X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্প ছাড়া সবাইকে বেকায়দায় ফেলেছে আকায়েদ

প্রভাষ আমিন
১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:০৭আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:০৯

প্রভাষ আমিন জঙ্গিবাদে একটি টার্ম আছে­– লোন উলফ। কঠোর অভিযানে কোনঠাসা হয়ে গেলে জঙ্গিরা ব্রেন ওয়াশ করে মাঠে নামায় একক জঙ্গিকে। আত্মঘাতী সেই জঙ্গি টার্গেটে হামলা চালায়। সেই হামলায় জঙ্গি নিজেও মরে যায় বলে তার সঙ্গী-সাথীরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সাধারণত লোন উলফরা আদর্শিক ও সামরিক কৌশলে প্রশিক্ষিত। তবে আইএস বা অন্য কোনও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কোনও ধরনের যোগাযোগ ছাড়াও এ ধরনের লোন উলফরা হামলা চালাতে পারে। আকায়েদউল্লাহ কি তেমন কোনও লোন উলফ? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। যাই হোক, আকায়েদ উল্লাহ খুব অপেশাদার এবং দুর্বল জঙ্গি। নিউইয়র্ক টাইমস স্কয়ারে ঘরে বানানো পাইপ বোমা বিস্ফোরণে আকায়েদ নিজে গুরুতর আহত হয়েছে। সামান্য আহত হয়েছে আরো তিনজন। কেন আকায়েদউল্লাহ এই হামলা চালাতে গেলো? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। কারণ কোনও সংগঠন এখনও এ হামলার দায় স্বীকার করেনি। আকায়েদের সঙ্গে কোনও জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগেরও কোনও প্রমাণ মেলেনি। তবে আকায়েদ যেহেতু বেঁচে আছে, তাই নিশ্চয়ই তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাবে; জানা যাবে কেন, কার অনুপ্রেরণায় সে হামলা চালিয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে যেটা জানা যাচ্ছে, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা ঘোষণাই ক্ষুব্ধ করেছিল আকায়েদকে। কিন্তু পাগলা ট্রাম্পের এই ঘোষণা শুধু আকায়েদকেই নয়, ক্ষুব্ধ করেছে আরও অনেককেই। আর শুধু মুসলমানদেরই নয়, ট্রাম্পের এই ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়েছে ন্যায়ের পক্ষে থাকা বিশ্বের আরও অনেককে। তার এই ঘোষণা ফিলিস্তিনে শান্তি প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ক্ষুব্ধ হওয়া এক কথা আর বোমা নিয়ে নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এক কথা নয়। আমিও মনে করি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ‘পাগলের’ আমেরিকার মতো একটি দেশের প্রেসিডেন্ট পদে থাকা উচিত নয়। আমি চাইবো, সুযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে অভিশংসনের ব্যবস্থা করা হোক। আগামী নির্বাচনে তাকে প্রত্যাখ্যান করা হোক। কিন্তু আমি তো কখনোই ট্রাম্পের মৃত্যু কামনা করি না।

নিউইয়র্কের এই ছোট্ট হামলা নিয়ে এখন বড় তোলপাড় বিশ্বজুড়ে। তোলপাড়টা বাংলাদেশে একটু বেশি। কারণ হামলাকারী আকায়েদউল্লাহর বাড়ি বাংলাদেশে। শুধু বাড়ি বাংলাদেশে, এছাড়া এই ঘটনায় বাংলাদেশের আর কোনও সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু বিশ্ব মিডিয়ায় যতবার আকায়েদের নাম আসছে, ততবার উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম। অর্থহীন এ হামলা চালিয়ে আকায়েদ আসলে বেকায়দায় ফেলেছে তার স্ত্রী, সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি, মা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে। ব্রুকলিনে তার বাসায়, ঢাকার মনেশ্বরে তার শ্বশুর বাড়ি, সন্দীপে তার গ্রামের বাড়িতেও এখন পুলিশের আনাগোনা। সবাই আকায়েদের জঙ্গি সম্পৃক্ততার উৎস খুঁজতে চাইছে। ২৭ বছর বয়সী আকায়েদ ৮ বছর ধরে আমেরিকায় আছে। তার পরিবার আছে আরো আগে থেকেই। গত বছর ঢাকার ঝিগাতলায় বিয়ে করেছিল সে। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী পাত্র দেখে মনের আনন্দেই তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়েছিল এক দোকান কর্মচারি। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন মেয়ে স্বপ্নের দেশ আমেরিকা চলে যাবে। সেই স্বপ্ন যে এমন দুঃস্বপ্নে বদলে যাবে ভাবেননি কেউই। দেশে ছয় মাসের ছেলে রেখে কারো পক্ষে এ ধরনের পাগলামো করা সম্ভব, এটা ভাবনার সীমানাতেও আসে না। শুধু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নয়; আকায়েদ আসলে বেকায়দায় ফেলেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের, বড় ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতেও। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার, বাংলাদেশে থাকার সময় তার কোনও জঙ্গি সম্পৃক্ততা ছিল না। যা হওয়ার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হয়েছে। সত্য মিথ্যা জানি না, ফেসবুকে দেখছি, অনেকে বলছেন, আকায়েদ বাংলাদেশে থাকতে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর যুক্তরাষ্ট্রে তিনি সম্পৃক্ত হন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে। শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় বিএনপির বিক্ষোভেও নাকি সে অংশ নিয়েছিল। তবে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আর জঙ্গি সম্পৃক্ততা এক নয়। আর তার এই অপতৎপরকতার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও সম্পর্ক নেই। প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও কোনও সম্পর্ক নেই। এ দায় আকায়েদ উল্লাহর একার। বরং বাংলাদেশের একজন সাধারণ ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কিভাবে আত্মঘাতী হামলাকারীতে বদলে গেলো, সেটা আমেরিকাকেই ভেবে দেখতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে অভিবাসী, বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে নানা হেনস্থার শিকার হয়েছেন, হামলার মুখে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যে বহুমাত্রিক মুক্ত সমাজের ধারণা, সেই ধারণাই বদলে দিতে চাইছেন ট্রাম্প। এই পাগল আমারিকাকে আবার গ্রেট বানাতে চাইছে সব অভিবাসীকে বের করে দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে চায় ট্রাম্প। ক্ষমতায় আসার পর থেকে কড়া অভিবাসন নীতি আর মুসলমানদের ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ট্রাম্প মুসলমানদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। তাদের মধ্যে আকায়েদের মতো কেউ যদি বোমা নিয়ে হামলা করতে যায়; সে দায় বাংলাদেশের নয়, প্রবাসী বাংলাদেশিদের নয়, ইসলামের নয়; দায় পুরোটাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের।

কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। আকায়েদের এই ব্যর্থ হামলায় সবাই বেকায়দায় পড়েছে। লাভ হয়েছে একজনেরই– ডোনাল্ড ট্রাম্প। হামলার আগে নিজের ফেসবুকে আকায়েদ ট্রাম্পকে হুঁশিয়ার করে লিখেছিল, ‘দেশকে রক্ষা করতে পারলেন না আপনি’। কিন্তু আকায়েদের এই হামলায় ট্রাম্পের সাম্রাজ্যে আঁচড়ও লাগেনি। ট্রাম্প ঠিকই তার দেশকে রক্ষা করতে পেরেছেন, আকায়েদ বরং নিজেকে রক্ষা পেলো না। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চেষ্টা করলেও মুসলমানদের ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং কড়া অভিবাসন নীতি নিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না ট্রাম্প। বারবার আদালত আটকে দিচ্ছিল তার এইসব অপতৎপরতা। এবার আকায়েদের বোকামির পর ট্রাম্প আবার তার পাগলামো নিয়ে মাঠে নামতে পারবে। ইতিমধ্যে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র সেরাহ স্যান্ডার্স জানিয়ে দিয়েছেন, কড়া অভিবাসন নীতি নিয়ে তারা আরও এগিয়ে যাবেন। আর এই নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল আকায়েদের মতো জঙ্গিদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ আটকানো এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখা সম্ভব। ট্রাম্প নিজেও চেইন ইমিগ্রেশন বন্ধে কঠোর আইন করার কথা বলছেন। মানে হলো, ট্রাম্প এখন আকায়েদকে ট্রাম্প কার্ড বানিয়ে তার অপইচ্ছা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। আমার ধারণা সুযোগ থাকলে ট্রাম্প হাসপাতালে গিয়ে আকায়েদের কানে কানে বলে আসতো, ‘ভাই, তুই আমার বাপের উপকার করছিস। এতদিন আমার কথা কেউ শুনছিল না। এখন তোর এই হামলাকে আমি হামলার যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবো।’

আকায়েদের হামলার পর বারবার বাংলাদেশের নাম আলোচনায় আসছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে নিজেদের লজ্জার কথা লিখেছেন ফেসবুকে। আমি বুঝি তাদের বেদনাটা। আমি জানি, এই হামলা তাদের প্রবাস জীবনকে আরও কত কষ্টের করে দেবে। তবু আমি মনে করি, এই ঘটনায় বাংলাদেশের বা প্রবাসী বাংলাদেশিদের লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। একজন মানুষের বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা দিয়ে একটি দেশকে, একটি ধর্মকে, একটি জাতিকে কোনঠাসা করার কোনও সুযোগ নেই। জঙ্গিবাদ কোনও নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নয়, বাংলাদেশের তো নয়ই। এটা বৈশ্বিক সমস্যা। মোকাবিলা করতে হবে সবাইকে মিলে। জঙ্গিবাদের সমস্যা বাংলাদেশেও আছে। তবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি শুধু মুখের কথা নয়। বিজয়ের ৪৬ বছর পর বাংলাদেশকে নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। বরং বাংলাদেশকে নিয়ে এখন গর্ব করা যায়। যে মার্কিনিরা একসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিল, সেই মার্কিনিরাই এখন জানে বাংলাদেশের ঝুড়িতে অনেক অর্জন। তাই লজ্জায় মুখ লুকানো নয়, বুক ফুলিয়ে বলুন, আমি বাঙালি, আমি বাংলাদেশি। বাংলাদেশকে আমরা ভালোবাসি। একজন আকায়েদের ঠুসঠাসে আমাদের অর্জন ম্লান হয়ে যাবে না।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

[email protected]      

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ