X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ডাকসু’ হলেই দেশ বদলে যাবে?

আমীন আল রশীদ
০৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:১২আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:১৮

 

আমীন আল রশীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন করছেন এই প্রতিষ্ঠানেরই একজন শিক্ষার্থী। যে কাজটি করার কথা ছিল কোনও রাজনৈতিক দলের, তা করছেন একজন সাধারণ ছাত্র। তার নাম ওয়ালিদ আশরাফ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকেই এই কর্মসূচিকে স্বাগত জানিয়েছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ডাকসু নির্বাচন হলেই কি ছাত্ররাজনীতি বা ছাত্র আন্দোলনের চেহারা বদলে যাবে কিংবা দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে অথবা দেশ কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। আশি ও নব্বই দশকে যারা এখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অনেকেই এখন দেশে-বিদেশে খ্যাতিমান। অনেকে কুখ্যাতিও অর্জন করেছিলেন এবং পরবর্তীতে দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন। অর্থাৎ দেশের সবেচেয় মর্যাদাশালী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নেতৃত্বের দীক্ষা নিয়ে সেই ‘শিক্ষা’ অনেকেই কাজে লাগিয়েছেন দেশ ও মানুষের বিরুদ্ধে। এরকম অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। ফলে ডাকসু নির্বাচন হলেই যে তরুণ সমাজ খুব দেশপ্রেমিক নেতা হয়ে উঠবেন, সেই উপসংহারে পৌঁছানোর সুযোগ নেই।
আমাদের ছাত্র-রাজনীতির গৌরবময় ভূমিকা ছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, গণঅভ্যূত্থান এবং এর ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে। ছাত্র-রাজনীতির পথ বেয়েই দূর মফস্বলের একজন শেখ মুজিবুর রহমান একসময় বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতায় পরিণত হয়েছিলেন। ছাত্র-রাজনীতির পথ বেয়েই তৈরি হয়েছিলেন একজন তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরীসহ তাঁদের সম-সাময়িক অনেক নেতা––যারা একসময় ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় ছিলেন। কেননা, তাদের ছিল মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট। ছাত্র অবস্থায়ই বাড়ি-গাড়ি করে ফেলতে হবে, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়তে হবে, হেলিকপ্টারে চড়ে বাড়ি কিংবা কোনও জেলার কাউন্সিলে যেতে হবে–এসব তাদের দূরস্বপ্নেও ছিল না। তাদের সামনে লক্ষ্য ছিল স্থির; দেশকে মুক্ত করা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার সম্ভবত এক দশক পর থেকেই এই লক্ষ্য বিচ্যুত হতে থাকে।

অন্তত এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্য‌ন্ত ছাত্র-রাজনীতির একটা স্থির লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এরপরে ১৯৯১ সালে দেশে কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ছাত্ররাজনীতির মধ্যে ভোগবাদিতা আর প্রতিপক্ষ দমনে নৃশংসতা এতটাই তীব্র হয়ে উঠতে থাকে যে, সাধারণ মানুষের মনে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে একটা ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। পরিবারের কোনও সন্তান ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তাকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের তাণ্ডব (বিশেষ করে রগ কাটা) ছাত্র-রাজনীতির সম্পর্কে মানুষের মনে প্রবল ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি করে।

সেই ঘৃণা, বিদ্বেষ, ভীতি ও আতঙ্কের কারণেই ছাত্র-রাজনীতির পক্ষে কোনও জনমত নেই। এটা হলফ করে বলা যায় যে, যদি সংবিধান সংশোধন করে দেশে ছাত্ররাজনীতির ইস্যুতে একটা গণভোটের আয়োজন করা হয়, তাহলে এর পক্ষে তিরিশ শতাংশ ভোটও পড়বে না। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের অধিকাংশই চায় না শিক্ষার্থীরা ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে জড়াক। অথচ ছাত্রদের কারণেই আমরা আমাদের ভাষার অধিকার পেয়েছি, স্বাধীনতা সংগ্রাম ত্বরান্বিত হয়েছে। কারণ ওই সময়ে শব্দটি ছিল ছাত্র আন্দোলন।

দেশ ও মানুষের স্বার্থে ওই সময়ে ছাত্ররা রাজপথে নেমেছিলেন একটা কমিটমেন্ট থেকে এবং এরপরে যখন ছাত্র আন্দোলন শব্দটা ছাত্র-রাজনীতিতে রূপান্তরিত হলো, বলা যায় তখন থেকেই এই প্রপঞ্চটি বিচ্যুত হতে থাকে। মানুষের আগ্রহ হারাতে থাকে। ক্লাসের মেধাবীদের বদলে ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব চলে যেতে থাকে ‘মাসলম্যান’, মাস্তান আর অসৎ লোকদের হাতে; যা ধীরে ধীরে ছাত্র-রাজনীতির সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিদ্বেষ বিস্তৃত করেছে।

ছাত্র-রাজনীতির নামে সবশেষ নৃশংসতার শিকার শরীয়তপুরের বিশ্বজিত যিনি পুরান ঢাকার একটি দর্জি দোকানে কাজ করতেন। প্রকাশ্য দিবালোকে, গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে কীভাবে ওই তরুণকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পরে কোনও সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে কি ছাত্র-রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে?

অনেকে বলবেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বাস্তবতা হলো, এগুলোই এখন কথিত ছাত্ররাজনীতির ট্রেন্ড। বরং কোনও ছাত্রসংগঠন যদি স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি কিংবা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, সেটিই এখন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে বিবেচিত হচ্ছে।

এখন যেকোনও জেলা শহরে পা রাখলে প্রথমেই যে দৃশ্যটি চোখে পড়ে তা হলো, বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা এই বয়সী তরুণদের ছবিসম্বলিত পোস্টার যেখানে নানাবিধ শুভেচ্ছাবাণী। আওয়ামী লীগের নেতা হলে পোস্টারে বঙ্গবন্ধুর ছবি, আর বিএনপির হলে সেখানে জিয়ার ছবি। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন অনেক তরুণ-যুবকের ছবি বঙ্গবন্ধুর ছবির নিচে দেখি যা দেখে আমারই লজ্জা হয়। কারা এই প্রজন্ম? কী তাদের পরিচয়? অনেকের পরিচয় দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই। কিন্তু তারপরও তারা নেতা। তারাই একসময় জনপ্রতিনিধি হবে। দেশের নেতৃত্ব দেবে।

সুতরাং গত প্রায় তিন দশক ধরে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না বলে ওয়ালিদ আশরাফ নামে যে যুবক অনশন করছেন, তার সদিচ্ছা নিয়ে আমাদের কোনও প্রশ্ন বা সংশয় নেই। তিনি হয়তো ক্যাম্পাসে একটা সুস্থ রাজনীতির চর্চা এবং এর মধ্য দিয়ে আগামীর নেতৃত্ব তৈরি হোক, সেটিই চান; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চোখের সামনে আমরা ছাত্রনেতা পরিচয়ে এমন অনেকের কর্মকাণ্ড দেখি, যা আমাদের ভীত করে। এই সময়ে যারা ছাত্রনেতা বলে পরিচিত, তাদের কয়জনকে আমরা আদর্শ বলে মনে করতে পারি? কেউ কি পাঁচটি নাম বলবেন?

আরেকটা প্রশ্ন, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ ছিল, তখন কি দেশের রাজনীতিতে অনেক বেশি সুস্থ প্রতিযোগিতা চলতো? তখন কি ভিন্নমতের প্রতি দলগুলোর শ্রদ্ধা ছিল? তখন কি ছাত্রনেতারা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ছিলেন? তখন কি ছাত্রসংসদে গণতান্ত্রিক উপায়েই প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো? দলের হাইকমান্ড কি সেখানে হস্তক্ষেপ করেনি? খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতর কি ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করেনি? যদি তাই হয় তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনের যারা দাবি তুলছেন, তারা কি নিশ্চিত যে, এখানে আসলেই গণতন্ত্রিকক উপায়ে নির্বাচন হবে এবং প্রকৃত মেধাবী, দেশপ্রেমের উদ্বুদ্ধরাই নেতৃত্বে আসবেন এবং তারা ভবিষ্যত বাংলাদেশর বিনির্মাণের দায়িত্ব নেবেন? যদি না হয়, তাহলে এই নির্বাচনের পক্ষে বলে আমরা কার পক্ষ অবলম্বন করছি?

যদি রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদেরকে প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ না করে, যদি ছাত্রদের মধ্যে ভোগবাদিতা প্রবল হতে থাকে, যদি মেধাবীদের রাজনীতিতে আসার মতো পরিবেশ তৈরি না হয়, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আমি শুধু ডাকসু নির্বাচনের বিপক্ষেই নই, বরং সমস্ত ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আইন করে বন্ধ করার পক্ষে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা যতক্ষণ না গণতন্ত্রের চর্চা করতে প্রস্তুত হয়, ততক্ষণ তাদের ছায়াতলে কোনও সুস্থ ছাত্র-রাজনীতির চর্চা হবে না। সেই ছাত্র-রাজনীতির মাধ্যমে অনেক ধনশালী তরুণ-যুবক তৈরি হবে ঠিক, দেশের কোনও মঙ্গল হবে না।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ