গাড়িতে তোলেন। তখনও আনিস ভাইয়ের শরীর কেমন যেন কাঁপছে। রমনা থানার কাছাকাছি আসার পর নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলেন আনিস ভাই— বলেন, ‘দাদা, আওয়ামী লীগের যদি এমন ছয় জন মন্ত্রী থাকতেন তাহলে ৫০ বছরেও আওয়ামী লীগকে কেউ ক্ষমতা থেকে নামাতে পারতো না। রাজনীতি যদি সত্যি করার সুযোগ পাই তাহলে এমন সততা নিয়েই করবো। আমি ব্যবসায়ী, আমার জীবনযাপনও ভিন্ন। তবে রাজনীতিতে আমি কোনও অসততার স্থান দেবো না।’ এই কথাগুলো যখন আনিস ভাই বলছিলেন, তখনও তাঁর শরীর কাঁপছিল।
আনিসুল হক এর আগে কোনোদিন মতিয়া চৌধুরীর বাসায় যাননি। সেই তাঁর প্রথম যাওয়া। মতিয়া চৌধুরীর বাসায় যাওয়ার পেছনে একটু ইতিহাস ছিল। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে আনিস ভাই একদিন আমাকে বললেন, ‘দাদা আমি মেয়র নির্বাচন করতে চাই।’
আনিস ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা পারিবারিক পর্যায়ের। সাধারণ বন্ধুত্বের বেড়া কবে কিভাবে পেরিয়ে গিয়েছিল তা বলা কঠিন। আমার অন্য বেশিরভাগ বন্ধুর মতো তিনিও আমাকে দাদা ডাকতেন। আমি আনিসুল হককে আনিস ভাই ডাকতাম। তাই মেয়র নির্বাচন করার মনস্থিরের আগে তিনি আপনজন হিসেবে আমার মত নেন। আমি প্রথমেই জানতে চাই, ভাবী রাজি তো? তিনি নিজের চেনা উচ্চস্বরের মধুর হাসি দিয়ে বললেন, ‘রাজি করানো যাবে।’ এরপর বললাম, আগে ঘরের ভেতরের কাজটা শেষ করেন। তারপর আপনি মেয়র নির্বাচনে নামলে আমাদের যতটুকু কাজ করার তা তো আমরা করবোই।
সেদিন এ বিষয়ে কথা এখানেই শেষ হয়। এরপর প্রায় দিন পনেরো পরে তিনি ও ভাবী এক জায়গায় দেখা করতে যান। এই বিষয়ে কথা বলবেন বলে আমাকেও সেখানে যাওয়ার জন্য ডাকেন। আনিস ভাই ও আমার উভয়েরই অভিভাবক তিনি। অফিসের নিউজ শেষ করে আমার যেতে একটু দেরি হয়ে যায়। গিয়ে দেখি তারা অপেক্ষা করছেন। সেদিন আনিস ভাইয়ের কথা শুনে মনে হয় তিনি এখন আর শুধু তার উচ্চস্বরের হাসির ভেতর ভাবনাটা রাখেননি। বেশ সিরিয়াস। তিনি রাজনীতিতে আসবেনই। মেয়র নির্বাচনও করবেন।

সেখান থেকে বের হওয়ার সম্ভবত দিন দুয়েক পর বিকালে আনিস ভাই ফোন করে জানান, আমি অফিস থেকে ফেরার পরে তিনি আসবেন। সেদিনের আনিসুল হক আরও সিরিয়াস। তিনি জানালেন, তাঁর প্রথম প্রয়োজন আপা (শেখ হাসিনা) তাকে মনোনয়ন দেবেন কিনা এই বিষয়টি জানা। এজন্য আগে প্রধানমন্ত্রীকে কথাটা বলতে হবে। এই কথাটা তিনি নিজে বলার আগে অন্য একজনকে দিয়ে বলাতে চান। আর সেই মানুষটি কে হবেন তাও তিনি স্থির করেছেন। এখন তাকে রাজি করাতে হবে আমাকে। শুনে আমি তো আকাশ থেকে পড়ি! বলি, রাজনীতি যেখানে একেবারে ওপরের মহলের বিষয় সেখানে আমার মতো সাধারণ একজন মানুষ কী করতে পারি! আবার আনিস ভাইয়ের সেই উচ্চস্বরের হাসি। তারপরে তিনি যা বললেন তা ছিল এমনই— বললেন, তিনি খুব ভেবে দেখেছেন, একমাত্র মতিয়া চৌধুরী ছাড়া তিনি যদি অন্য কারও মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী ধরে নিতে পারেন ওই ব্যক্তির কোনও স্বার্থ আনিসুল হক পূরণ করেছেন বলেই তিনি এটা বলছেন। কারণ তিনি একজন ব্যবসায়ী। রাজনীতিবিদরা সবসময়ই তার কাছ থেকে সহযোগিতা নেন। প্রধানমন্ত্রী তাই মনে করতে পারেন এটাও কোন সহযোগিতার বিনিময়ে হচ্ছে। একমাত্র মতিয়া চৌধুরী যদি বলেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী মনে করবেন কোনও স্বার্থ ছাড়াই এসেছে এই প্রস্তাব। আর তাঁর প্রস্তাবটি গুরুত্বও পাবে।

এরপরে মতিয়া আপার সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানাতেই তিনি বললেন, ‘দেখেন, প্রধানমন্ত্রী আমার কথায় রাজি হবেন কিনা তা বলতে পারি না। তবে আমি তাকে এটুকু বলতে পারি, আনিস এসেছিলেন আমার কাছে, আপনাকে এই কথা বলেছেন। পরবর্তী সিদ্ধান্ত আপনার।’ মতিয়া আপা এ কথা বলার পরে আনিস ভাইকে জানাই। আনিস ভাই চিৎকার করে ওঠেন ফোনের ও-প্রান্ত থেকে। যা তার চিরকালের স্বভাবসুলভ। বললেন, ‘দাদা এটুকুই যথেষ্ট। কবে যাবো ঠিক করেন।’

তারপর দু’একদিনের মধ্যে এক সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাবে আনিস ভাই ও আমি একসঙ্গে সেখান থেকে মতিয়া আপার বাসায় যাই। মতিয়া চৌধুরীর পাশের সোফায় বসে আনিস ভাই দেখেন মাথার ওপর একটা ফ্যান ঘুরছে। কোথাও কোনও এয়ারকুলার নেই। মতিয়া আপা তার সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন। তিনি ওইটুকুই শুধু প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন। আনিসুল হকেরও এর চেয়ে বেশি চাওয়া নেই।

অন্যদিকে আমার অফিসের নিউজ টাইম এসে যাচ্ছে। তাই দ্রুতই কথা শেষ হয়। আর ওই সময়ের মধ্যে মতিয়া চৌধুরীর বাসাটি যেন সিংহাবলোকন করলেন আনিস ভাই। আর তার মধ্য দিয়ে তিনি আরেকবার চিনলেন অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীকে। সঙ্গে সঙ্গে জীবনের ওই প্রান্তে এসে যখন তিনি জীবনকে একটি নতুন বাঁকে নিয়ে যাচ্ছেন তখন আবার নতুন করে বুঝলেন প্রকৃত রাজনীতি কী।

তাই মতিয়া চৌধুরীর বাসা থেকে বেরিয়ে অন্য এক আনিসুল হক রমনা থানার কাছাকাছি এসে আমার মতো একজন সাধারণের হাত চেপে ধরে তিনি তার নিজের রাজনৈতিক জীবনের শপথ নিলেন। এরপরের ইতিহাস আমার চেয়ে অনেকেই ভালো জানেন। কারণ, এটুকু পথ হেঁটেছি বন্ধুর জন্য। কোনও দলীয় রাজনীতির জন্য নয়। যে কারণে এর কয়েকদিন পর একটি অ্যাম্বাসির পার্টি থেকে বের হওয়ার সময় কর্নেল ফারুক খান ভাই আমাকে বলেন, ‘দাদা চলেন আজ মেয়র ক্যান্ডিডেটের বাড়িতে মিটিং আছে। আমিও সাংবাদিক হিসেবে আগে থেকে জানতাম। ফারুক খান ভাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে আসি। রাত ১২টার দিকে আনিস ভাইয়ের ফোন।

রাত ১২টার দিকে আনিস ভাইয়ের এই ফোন কল নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে। তার সেই ভরাট গলা আর হাসির সঙ্গে বলতেন, ‘দাদা মাঝে মধ্যে আপনার সঙ্গে কথা না হলে মন দুর্বল হয়ে যায়। আমিও অনেকদিন হেসে বলতাম, দুর্বলের সঙ্গে কথা বলে কি আর সবল হওয়া যায়! তারপর নানান আলাপ হতো। যাক সেসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। সেদিন ফারুক খান তাঁর বাসা থেকে চলে গেলে আনিস ভাই ফোন করলেন, ‘দাদা ফারুক খান ভাই আপনাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, আসলেন না।’ তখন তাকে বলি, ‘আনিস ভাই এখন তো আপনার বিষয়টি রাজনৈতিক, এর সঙ্গে আমি জড়াবো না। তবে সাংবাদিক হিসেবে আপনার নির্বাচনে যতটুকু যা করতে পারি তা করবো। আমি সাংবাদিক হিসেবে কোনও নির্বাচনেই নিরপেক্ষ থাকি না। আমি আমেরিকান সাংবাদিকদের মতো নিজের বিবেচনায় যিনি দেশের জন্য ভালো প্রার্থী তার পক্ষ নেই। জাতীয় নির্বাচনের সময়ও একই কাজ করি। এটাকেই আমি সততা মনে করি। কারণ মনে মনে কাউকে না কাউকে সমর্থন করি আর লেখার সময় দুই পক্ষের ভারসাম্য বজায় রাখা এক ধরনের প্রতারণা। এটা স্বাধীন নয়, ভীত ও আপোসকামী মনের প্রকাশ।

তবে জানতাম নির্বাচনে আমার কলম আনিসুল হকের জন্য কতটুকুইবা কাজ করতে পারবে। আনিসুল হক পাশ করবেন নিজ যোগ্যতায় ও আওয়ামী লীগের সমর্থনে। নির্বাচন করতে গিয়ে রাজনীতি সম্পর্কে অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। যা আমাদের পরিচিত। ব্যস্ততার মাঝেও রাতে ফোনে সেগুলো শেয়ার করতেন তিনি। আর বারবার বলতেন, ‘নির্বাচনে যদি পাশ করি তাহলে সততার সঙ্গেই কাজ করবো। মতিয়া চৌধুরী হতে পারবো না। তবে কতদূর যেতে পারি সেই চেষ্টাই করবো।’

নির্বাচনের পরদিন থেকেই আনিসুল হক কাজে নেমে পড়েন। আর সত্যি তিনি ঢাকা উত্তরের চেহারা বদলের দিকে এগিয়ে যান। প্রথম দিকে রাস্তা খোড়াখুঁড়ি হলে তাঁর যারা সমালোচনা করতেন তাঁরা এখন বলেন, সত্যি কাজ করেছেন আনিসুল হক। তার এই কাজের ব্যস্ততার মধ্যে চলে যাওয়ায় কথা কম হতো। তারপরও তিনি যেদিন মোনায়েম খানের পরিবারের দখল থেকে রাস্তা উদ্ধারে নামতে যান তাঁর আগের রাতে কথা বলেন। আর আমিও তার কাছে একটি কাজ নিয়ে গিয়েছিলাম আমার জীবনের বন্ধুর চাপে পড়ে। তাঁর নিজের মেয়ে নেই, তাই মেয়ের মতো কেউ হলেই তাঁর নিজের মেয়ে হয়ে যায়। সংসার ভেঙে যাচ্ছিল তার। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে তার স্বামী সিটি করপোরেশনে। সেখানে নিয়ম আছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিটি করপোরেশনকে সেটা গ্রহণ করতে হবে। তবে সংসারটি টেকানোর জন্য আমরা তখন অন্য চেষ্টা করছিলাম। যে জন্য আরও কয়েকটা দিন প্রয়োজন। তাই এক শুক্রবার সকালে আনিস ভাইকে ফোন করে বলি, একটি তদবির নিয়ে তাঁর কাছে আসছি।

আমি তদবির নিয়ে যাচ্ছি শুনে তাঁর গলাটা কেমন হয়ে যায়। কারণ ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর তিনি ততদিনে অনেকের আরেকটি ছবি দেখে ফেলেছেন। তাই গলা তাঁর একটু অন্যরকম হওয়া স্বাভাবিক। আমি যখন গিয়ে আমার তদবিরটি বলি, তিনি হো হো করে হেসে দিয়ে বললেন, ‘লাভ কী আপনার।’ বললাম, একটি সংসার ভেঙে গেলে সবচেয়ে কষ্টে পড়ে সন্তানরা। মেয়েটির একটি কিশোর ছেলে আছে। আমাকে ও চিত্রাকে নানুভাই বলে ডাকে। আনিস ভাই বললেন, ‘যতদিন ওদের সংসার এক না হয় ততদিন ওই চিঠি আটকে থাকবে।’ মেয়েটি এখন স্বামী ছেলে নিয়ে অত্যন্ত সুখী জীবনযাপন করছে। আনিস ভাইও জেনে গেছেন, তিনি শুধু মেয়র হিসেবে রাস্তা তৈরি করেননি, অবৈধ দখল উচ্ছেদ করেননি। একটি সংসারে স্বর্গীয় সুখও দিয়ে গেছেন।

আনিস ভাই অসুস্থ থাকাকালীন মতিয়া আপা প্রায়ই আমার কাছ থেকে তাঁর খবর নিতেন। মাঝখানে একদিন তার বাসায় আনিস ভাইয়ের কথা উঠতেই তিনি বললেন, ‘আমার সবসময় কানে ভাসে আনিসের সেই কথা। তিনি আমাকে বলেছিলেন— আপা, আওয়ামী লীগ আমাকে মেয়র বানিয়েছে। আমি কাজের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে ঢাকার অর্ধেক আসন এনে দেবো।’

আনিস ভাই! আওয়ামী লীগ হয়তো তাদের ঢাকার অর্ধেক আসনের শতভাগ নিশ্চয়তা হারালো। কিন্তু আমরা শুধু প্রিয় বন্ধুকেই নয়, হারালাম আস্থার একটি স্থানকে। আনিস ভাই আপনার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, সমাজ ও ব্যবসায়িক কমিউনিটির অনেক ক্ষতি হয়ে গেলো। আর এই ইটকাঠের ঢাকা শহরে ক্ষতি হয়ে গেলো অনেক বন্ধুর। পৃথিবীতে সবাই বন্ধু হতে পারে না। বন্ধু হতে হলে আরও একটি বাড়তি হৃদয় থাকতে হয়। যা আপনারই ছিল ষোলআনা। তাই আপনার চলে যাওয়ার সংবাদ শুনে মনে হচ্ছে এমনি করেই কি একদিন জীবন ষোলআনাই মিছে হয়ে যাবে?

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক

 

/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ