X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগ-বিএনপির সৌহার্দ্য কি আদৌ সম্ভব?

চিররঞ্জন সরকার
০৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৫৮আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:০০

চিররঞ্জন সরকার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে সরগরম হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। নড়েচড়ে বসছে ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল। নিজ নিজ কৌশলে ঘর গোছানোর পাশাপাশি জোর প্রস্তুতি চলছে ভোটযুদ্ধের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্য দলগুলো প্রার্থী বাছাই, ইশতেহার তৈরিসহ নির্বাচনের অন্যান্য কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে। নির্বাচনের হাওয়া কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলেও লেগেছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেও আগামী নির্বাচন নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। এছাড়া রোডম্যাপ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনও (ইসি) জাতীয় নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে। নিরপেক্ষতা প্রমাণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। এরই অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক সংলাপ করেছে ইসি। সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নির্বাচনি ঢাক বাজতে শুরু করেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
যদিও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা কাদা ছোড়াছুড়ি এখনও বিসর্জন দিতে পারেননি। একে অন্যকে হেয় করে, কটাক্ষ করে বক্তব্য প্রদানের ধারা এখনও চলছে। বিএনপিও এখনও স্থির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে পারেনি, তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে কিনা! বিএনপির শীর্ষ নেতারা কখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছেন, কখনও বলছেন যে, এই সরকারের অধীনে তারা কিছুতেই নির্বাচনে যাবেন না, কখনও সরকারকে ফেলে দেওয়ার কথা বলছেন, কখনও আবার নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি তুলছেন।

বিএনপির নেতারা আসলে এখনও বিভ্রান্তি থেকে বের হতে পারেনি। ওদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও প্রতিনিয়ত কটাক্ষ করে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই, ওরা ভোট পাবে না, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগেরই আবার জয় হবে–এ ধরনের কথা নিয়মিত বলা হচ্ছে। কোনও কোনও আওয়ামী লীগ নেতা বিএনপি নির্বাচনে আসবেন, নির্বাচনে আসা ছাড়া তাদের কোনও গতি নেই–এমন গ্যারান্টিও দিচ্ছেন!

রাজনীতিতে বর্তমানে প্রকাশ্য কোনও দ্বন্দ্ব-সংঘাত না থাকলেও, অস্বস্তি, অনিশ্চয়তা কিছুতেই কাটছে না। যা করলে রাজনৈতিক বিরোধ কমতে পারে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে–তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। বরং সারাক্ষণ একটা কী হয়/কী হয় পরিস্থিতি দেশবাসীকে তাড়া করে ফিরছে।

যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে বিরোধী দল নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনি প্রচারণায় নামবে, সরকারের ভুল-ত্রুটি বা ব্যর্থতা তুলে ধরে ভোটারের মন জয় করার চেষ্টা করবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশে সুস্থ-স্বাভাবিক কোনও কিছুই যেন ঘটতে চায় না, ঘটতে দেওয়া হয় না। এখানে সরকার পরিবর্তনে ‘মোটামুটি গণতান্ত্রিক’ ধারা চলছে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু আমরা গণতান্ত্রিক চর্চা বা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পথে খুব একটা এগুতে পেরেছি বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো তবু কিছু গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করে, কিন্তু সাধারণ মানুষের অধিকার দিন দিন খর্ব হচ্ছে।

বর্তমানে বিএনপি চাচ্ছে ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতায় যেতে, আর আওয়ামী লীগ চাচ্ছে যে কোনও মূল্যে ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে ধরে রাখতে। যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা আর যে কোনও মূল্যে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রয়াস—দুটিই বিপজ্জনক। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে দেশকে ফেরাতে পারে কেবল বিএনপি-আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের শুভবুদ্ধি। সেখানেও অনেক ঝামেলা রয়েছে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে পাস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারেও একশ্রেণির মানুষ হতাশা ব্যক্ত করেন। দেশের উন্নতির জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বর্তমান ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্কের পরিবর্তে সৌহার্দ্য-প্রীতি ও সহযোগিতার সম্পর্ক অনিবার্য বলেও তারা মত পোষণ করনে। যারা এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা করেন তাদের ভাবুক, কল্পনাবিলাসী, দেশহিতৈষী যাই বলা হোক না কেন, বাস্তববাদী বলা যাবে না। তাদের কেন বাস্তববাদী বলা যাবে না, এ ব্যাপারে একটু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। প্রথমে আসা যাক বিএনপি-আওয়ামী লীগের ‘অপরিবির্তনীয়’ রাজনীতি প্রসঙ্গে। জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই স্টাইলে রাজনীতি করছে। প্রতিষ্ঠার পর এই দল দুটির নীতি, আদর্শ, ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র, কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। নীতি-কর্মসূচিতে যেমন উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন নেই, নেতৃত্ব নির্বাচনের ধারা, কর্মী সংগ্রহ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তেমন কোনও পরিবর্তন নেই। বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য অবশ্যই আছে। কিন্তু দুই দলের পথ চলা, কথা বলা প্রায় একই রকম।

বিএনপিতে একবার যিনি নেতা নির্বাচিত হন যুগ যুগ ধরেই তিনি নেতা। দেহত্যাগ কিংবা দলত্যাগ না করলে নেতৃত্ব খারিজ হয় না। আওয়ামী লীগেও প্রায় একই ধারা। ঈশ্বর তুলে না নিলে নেতৃত্ব থেকে অবসর নেওয়া হয় না। দলের শীর্ষপদ আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিতে এখনও উত্তরাধিকার সূত্রে দখল বা বদল হয়। যেখানে একই নেতা-নেত্রীরা যুগ যুগ ধরে দলের নেতৃত্বে আসীন, সেখানে কোনোরকম ইতিবাচক পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব? সেই একই শেখ হাসিনা, একই খালেদা জিয়া, যারা বছরের পর বছর ধরে দলের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে শীর্ষপদে আছেন, তারা যদি যুগের পর যুগ এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দীও নেতৃত্বে থাকেন, তাহলে আমরা কি পরিবর্তন আশা করতে পারি? একই মুরগির কাছে বিভিন্নরকম ডিম আশা করা যায় না। সে মুরগি যত বছর ধরেই ডিম উপহার দিক না কেন। কাজেই হাসিনা-খালেদা বা আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাছে নতুন কিছু আশা করাটা বোকামি। একই স্টাইলের একই ধরনের নেতৃত্বের আওতায় থাকলে কোনও পরিবর্তন আশা করা যায় না।

আওয়ামী লীগের স্বভাব এবং বিএনপির বৈশিষ্ট্য পরস্পরকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, এখন এই দুই দলের মধ্যে বৈরিতা ও সংঘাত ছাড়া অন্য কোনও কিছুর বাস্তবতা খুব একটা নেই। এই দল দুটি একে অপরের এমন ক্ষতি করেছে বা এমন ক্ষত সৃষ্টি করেছে যে, এখন আর শত্রুতা ছাড়া তাদের মধ্যে বন্ধুতা প্রায় অসম্ভব। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সঙ্গে বিএনপি প্রতিষ্ঠা জেনারেল জিয়ার ঘনিষ্ঠতা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টায় বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের ভূমিকা বিএনপিকে আওয়ামী লীগেরেএক নম্বর শত্রুতে পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের নামে মামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগকে প্রধান শত্রু মনে করে বিএনপি!

এমন একে অপরের প্রতি বৈরী দুটি দলের মধ্যে সদ্ভাব কিভাবে সম্ভব?

এ ব্যাপারে একটি প্রাচীন গল্প মনে করা যেতে পারে।

এক পাড়াগাঁয়ে ছেলেকে নিয়ে এক বাবা থাকতেন। বাড়ির পাশে একটি গর্তের মধ্যে একটি সাপও থাকত। একদিন লোকটির ছেলেকে ওই সাপটি কামড়াল। ফলে ছেলেটি মারা গেলো। ছেলেটির বাবা তখন রাগের বশে একটি কুড়াল হাতে বসল সেই সাপের গর্তের ধারে। বেরুলেই সাপটাকে খতম করে দেবে। কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করার পর লোকটি দেখতে পেলো সাপটা মাথা বের করছে। লোকটি অমনি জোরে একটা কোপ মারল। কিন্তু কোপটা সাপের মাথায় না লেগে লাগলো একটা পাথরের ওপর। আর পাথরটা গেলো ফেটে। এবার লোকটি মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেলো। সে সাপটাকে মারতে গিয়েছিল, কিন্তু সাপ মরেনি। ফলে সাপটি নিশ্চয়ই তার ওপর রেগে রয়েছে। যে কোনও সময় সাপটি তাকেও কামড়াতে পারে। এসব ভেবে লোকটি সাপের সঙ্গে ভাব করতে গেলো। বুদ্ধিমান সাপ তাতে রাজি হলো না। সে বলল, আমাদের দু’জনের ভাব হওয়া অসম্ভব। পাথরের ওই ফাটা জায়গাটা দেখলেই আমার মনে পড়বে তুমি আমায় কী করতে চেয়েছিলে। আর তোমার ছেলের কবরের দিকে নজর পড়লেই তোমার মনে পড়বে আমি তোমার কী করেছি। এমন দু’জনের কী ভাব হতে পারে?

যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সব বিরোধ মিটিয়ে ফেলে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তারা এই অমোচনীয় ‘ক্ষত’ সারাবেন কিভাবে? আর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ’ ছাড়া দেশের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা কাটবেইবা কিভাবে?

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ