X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরি মহামান্য পোপ

প্রভাষ আমিন
০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৩০আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৩২

প্রভাষ আমিন দ্বিতীয় পোপ হিসেবে বাংলাদেশ মাতিয়ে গেলেন ফ্রান্সিস। এর আগে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন পোপ দ্বিতীয় জন পল। আরেকটু পিছিয়ে গেলে ১৯৭০ সালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সফর করেছিলেন পোপ ষষ্ঠ পল। খ্রিস্টান ক্যাথলিকদের ধর্মগুরু পোপ বিশ্বজুড়েই সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয়। বাংলাদেশে খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু। কিন্তু পোপকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে বাংলাদেশ। তিনদিনের সফরে পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। অংশ নিয়েছেন একাধিক প্রার্থনা সভায়, কথা বলেছেন তরুণদের সঙ্গে। এমনকি তার সঙ্গে কথা বলতে টেকনাফ থেকে ছুটে এসেছিল রোহিঙ্গাদের ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলও। পোপ ফ্রান্সিস অনেক জায়গায় গিয়েছেন, কিন্তু টেকনাফে উড়ে যাওয়ার সময় পাননি। টেকনাফের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের বিপর্যস্ত জীবনের গল্প ঢাকায় শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ১৬ জনের সঙ্গে কথা বলে  ঠিক বোঝা সম্ভব নয়। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে অসহায় দেশহীন একটি জাতির এত কাছে এসে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং সম্মানিত ধর্মযাজক তাদের দুর্দশা স্বচক্ষে না দেখে ফিরে গেছেন; এটা আমাকে বেদনার্ত করেছে।
এমনিতে পোপের সফরের কোনও রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক তাৎপর্য নেই। পুরো ব্যাপারটাই সম্মান, মর্যাদা আর নৈতিকতার। তার গুরুত্ব যতটা পার্থিব, ততটাই আধ্যাত্মিক। তাই কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও পোপের সফর ছিল হাই প্রোফাইল। পোপের সফরের তিনদিন ঢাকা প্রায় থমকে গিয়েছিল। এতকিছুর পরও পোপের সফর নিয়ে বাড়তি কৌতূহল তৈরি হয়েছিল এই রোহিঙ্গা ইস্যুতেই। কারণ তিনি বাংলাদেশে আসার আগে মিয়ানমার হয়ে এসেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সমস্যার উৎপত্তিস্থল এবং বর্তমান আবাসস্থলে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত ধর্মগুরুর সফরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন মানবতাবাদী অনেকেই। পোপ এসে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন, এমন প্রত্যাশা আমার ছিল না। যেখানে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানারকম কূটনৈতিক চাপ, অবরোধের হুমকি দিয়েও টলাতে পারছে না নিষ্ঠুর মিয়ানমারকে। সেখানে পোপ শান্তি আর সম্প্রীতির কথা বললেই তারা সোজা হয়ে যাবে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে, এমন আশা করা আসলেই ভুল। কিন্তু পোপের সফর রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় রকমের নৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারতো। কিন্তু গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, চাপ সৃষ্টি তো দূরের কথা পোপ ফ্রান্সিস নিজের নৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতেই দারুণ ব্যর্থ হয়েছেন। বিশপ সম্মিলনির পরামর্শে মিয়ানমার সফরকালে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। এমনকি বাংলাদেশ সফরেও অধিকাংশ কর্মসূচিতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি এড়িয়ে গেছেন। যদিও সফরের প্রথম দিনেই বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রাখাইন থেকে আসা শরণার্থীদের পাশে থাকার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। প্রশংসা করেছেন বাংলাদেশের ভূমিকারও। কিন্তু ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি এড়িয়ে যাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এত চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি পোপের। সফরের দ্বিতীয় দিনে ১৬ সদস্যের এক রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভেঙে যায় তার নিয়ন্ত্রণের বাধ। তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাদের জন্য প্রার্থনা করেন। নির্ধারিত স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের যন্ত্রণা যে কতটা দুর্বিষহ সেটা আমরা বুঝতে পারছি। আমরা সবাই শান্তি চাই। যেখানে অশান্তি রয়েছে, সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমরা কাজ করছি। এই রোহিঙ্গাদের মাঝেও আজ ঈশ্বরের উপস্থিতি পাওয়া যায়। যারা আপনাদের অত্যাচার করেছে, কষ্ট দিয়েছে তাদের এবং আপনাদের দুর্দশার প্রতি বিশ্ববাসীর নির্লিপ্ততার জন্য সবার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইছি। আপনার বিশাল মনের পরিচয় দিয়ে আমাদের ক্ষমা করে দিন।’ সুমন চট্টোপাধ্যায়ের একটি গান আছে, ‘খাতা দেখে গান গেওনা, উল্টে পাতা যেতও পারে।’ পোপও তার মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফরে খাতা দেখে গান গাইতে গিয়েই যত ঝামেলা পাকিয়েছিলেন। যেই রোহিঙ্গাদের বেদনার প্রবল বাতাস এসে উল্টে দিল তার খাতা, তখনই বেরিয়ে এলেন আসল পোপ। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি, তিনি ক্ষমা চাইলেন। মিয়ানমার ও বাংলাদেশে এক সপ্তাহের সফরের নির্ধারিত সময়ের বাইরের সেই ২০ মিনিট সময়েই আমরা পেলাম পোপের মতো পোপকে, যিনি কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে ‘রোহিঙ্গা’দের বেদনাকে ছুঁতে চেয়েছেন, নিজের শক্ত নৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন।

‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করে যেমন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন পোপ, উচ্চারণ করেও পড়েছেন। দুদিন আগে যারা পোপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল, এখন সেই মিয়ানমারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার সমালোচনায় সোচ্চার। তারা তাকে ‘দালাল’, ‘সেলসম্যান’– বলে কটাক্ষ করেছেন। তারা বলছেন, পোপ রঙ বদল করেছেন।

বিশ্বের কারো পক্ষেই সবার মন জুগিয়ে চলা সম্ভব না। নিরপেক্ষতা বলেও আসলে কোনও বিষয় নেই। নিক্তি মেপে আপনি নিরপেক্ষ হতে পারবেন না। এই যেমন পোপ ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি না বলে একবার সমালোচনার মুখে পড়লেন, আরেকবার পড়লেন শব্দটি বলে। আসলে আপনাকে দাঁড়াতে হবে ন্যায্যতার পক্ষে। তাতে কে, কী বললো; তাতে আপনার কিছু যাওয়া আসা উচিত নয়।

পোপ যদি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মন পাবেন বা সমস্যার সমাধান করবেন বলে আশা করে থাকেন; তাহলে সেটা বড় একটা ভুল। জোড়াতালি দিয়ে যেমন সমস্যার সমাধান হয় না বা কারপেটের নিচে ময়লা রেখে যেমন বাসা পরিষ্কার হয় না; তেমনি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেও সমস্যার ন্যায্য সমাধান সম্ভব নয়। একটা বিষয় পোপকে বুঝতে হবেই, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি বলা না বলায় আকাশ-পাতাল ফারাক। ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয় ভুলে যেতে পারলে এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো হয়তো মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পেয়ে যেতে পারতো। কিন্তু মানুষের কাছে আত্মমর্যাদা, জাতি পরিচয়টা অনেক বড়। একটা গোটা জাতিকে আপনি নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবেন, কিন্তু পরাজিত করতে পারবেন না। চাকমা, মারমা, গারোরা যেমন কখনও বাঙালি হবে না; তেমনি রোহিঙ্গারাও কখনও বর্মি হবে না। শেষ রোহিঙ্গা মানুষটিও ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবেই মরতে চাইবে। তাই তাদের আসল বেদনাটা বুঝতে হলে, তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে।

বাংলাদেশ থেকে ভ্যাটিকানে ফিরে যাওয়ার সময় বিমানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পোপ তার সফরে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আলোচনার পথ বন্ধ না করতেই তিনি এই কৌশল নিয়েছেন। তার ধারণা, এর কারণেই তিনি মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক উভয় নেতৃত্বের কাছেই নিজের বার্তাটি তুলে ধরতে পেরেছেন।

দুঃখিত মহামান্য পোপ, আপনার এই কৌশলের সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। আপনি পোপ, বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত ধর্মগুরু। আপনি ডিপ্লোম্যাট নন। আপনি তাই করবেন, অন্তত তাই করা উচিত; যা আপনার হৃদয় বলবে, আপনার বিবেক বলবে। আপনি তো রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের মধ্যস্ততা করতে আসেননি। আপনি এসেছেন সম্প্রীতি ও শান্তির বার্তা নিয়ে; এসেছেন ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে। কে, কী বললো না বললো; তা দিয়ে তো আপনি আপনার অবস্থান নির্ধারণ করবেন না। যদি আপনি ‘রোহিঙ্গা’দের অবস্থানকে সমর্থন না করতেন; তাহলে আমার তর্ক অন্য হতো। কিন্তু আপনার বিভিন্ন বক্তব্যে এবং সেই ২০ মিনিটের প্রাণখোলা বিবেকের অবস্থানে বুঝিয়ে দিয়েছেন; বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের বেদনা আপনাকে ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু মিয়ানমারের নিষেধাজ্ঞায় আপনার বিবেক বাধা ছিল। আমার আপত্তিটা এখানেই। পোপও যদি নিজের বিবেকের কথাটি স্বাধীনভাবে বলতে না পারেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় শক্ত নৈতিক অবস্থান নিতে না পারেন; তাহলে বিশ্ব মানবতা কোথায় আশ্রয় খুঁজবে?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ