X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপ ফুটবল, আসছে বিনিদ্র রজনী

দাউদ হায়দার
০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:১৭আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:১৯

দাউদ হায়দার ‘নেই তাই খাচ্ছো। থাকলে?’
-ছড়াতাম।
‘তারপর?’
-হাপিত্যেশ।
গল্পটি তারাপদ রায়ের। বিষয়বস্তু ফুটবল। তবে এই খেলার সঙ্গে গল্পটির সম্পর্ক কী তা এখনও অনাবিষ্কৃত। ওঁকে জিজ্ঞেস করলে সংক্ষিপ্ত উত্তর— ‘ঘটনা আরও আছে’। কী সেই ‘আরও’, রহস্যের জট খোলেননি কখনও।

ষাটের দশকের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগের একজন অধ্যাপক ছিলেন। ঢাকাইয়া কুট্টি। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করে বেঠিক শুনলে তিনি বলতেন— ‘অ্যালায় বোজো’ (এখন বোঝো)।

তারাপদ রায়ের উত্তরে কী বুঝলাম তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আসছে বিনিদ্র রজনী। আসছে বিশ্বকাপ ফুটবল (২০১৮ সালের ১৪ জুন থেকে শুরু হবে রাশিয়ার মস্কোতে)। এই টুর্নামেন্ট নিয়ে উৎকণ্ঠা বোধ হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি। তবে সব দেশের খেলা নিয়ে নয়।

বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলের যোজন-যোজন সীমানার মধ্যেও নেই। কিন্তু চেঁচামেচি, আস্ফালন, উন্মাদনা, রেষারেষি, এমনকি দুই দলের সমর্থকদের মারামারি চোখে পড়ার মতো। প্রিয় দল হেরে গেলে কান্নাকাটি করে নাওয়া-খাওয়া বাদ দেয় অনেকে। কেউ কেউ আত্মহত্যাও করে। ব্যাপারটা যেন এমন— ‘ফুটবল ছাড়া এ জীবন তুচ্ছ, রাখিব না আর।’

এই প্রেম, এই পাগলামি রাজনীতি নয়। বাংলাদেশ এমন এক দেশ, যেখানকার মানুষ অন্য দুই দেশের সমর্থনে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক দেশ ব্রাজিল, এক দেশ আর্জেন্টিনা। দুই দেশের পতাকায় ছেয়ে যায় বাংলাদেশের নানা জেলা, অঞ্চল, প্রান্তর। মনে হতে পারে বাংলাদেশ হয় ব্রাজিল, না হয় আর্জেন্টিনা।

প্রায় শতাধিক বছর আগে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলাদেশ (অখণ্ড) নিয়ে লিখেছিলেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’ কি মোক্ষম কথাই না লিখেছিলেন কবি। ফুটবলকে ঘিরে অন্য দেশ নিয়ে মাতামাতিতে হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছি, এমন দেশ কোথাও খুঁজে পাবো না এই ব্রহ্মাণ্ডে!

সত্যি বলতে কোনও একটা উপলক্ষ্য পেলে বাংলাদেশের মানুষ তাতে মেতে ওঠেন। তাদের শুধু উপলক্ষ্য চাই। এর কারণ তাদের জীবন নিরানন্দ। সামাজিক-রাজনৈতিক টানাপড়েনে দিশাহারা। নিরাপত্তা নেই কোথাও। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নাগালের বাইরে। বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি তো আছেই। খাবারেও ফরমালিন। এখানে কোথাও ১৫ মিনিটের পথ যেতে লাগে তিন ঘণ্টা। বাতাস দূষিত, বিষে ভরা। সব মিলিয়ে পদে পদে ঝুঁকি আর  মৃত্যুর আশঙ্কা।

মানুষ ছুটছে কাজের সন্ধানে, কাজ নেই। খাদ্যেও ঘাটতি। চিকিৎসা অস্বাস্থ্যকর। ওষুধ উধাও। চিকিৎসকও ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইদানীং রোহিঙ্গাদের ঘিরে দেশ, সমাজ ও জনজীবনে  তৈরি হয়েছে সংকট। অন্যদিকে ধর্মের নামে উগ্র মৌলবাদীতা, ধর্ষণ, রাহাজানি, আর্থিক ধসের চিত্রও বড় ধরনের সমস্যা। বলা যায় এ এক বিপন্নতার সমারোহ।

গত এপ্রিলে বার্লিনের ডাকসাইটে দৈনিক ‘ডি টাৎস’ পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে বাংলাদেশের দুরবস্থার একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। পড়ে আঁতকে উঠি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত গার্মেন্টস, বিদেশ থেকে পাঠানো সাহায্য ও বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ যদি বন্ধ হয়, পদ্মা সেতুও লাটে উঠবে।

রামপাল-সুন্দরবন নিয়ে যা হচ্ছে তাতে খুশি নয় ইউরোপ। জার্মানি তো নয়ই। ইউরোপের পরিবেশবাদীরা ক্রমশ কঠোর হচ্ছেন। সবুজ দলগুলো (গ্রিন পার্টি) ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টকে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বার্তা দিয়েছে। তাতে নড়েচড়ে বসেছে জার্মানি।

ডি টাৎস (দৈনিক পত্রিকা) সবসময়ই প্রকৃতি পরিবেশ সংরক্ষণে সোচ্চার। জার্মান রাজনীতিতেও প্রভাবশালী। তারা লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার চার দশক পরেও বাংলাদেশ দিশাহীন। স্থির লক্ষ্য কী, কোথায় পৌঁছাবে, রাজনীতি-ব্যবসা-বাণিজ্যে, এর হদিস পাওয়া দুষ্কর। অবশ্য একশ্রেণি (ধনী-ব্যবসায়ী) দেশের চেয়ে বিদেশমুখী।’

পত্রিকাটি একথাও লিখেছে, “বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত আর নিম্নবর্গের মানুষ স্বদেশেই আস্থাশীল। ‘বাংলাদেশের মানুষ আবহমান কালচারে গরীয়ান’ (খুশি কবির বলেছেন। রিপোর্টে তার নাম উল্লেখিত)। বাংলা নববর্ষের কার্নিভাল চোখ ধাঁধায়। ধর্মাধর্ম নেই। সব মানুষের মিলন।”

এই রিপোর্ট পড়ে আন্দোলিত হয়েছি। রিপোর্টার বোধ হয় বাংলা নববর্ষের পয়লা বৈশাখই দেখেছেন। অন্য ‘উৎসব’ নয়। বলছিলাম ‘উপলক্ষের’ কথা। ধর্মীয় উপলক্ষ্য নয়। রাজনীতির উপলক্ষ্য নয় (যদিও সব ‘উপলক্ষেই’ রাজনীতি ও ধর্মের গন্ধ পাওয়া যায়। ধর্মান্ধদের ফতোয়া অনুযায়ী, পয়লা বৈশাখ-নববর্ষ নাকি ইসলামি নয়)।

পয়লা বৈশাখ এখন প্রাণের উৎসব। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ উপলক্ষে মাসব্যাপী গ্রন্থমেলায় বইয়ের উৎসব হয়। বিস্তর নতুন লেখকের মুখ আর  নতুন বইয়ে ভরপুর হয়ে যায় তল্লাট (বইমেলার প্রাঙ্গণ)।

উৎসবের রকমফের আছে। আছে সামাজিকতা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি। উৎসব যদি সংঘবদ্ধ হয়, ফেলনা নয় কিছুতেই। সংঘবদ্ধ সংস্কৃতির ঘরানার মানুষ ও দেশ সমবেত হয়। বিশ্বকাপ ফুটবলও কি? হ্যাঁ। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের (হয়তো প্রত্যেকে নয়) যে মানসিক এক্কাদোক্কা ও বিনিদ্র রজনীর বিন্যাস তা এক ধরনের উৎসবও। তারা এই খেলা দেখবে রাত জেগে, মহাআনন্দে। যেন খেলাই জীবন,উৎসব।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ