X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপাত্রে ঘি ঢালেন না প্রধানমন্ত্রী

বিভুরঞ্জন সরকার
১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:০৮আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:৪১

বিভুরঞ্জন সরকার লিখতে বসে বিষয় ঠিক করতে একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফরহাদ মজহারকে নিয়ে লিখবো, নাকি ডাকসু নির্বাচন নিয়ে? কবি-প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার অপহরণের ছয় মাস পর তিনি মুখ খুলেছেন। তার অপহরণ নিয়ে যে নাটকীয়তা তৈরি হয়েছিল তা অব্যাহত আছে। পুলিশ বলছে, তাকে কেউ অপহরণ বা গুম করেনি, তিনি নিজেই ঘর ছেড়েছিলেন। এতদিন পরে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছেন, আদালতে পুলিশের লিখে দেওয়া জবানবন্দিতেই তিনি সই করে দিয়েছেন। এতদিন পর তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি কেন প্রকাশ করলেন, সে প্রশ্ন উঠছে। ফরহাদ মজহারের নিখোঁজের রহস্য ভেদ করা এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফরজ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ওয়ালিদ আশরাফ নামের একজন শিক্ষার্থী টানা দুই সপ্তাহ অনশন করে। ওই শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্বাচনের ‘আশ্বাস’ আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। ডাকসু নির্বাচন হয় না ২৭ বছর ধরে। কেন এই নির্বাচনে কর্তৃপক্ষের অনীহা তা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারে, বলে মনে হয় না। তবে ডাকসু নির্বাচন আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এটা নিয়ে লেখা যেতেই পারে।

এসব যখন ভাবছি, তখন এক বন্ধু আবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য নিয়ে কিছু লেখার জন্য তাগাদা দিয়ে সব গুবলেট পাকিয়ে দিলো। তাই লেখাটা একদিকেই ঝুঁকে পড়লো। জানি না, পাঠক একে ফাঁকিবাজি ভাববেন কিনা! ভাবলেও কিছু করার নেই। যা দিনকাল পড়েছে, তাতে লেখালেখি করাটা বোধ হয় ছেড়েই দিতে হবে। কী লিখতে কী লিখবো, কার আঁতে ঘা লাগবে, আর তার পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার যেহেতু ঠিকঠিকানা নেই, তাই জান বাঁচানো ফরজনীতি মনে চলাই ভালো। কেউ হয়তো বলবেন, ভয় পেয়েছেন তো? দেখেন, আপনার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায় আর আপনি কিনা মন খুলে লিখতে ভয় পাচ্ছেন? তা এটা অকপটে স্বীকার করতে আমার অন্তত দ্বিধা নেই যে, বরাবরই আমি একটু ভিতু প্রকৃতির মানুষ। খামোখা বিপদ ডেকে আনাতে আমার কোনও সময়ই ইচ্ছা হয় না। কখনোই মত-প্রকাশের ব্যাপারে আমি খুব বিপ্লবীপনা করি না। তবে হ্যাঁ, এরশাদের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে রাজনৈতিক প্রতিবেদন লেখার সময়, কিছুটা হাত খুলে লিখতাম। বয়স কম থাকায় ভয়ডরও হয়তো একটু কম ছিল। সব থেকে বড় কথা, তখন মনে এই জোরটা ছিল যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এরশাদ থাকলেও তার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত আছে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এরশাদবিরোধী ভাবনার ঐক্য ছিল। কোনও বিপদে পড়লে দলমত নির্বিশেষে সবাই আমার পেছনে দাঁড়াবে।


এখন পরিস্থতি একেবারেই ভিন্ন। কোনও প্রশ্নেই এখন আর জাতীয় ঐকমত্য নেই। রাজনৈতিক শক্তি চরমভাবে বিভাজিত। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসের সংকট কেবল বিপরীত ধারার রাজনৈতিক দলের মধ্যেই নয়, এক দলের নেতাদের মধ্যেও আছে বিশ্বাসের সংকট। এটা যেমন বিএনপির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি আওয়ামী লীগের বেলায়ও। গ্রুপিং এখন রাজনৈতিক দলের বড় সমস্যা। দেশের মানুষও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। আমি আমার লেখায় কাকে খুশি করতে পারবো, কাকে আমার পক্ষে পাবো, সেটা যেহেতু আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়, তাই আমার সাবধান না হয়ে উপায় আছে। যদিও ‘সাবধানের মাইর’ নেই বলে একটি কথা আমাদের দেশে চালু আছে, তারপরও দেখা যাচ্ছে, সাবধানে থেকেও অনেক সময় বিপদ এড়ানো যাচ্ছে না। কারণ বিপদ কখনও বলে-কয়ে আসে না–এটাও আমাদের দেশে বহু ব্যবহৃত একটি বাক্য।
অনেক পাঠক মনে করেন, আমি আওয়ামী লীগের ‘দালাল’। বিএনপির কেউ কেউ তো মনে করেন, আমি বোধ হয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাদের একজন। আমার নামের কারণেও হয়তো কারও এমন ধারণা হয়ে থাকতে পারে যে ব্যাটা, ‘মালু’ আওয়ামী লীগার না হয়েই পারে না। আবার আওয়ামী লীগ কখনও আমাকে তাদের ‘অনুগত’ বলে মনে করে না। আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগ সরকারে আছে বলে আমি কখনও বিশেষ কোনও সুবিধা পেয়েছি, গণভবন, বঙ্গভবনে ডাক পেয়েছি–তা কিন্তু নয়। বরং অনেক চেষ্টা-তদবির করেও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে পারি না।
আমি কী লিখি, সেটা এখন খুব কম পাঠকই পড়েন বলে ধারণা। বেশিরভাগ পাঠক একটা কিছু অনুমান করে নেন। অনেকে বলেনও, আজ আপনার একটা লেখা দেখলাম। অর্থাৎ লেখা পড়ার নয়, দেখার বিষয়! ফলে বিএনপি মনে করে আমি আওয়ামী লীগের পক্ষে লিখি, আর আওয়ামী লীগ মনে করে আমি শতভাগ আনুগত্য দেখাতে ব্যর্থ। ফলে আমার পক্ষে লেখালেখিতে খুব বেশি ‘সাহস’ দেখানোর সুযোগ আছে কি? তাহলে আমি লিখি কেন–এ প্রশ্ন কেউ করতেই পারেন। আমার সোজা জবাব, এখন অবশ্য অভ্যাসবশতই লিখি। প্রায় চল্লিশ বছরের অভ্যাস তো, না লিখলে হাত নিশপিশ করে। কেউ মনে করতে পারেন, লিখে বুঝি ভালো ‘মালপানি’ কামাই হচ্ছে। সেটাও একেবারেই ভুল ধারণা। আমার মতো না-ঘরকা, না-ঘাটকা কলমজীবীর বাজারমূল্য এখন একেবারে নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের নীতিহীনতা নিয়ে আমরা অনেকেই সোচ্চার। কিন্তু দেশের গণমাধ্যমগুলোতে যে কী স্বেচ্ছাচারিতা চলছে, তার কতটুকু সবাই জানেন?
এই যা, কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি। নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারার কাজটি সম্ভবত এর মধ্যেই সম্পন্ন করে ফেলেছি। পাঠকরাও নিশ্চয়ই ধান ভানতে শিবের গীত শুনে বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। প্রিয় পাঠক, কত কিছুই তো প্রতিদিন মুখ বুজে সহ্য করছেন, হজম করছেন, এক অসহায় কলমজীবীর একটু বিলাপও না হয় আজ হজম করলেন!

দুই.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭ ডিসেম্বর গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে নানা বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটি বড় গুণ হলো, তিনি স্পষ্ট কথা বলতে পছন্দ করেন। তার এই সোজাসাপটা কথা বলার ধরন অনেকেরই ভালো লাগে, আবার খারাপও লাগে কারও কারও। সত্য কথা, উচিত কথা সবার ভালো না লাগারই কথা। ‘উচিত কথায় গুষ্টি ব্যাজার’– বলে একটা কথা চালু আছে। তো, প্রধানমন্ত্রী সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে কিছু স্পষ্ট কথা, উচিত কথা সরাসরি বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার হয়েছে, সংবাদপত্রেও ছাপা হয়েছে। যথারীতি তাঁর সব কথা সবার ভালো লাগেনি। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী অত কঠিন করে কথাগুলো না বললেও পারতেন। বিশেষ করে বিএনপি নাকে খত দিয়ে আগামী নির্বাচনে আসবে বলে যে মন্তব্য করেছেন তা রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তেজক করে তুলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ‘নাকে খত’ দেওয়া কথাটা গণতান্ত্রিক মানসিকতার সঙ্গে যায় না বলেও কেউ কেউ বলছেন। বিএনপির সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনায় বসার সম্ভাবনাও প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দিয়েছেন। এতেও কেউ কেউ আহত হয়েছেন। কিন্তু শুনতে কটু লাগলেও শেখ হাসিনা কি কোনও অসত্য কথা বলেছেন? তিনি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে বলেছেন, ‘বরণডালা পাঠাতে হবে? কার সঙ্গে আলোচনা? আমি তো ফোন করেছিলাম। যে ঝাড়িটা খেলাম। ওই রকম আর অপমানিত হওয়ার ইচ্ছা নেই। যাদের মধ্যে ভদ্রতা জ্ঞান নেই, তাদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এত সাধাসাধির দরকারটা কী হলো, আমি বুঝতে পারলাম না।’
প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো চাঁছাছোলা সন্দেহ নেই, কিন্তু অন্যায্য কী? বিএনপির মতো চরম আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী ও গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিকতার চর্চাকারী দলের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে যারা মোলায়েম ভাষায় কথা বলতে বলেন, তারা খালেদা জিয়াকে কি সেটা বলতে পারেন? বিএনপি যে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত (২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা) এটা আমরা অনেকে ভুলে গেলেও শেখ হাসিনা নিজে কিভাবে ভোলেন?
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কোন দল নির্বাচন করবে, কোন দল করবে না, এগুলো তাদের দলের সিদ্ধান্ত। যারা সত্যি নির্বাচন করতে চায়, নির্বাচনে আসবে। আর যদি তাদের সিদ্ধান্ত হয় করবে না, তো করবে না।’ এখানেও বা তিনি ভুল বললেন কোথায়? কোনও দল যদি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সাধাসাধি করে কি আনা যায়? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপিকে আনার উদ্যোগ নিয়ে শেখ হাসিনা তো বিএনপি নেত্রীকে ফোন করেছিলেন। তিনি কি সাড়া দিয়েছিলেন? ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে নির্বাচন হয় সে নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর দল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে অংশ নেয়নি। মওলানা সাহেবকে কি কেউ নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ-উপরোধ করেছিল? ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তো তোলা হয়নি। বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা, সেটা সরকার বা প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিতে পারবেন না।
সৌদি আরবে জিয়া পরিবারের অর্থ পাচারের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সৌদিতে বিশাল শপিং মল, সম্পদ পাওয়ার বিষয়ে আমরা কিছু করিনি। বিদেশ থেকে প্রচার হয়েছে। আমি একটা প্রশ্ন করি, সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক আছেন, অনেকেই আছেন বিভিন্ন চ্যানেলের। কই, আপনাদের তো এটা নিয়ে খুব একটা নিউজ করার আগ্রহ দেখলাম না। এর রহস্যটা কী? রহস্য কি আপনারা সেখানে বিনে পয়সায় শপিং করার কার্ড পেয়েছেন? কেউ নিউজটা দিতে পারলেন না? এ ধরনের নিউজ যদি আমার ব্যাপারে হতো বা আমার পরিবারের ব্যাপারে হতো, তাহলে আপনারা তো হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। আমাদের অপরাধ কী?’
প্রধানমন্ত্রীর এই জিজ্ঞাসার জবাব সংবাদ সম্মেলনে কিংবা তারপর কোনও মালিক-সম্পাদক কেন দিলেন না, এটা আমারও প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী মালিক-সম্পাদকদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুললেন, অথচ কারও কোনও জবাব নেই। তাজ্জব ব্যাপার! যদি জিয়া পরিবারের অর্থ পাচারের অভিযোগের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকে, অথবা প্রকৃত তথ্য জানা থাকে, সেটা বলতে অসুবিধা কোথায়? প্রধানমন্ত্রী যদি কোনও ভুল তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ করে থাকেন, তাহলে তাকে শুধরে দেওয়া তো তার প্রকৃত শুভানুধ্যায়ীদেরই দায়িত্ব।

পাদটীকা: বিএনপির সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে একপর্যায়ে গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আপনাদের যদি এতই দুঃখ থাকে, তাহলে ওদিকে যান–তেলের টিন নিয়ে চলে যান, আর কী করবেন। আমি ওই রকম অপাত্রে ঘি ঢালি না।’

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ