X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

গুজরাটের নির্বাচন কী বার্তা বয়ে আনবে মোদির জন্য

আনিস আলমগীর
০৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:৪১আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:৪১

আনিস আলমগীর ভারতের সৌন্দর্য্য হলো তাদের গণতন্ত্র। বছরব্যাপী একেক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন, লোকসভা নির্বাচন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন লেগেইে আছে। এইসব নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার ওঠা-নামার হিসাব কষে সতর্ক হতে পারে। সব দলই জানে যে অসতর্ক হলেই বিপদ।
এখন ভারতে সর্বভারতীয় পর্যায়ের দল হচ্ছে কংগ্রেস আর বিজেপি। আঞ্চলিক দলের সমারোহ বেড়েছে। যুক্তফ্রন্ট গঠন করে সরকার গঠনও হচ্ছে কোনও কোনও রাজ্যে। আবার একক দলের সরকারও হচ্ছে। বড় বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায়, ইন্দিরার কংগ্রেস বিরোধী দল। আসামে বিজেপি সরকার গঠন করেছে অসম গণপরিষদ ও ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র কয়েকটা দলের সাহায্য নিয়ে। আসামে আগের ১৫ বছরের ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেস এখন বিরোধী আসনে।
বিহারে নিতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) বিজেপির সঙ্গে জোট বেধে ক্ষমতায়, বিরোধী আসনে আছে লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল। দিল্লিতে ক্ষমতায় আম আদমি পার্টি, তিন সদস্য নিয়ে বিজেপি বিরোধী দল। উত্তর প্রদেশে বিজেপি ক্ষমতায়, বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টি। পাঞ্জাবে কংগ্রেস ক্ষমতায়, আকালি-বিজেপি জোট বিরোধী দল। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ক্ষমতায়, কংগ্রেস বিরোধী দল। গুজরাট রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়, কংগ্রেস বিরোধী দল। কর্নাটকে কংগ্রেস ক্ষমতায়, বিজেপি বিরোধী দল। রাজস্থানে বিজেপি ক্ষমতায়, কংগ্রেস বিরোধী দল।

কেরালায় বামপন্থীরা ক্ষমতায়, কংগ্রেস বিরোধী দল। তামিলনাড়ুতে আন্না ডিএমকে ক্ষমতায়, ডিএমকে বিরোধী দল। অন্ধ্রে চন্দ্রবাবুর দল তেলেগু দেশম পার্টি সরকারি দল, কংগ্রেস বিরোধী দল। তেলেঙ্গানায় তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি ক্ষমতায়, কংগ্রেস বিরোধী দল। উড়িষ্যায় নবীন পাটনায়ক বিজুর বিজু জনতা দল ক্ষমতায়, কংগ্রেস বিরোধী দল। ঝাড়খণ্ডে জনমোর্চা ক্ষমতায়, কংগ্রেস বিরোধী দল। মধ্য প্রদেশে বিজেপি ক্ষমতায়, কংগ্রেস বিরোধী দল। হরিয়ানায় বিজেপি ক্ষমতায়, কংগ্রেস বিরোধী দল। কাশ্মিরে মেহবুবা মুফতি সাঈদ-এর জম্মু কাশ্মির পিপলস্ ডেমোক্রেটিক পার্টি ও বিজেপির যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আর ন্যাশনাল কনফারেন্স বিরোধী দল।

পাঠকের কাছে রাজ্য পর্যায়ে দলীয় অবস্থা অনুধাবনের জন্য বড় বড় রাজ্যের এই চিত্র তুলে ধরলাম। কেন্দ্রশাসিত ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরও কিছু রাজ্য রয়েছে। কেন্দ্রে বর্তমান বিজেপি ক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী আর কংগ্রেস বিরোধী দল। সোনিয়া গান্ধী বিরোধী দলীয় নেত্রী।

ভারতে অবাধে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে আসছে বহুদিন ধরে। শুধু ইন্দিরা গান্ধীর সময় গত শতাব্দীর ৭ দশকে একবার আর বর্তমান নরেন্দ্র মোদির সময়ে আরেকবার গণতন্ত্রের চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশকে শৃঙ্খলা শেখাতে একবার ইন্দিরা মানুষের স্বাধীনতা হরণ করতে চেয়েছিলেন।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জারি করা জরুরি অবস্থা বহাল থাকার পর তিনি পুনরায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। নির্বাচনও পিছিয়ে দিয়েছিলেন। জয় প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাই, অটল বিহারী বাজপেয়ী, চন্দ্র শেখর, চৌধুরী চরণ সিং এর মতো বড় বড় নেতাকে আটক করেছিলেন। যাক ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা হুস ফিরে পেয়ে লোকসভার নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন। ভারত পুনরায় তার গণতান্ত্রিক জীবন প্রবাহ ফিরে পেয়েছিলো।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে। পাঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে কংগ্রেস ও বিজেপি জিতেছে এবং তারা সরকার গঠন করেছে। কিন্তু ছোট দুইটি রাজ্য গোয়া ও মণিপুরে কোনও দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়নি। কিন্তু কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছিলো। নিয়ম অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দলকে সরকার গঠন করতে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে।

রাজ্যপাল তার আদেশে বলে থাকেন আপনারা সরকার গঠন করুন এবং এক মাসের মাঝে বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করুন। তখন তারা ছোট দলগুলোকে সঙ্গে নেওয়ার সুযোগ পায় এবং আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করে। এবার কিন্তু রাজ্যপালের আহ্বানকে উপেক্ষা করে বিজেপি ছোটদলগুলোকে নিয়ে গোয়া ও মণিপুরে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নেয় এবং রাজ্যপাল তাদেরকে সরকার গঠন করার অনুমতি দেন।

শাসনতন্ত্রের প্রক্রিয়াকে তারা উপেক্ষা করেছে। এটা রেওয়াজ বহিঃভূত ব্যবস্থা। ১৯৫২ সালে ভারতের শাসনতন্ত্র জারি হয়েছিলো আর গত ৬৫ বছরের মাঝে এই প্রথম নরেন্দ্র মোদি রেওয়াজ ভঙ্গ করলেন। অথচ বিজেপি ভারতে প্রথম ক্ষমতায় আসে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন বিজয়ী দল হিসেবে। অটল বিহারি বাজপেয়ী তখন প্রধানমন্ত্রী হন আর ১৪ দিন পর তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে না পারায় পদত্যাগ করেছিলেন।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী প্রোজেক্ট করে বিজেপি নির্বাচন করেছিলো। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ভারতের ধনবাদী গোষ্ঠীর প্রার্থী। আম্বানি আর টাটার নেতৃত্বে ৭/৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছিলো ধনবাদী গোষ্ঠী তাকে ও তার দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতিয়ে আনার জন্য। তারা সফলও হয়েছিলেন।

কংগ্রেস বহুবছর ভারত শাসন করেছে। তারা কখনও সমাজতন্ত্রী হয়ে মানুষকে কলের পুতুল করতে চায়নি আবার লাগামছাড়া ধনবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে দরিদ্র মানুষকে উপেক্ষাও করেনি। কংগ্রেসের এ ব্যবস্থাকে ধনবাদী গোষ্ঠী পছন্দ করেনি। তাই এই পরিবর্তনের উদ্যোগ।

ভারত আর চীন হিমালয়ের এপার আর ওপারের রাষ্ট্র। আয়তনে, লোক সংখ্যা, সম্পদে উভয় রাষ্ট্র প্রায় সমানে সমান। ভারতের মানুষ চেয়েছিলো ভারতও চীনের মতো আর্থিক উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাক। এই ভার যার হাতে দিলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব ভারতের মানুষ তাকে ক্ষমতা দিতে প্রস্তুত।

ভারতীয় অর্থনীতির গতি উঠেছে দেখে তারা মনমোহনকে দুই-দুইবার প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। মনমোহন সিং সে গতি অব্যাহত রাখতে পারেননি। সে দোষ কিন্তু মনমোহনের নয়। বহুদলের দুর্বল কোয়ালিশন সরকারই সে জন্য দায়ী। প্রায় ২০ বছর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনেই কোয়ালিশন সরকারের অবসান হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় শক্তিশালী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও নরেন্দ্র মোদি কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেননি।

২০১৯ সালের মার্চ মাসে আগামী লোকসভা নির্বাচন। এর মাঝে রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছে। আগামী দু’মাসের মধ্যে গুজরাট, হিমাচল আর ত্রিপুরা রাজ্যের নির্বাচন। গুজরাট বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে একটা। মহারাষ্ট্র ভেঙে গুজরাটের জন্ম। মহারাষ্ট্র গুজরাট পূর্ব থেকে শিল্প সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল।

গুজরাটের আহামদাবাদের বস্ত্র কলগুলো ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারের বস্ত্রকলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছে স্বাধীনতার আগে। গুজরাটে গান্ধী, পেটেল, মুহাম্মদ আলী জিন্নার জন্মভূমি। এই ডিসেম্বর মাসের ৯ এবং ১৪ তারিখ গুজরাট রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। ১৮ ডিসেম্বর ফলাফল ঘোষণা করা হবে। এই রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদি দুই-দুইবার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদির রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন খুবই উপভোগের ব্যাপার। কে জিতবে এ রাজ্যে- বিজেপি না কংগ্রেস? মিডিয়ার চোখ এখন গুজরাটে।

শিবসেনাও এ রাজ্যে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছে। লাগোয়া রাজ্য মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ক্ষমতায়। মোদির মন্ত্রিসভায়ও তাদের মন্ত্রী রয়েছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস খুব শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলো। সিট পেয়েছিলো মাত্র ৪৪টা।

১৯৭৭ সালেও কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিলো। কিন্তু তখন কংগ্রেসের মাঝি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তার বিরুদ্ধে গঠিত শাহ কমিশনের মঞ্চকে নিজের প্রচার মঞ্চে রূপান্তর করে ফেলেছিলেন। আজম গড়ের উপ-নির্বাচনে মহসিনা কিদওয়াইকে জিতিয়ে এনে আবার জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। চিকমাগালুর নির্বাচনে ইন্দিরা বিজয়ী হয়ে আসার পর তার আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮০ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন আর নির্বাচনে ৩৫৩ আসন লাভ করে পুনরায় ক্ষমতা দখল– সবই তো ছিল ম্যাজিক।

এবার কংগ্রেসের নেতৃত্বে আছেন রাহুল। মতিলাল, নেহরু, ইন্দিরা, রাজিব আর রাহুল। পাঁচ প্রজন্মে এসে রাহুল। বয়স কম। আচরণে মনে হয় গান্ধীবাদী মানুষ। গ্রামে গ্রামে যখন ঘুরে বেড়িয়েছেন, তখন দরিদ্রের ঘরেও ভাত খেয়েছেন। গুজরাট রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে ভালোভাবে নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন। কিছুদিন আগে মধ্য প্রদেশের এক উপ-নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী জিতেছেন। গত বছর গুজরাটের স্থানীয় নির্বাচনেও কংগ্রেস ভালো ফলাফল করেছিলো। মোদি এখন পর্যন্ত ৮টি জনসভা করেছেন আরও নাকি ২০/২২টা জনসভা করবেন। তার কপালের ভাঁজ দেখে মানুষ বলছেন মোদি শঙ্কিত হয়ে আছেন।

কংগ্রেসের তিন টেক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিন তরুণ তুর্কি– পাতিদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক প্যাটেল, অনগ্রসর ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের নেতা অল্পেশ ঠাকুর, আর দলিত আন্দোলনের মুখ জিগনেশ মেবানি। এরা গুজরাটের তরুণ তুর্কি। এরা কাজ করছে রাহুলের সঙ্গে। কেউ বলছে না বিজেপি জিতবে না, তবে সবাই বলছে– রাহুল এবার মোদিকে নিজ রাজ্যে হেনস্তা করে ছাড়ছে।

দিল্লি, এলাহাবাদ, বানারস বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন হয়েছে। বিজেপির বিদ্যার্থী পরিষদ কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের কাছে হেরে গেছে। কোনও কারণে গুজরাট যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তবে দিল্লির সিংহাসনও হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে আসবে– ২০১৯ সালের মার্চের লোকসভার নির্বাচন।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ