X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষা কোনও আতঙ্কের বিষয় নয়

শামীম রুনা
১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:০৪আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০১৮, ১৯:০৯

শামীম রুনা সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের একটা স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার আগের টেস্ট পরীক্ষায় স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পাস করতে পারে নাই বলে জেলা নির্বাহী অফিসারের উপস্থিতিতে শিক্ষক আর অভিভাবকদের একটি মিটিং বসেছিল। সে  মিটিংয়ে শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা হলো- এক বিষয়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে আর অন্যরা গণহারে ফেল! দশ বছরের টানা পড়াশোনার ফলাফল এক মিটিংয়ে নির্ধারিত হয়ে গেলো! বেশিরভাগ শিক্ষার্থী দশ বা বারো বিষয়ের পরীক্ষায় দুইয়ের বেশি বিষয়ে ফেল করায় এসএসসি পরীক্ষায় বসার অনুমতি না পাওয়ায় তারা লাইন বেঁধে স্কুলের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নাকি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। অনেকে মিটিংয়ে আসা নির্বাহী অফিসারের পা ধরে তাদের জীবন নষ্ট না করার অনুরোধ করে। এক ছাত্রী জানায়, তার মা গার্মেন্টেসে কাজ করে অনেক কষ্ট করে মেয়েকে তিনি দশ বছর পড়িয়েছেন নিজেদের একটা সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। এবার পরীক্ষা না দিতে পারলে আরও বাড়তি এক বছর ওর শিক্ষার খরচ ব্যয় করা ওর মায়ের জন্য সম্ভব নয়, তাই ওকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধে সে নির্বাহী অফিসারের পা ধরে কান্না কাটি করে। আমরা জানি, বাংলাদেশে এসএসসি পাস নারীর জন্য ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করা কোনও কর্মসংস্থান করা খুব কঠিনই শুধু নয়, তা অবাস্তব একটি স্বপ্ন বটে। তারপরও, এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারা বা পাস করা এখনও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা স্বপ্নের চারাগাছ। বীজ লাগিয়েছে, চারাগাছ জন্ম, একদিন তা ফলবান বৃক্ষ হবে, ফলিত শষ্যে ঘর থেকে অনাহারা দূর হবে, এই স্বপ্ন আমাদের দেশের সকল নিম্নবিত্ত কী মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন। তাই যখন কোনও শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা পাস করতে পারে না, তখন একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে সঙ্গে একটা পুরো পরিবারের স্বপ্ন টুকরো টুকরো হয়ে ভাঙে পড়ে। এই বিষয়টা শুধু সাধারণ জনগণ না সরকার পক্ষের মহামান্য শিক্ষানীতি নির্ধারকরাও বুঝে বলেও ধারণা করি।

এটা  আমাদের দেশের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও সংবাদ না। বছরে এরকম সংবাদ কয়েকবার আমরা বিভিন্ন ঢং এ দেখতে দেখতে  অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু তারপরও কিছু প্রশ্ন মাঝে মধ্যে মনে টোকা দিয়ে যায়, একটা স্কুলের শিক্ষার্থী পাস করার জন্য কতটা শিক্ষার্থীরা দায়ী আর কতটা শিক্ষকরা দায়ী বা কতটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দায়ী? সারা বছর তোতা পাখির মতো পড়ার পর শিক্ষার্থীরা যখন পাস করে না এবং তাদের কম মেধাবী বলে দোষারোপ করা হয় তখন যদি তার উল্টা দিকটা ভাবা যায়; সারা বছর পড়ানার পরও যখন শিক্ষার্থীদের কোনও স্কুলের শিক্ষকরা পাস করাতে পারে না তখন ধরে নিতে পারি আমরা, তারা যথাযথ শিক্ষা পাচ্ছে না, মানে শিক্ষকের গাফিলতি বা টোটাল শিক্ষা পদ্ধতিটাতেই গড়বড় রয়ে গেছে। আনঅফিশিয়ালি, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ ভাবা চলে প্রাইভেট টিউশনকে। যে শিক্ষার্থী যত বেশি প্রাইভেট পড়বো সে তত গ্ল্যামারাস (গ্লোরিয়াস বললাম না ইচ্ছে করে) রেজাল্ট নিয়ে উপরের ক্লাসে উপরের দিকের রোল নং পেয়ে তরতরিয়ে উঠে যাবে। তাদের কাছে সরল অঙ্কে সরল হয়ে যায় আর যে শিক্ষার্থী শিক্ষকের বাসা বা কোচিংয়ে গিয়ে পড়বো না সরল অঙ্ক সারা বছর তার কাছে গরলই থেকে যাবে।  যারা প্রতি সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়ে না, পরিবারের কারোর সাহায্য নিয়ে নিজেরা কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে তারা টিটিপি (টেনেটুনে পাস)) করে যায়।  নারায়ণগঞ্জের যে স্কুলের কথা বলা হয়েছে, সে স্কুল বা বাংলাদেশের বড় শহরের বাইরের অধিকাংশ স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা কিছুটা নিম্ন আয়ের বা তারা সন্তানের পড়াশুনার পেছনে বাড়তি খরচ করার সঙ্গতি রাখে না। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে শিক্ষার জন্য খরচকে আমাদের সমাজে এখনও অনেক পরিবার বাড়তি খরচ মনে করে। তাই যদি হয়, তাহলে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা তেমন ভাবে প্রাইভেট পড়তে পারে নাই, তাই তাদের সব বিষয়ে পাস করার আশা শূন্যের কোঠায়। এখানে দোষটা কার? শিক্ষার্থীর, অভিভাবকের না শিক্ষকের না শিক্ষা ব্যবস্থার?

এবার আসি প্রাইভেট টিউশনের বিষয়, যে বিষয় বা সাবজেক্ট শিক্ষক তার ক্লাসরুমে কম মেধাবী শিক্ষার্থীর মাথায় ঢুকাতে পারে না তা তিনি তার প্রাইভেট টিউশনে ভালো করেই দিতে পারেন, তার মানে এই শিক্ষকের ভেতরে দুর্নীতি আছে। আর একজন দুর্নীতিবাজ শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা দুর্নীতি আর নকল করা ছাড়া কী বা শিখতে পারে!

শিক্ষার্থীদের নিজেদের পরীক্ষায় বসার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে হয় ক্ষমতাধরদের বা শিক্ষকের পা ধরে। সেলুকাস শিক্ষা ব্যবস্থা! প্রথম থেকে শিক্ষার্থীরা শিখছে, নিজের মেরুদণ্ড ভেঙে, ক্ষমতাধরদের সহানুভূতির মাধ্যমে, করুণা অর্জন করে অধিকার আদায় করতে হয়, শিরদাঁড়া সোজা করে না। এমন একটা মেরুদণ্ড ভাঙা প্রজন্ম ভবিষ্যতে দেশকে কতটা কী দিতে পারবে আমরা হয়ত তা বর্তমানে দাঁড়িয়ে অনুধাবন করতে পারছি না, ভবিষ্যতে এর হাঁড়মাংসের বেদনা ঠিকঠাক টের পাওয়া যাবে।

পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ না পাওয়ায় গোপালগঞ্জের বিশ বছরের তরুণ অর্ঘ বিশ্বাস আত্মহত্যা করছে কিছুদিন আগে। স্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে নাই বলে রেসেডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীরে পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া সহ নানা রকম এবিউজ করছিল শিক্ষক, ফলশ্রুতিতে অভিমানী কিশোরের আত্মহত্যাকে বেছে নিতে হয়েছিলো। এরকম কত কিশোর কিশোরী নিঃশব্দে কাউকে জানান না দিয়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষা নামক প্রহশনের সাথে অভিমান করে চলে যায় তার খবর কি আর সব জানা যায়! অথচ এমন হওয়ার তো কথা নয়, পুরা শিক্ষা ব্যবস্থাটা শিক্ষার্থীদের জন্য, শিক্ষক, কোনও অফিসার বা সিস্টেমের জন্য নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরাই সব থেকে  অবহেলিত, সব চাইতে বেশি ভুগছে। শৈশব থেকে একজন শিশুর পরীক্ষা নামক ‘দানব আসিতেছে’ ভয়ে আতঙ্কিত দিন যাপন শুরু হয়। কৈশোর তারুণ্যে সে ‘দানব নাইট মেয়ারে’ রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।

গত প্রায় দুই বছরের ইউরোপিয়ান জীবন যাপনে এদেশের স্কুলিং সিস্টেম কিছুটা জানার সুযোগ আমার হয়েছে। কিছুটা আমার মেয়েদের স্কুলের কল্যাণে আর কিছুটা একটা কিশোর স্কুলে ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের ইন্টার্নশিপ করার সুযোগে।

নরওয়েজিয়ান স্কুল সিস্টেম হইলো বয়স অনুযায়ী। যেমন ছয় বছর বয়সে ওদের ক্লাস ওয়ান শুরু হয়। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত বার্নাস্কুলা বা প্রাইমারি স্কুল। ক্লাস এইট থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত উঙ্গদমস্কুলা বা কিশোর স্কুল। তারপর তিন বছরের ভিদেরগোয়েন্দে বা কলেজ। এই কলেজে এসে শিক্ষার্থীদের পথ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায়। যারা উচ্চ শিক্ষা নিতে চায় না তারা দুই বছর ভিদেরগোয়েন্দেতে পড়ে আর দুই বছর সে যে কাজ করতে চায় ভবিষ্যতে সে বিষয়ে ভোকেশনাল পড়াশোনা করে ছাত্র জীবনের ইতি টানবে। আর যারা উচ্চ শিক্ষায় যেতে চায় তারা তিন বছরের ভিদেরগোয়েন্দে শেষ করে তাদের এই যাবৎ স্কুল-কলেজ থেকে প্রাপ্ত মার্কস দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবেদনের মধ্যে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বা মুখস্ত বিদ্যার সব সাবজেক্টের নম্বরগুলো খালি বিবেচনায় নেবে তা কিন্তু না, জিম, গেম, কালচারাল অ্যাকটিভিটি, সোশ্যাল অ্যাকটিভিটিস সহ আরও কিছু বিষয়ও শিক্ষার্থীদের ভর্তির যোগ্যতা বলে গণ্য হয়। এসব বিষয়ের সঙ্গে তাই  শিক্ষার্থীদের স্কুল লাইফ থেকে নানান ভাবে ইনভলব করানো হয়। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে কোনও দল বা ‘মামুর’ সুপারিশ গণ্য করা হয় না। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের সরকার লোন দিয়ে থাকে, যা পরবর্তীতে কর্ম জীবন শুরু করার পর শিক্ষার্থী অল্প অল্প করে শোধ করতে পারে।  ক্লাস ওয়ান থেকে ভিদারগেয়েন্দে পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং ফ্রি, যাবতীয় শিক্ষা খরচ সরকার বহন করে। পেন্সিল থেকে শুরু করে বই, খাতা ল্যাপটপ স্কুল থেকে দেওয়া হয়। সব চেয়ে স্বস্তির ব্যাপার হলো, ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত কোনও পরীক্ষা নামক ‘দানবের’ নাম কোথাও শোনা যায় না। ক্লাস এইট থেকে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে পরীক্ষা নামক ‘দানবটি’র সঙ্গে খেলতে খেলতে পরিচিত হতে থাকে। ক্লাস নাইন থেকে ওদের পরীক্ষার শুরু, পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ  আর ক্লাস টেন থেকে গ্রেড কাউন্ট হওয়া শুরু হয়। তার মানে এই না যে কেউ ভালো করলো না বা পরীক্ষা দিলো না তাই সে ওপরের ক্লাসে উঠতে পারবে না, মোটেও সে রকম কিছু না। নরওয়েজিয়ান স্কুল সিস্টেমে ক্লাস ওয়ান থেকে ভিদেরগোয়েন্দে পর্যন্ত বছর বছর নতুন ক্লাসে ওঠো আর খেলাধুলা নাচে গানে মাস্তি করো। পড়ালেখার বোরিং ধারাবাহিকতার বাইরে অন্যান্য অ্যাকটিভিটিরে এরা অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়।

নরওয়েতে স্কুলের প্রকৃত মালিক শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক, কমিউনিটি সর্বক্ষণ ভাবছে কী করে আরও সহজ ভাবে শিশু কিশোর তরুণদের শেখানো যায়। স্কুলে ‘ডেঞ্জারাস অমুক স্যার বা খাতারনাক তমুক ম্যাডামের’ কোনও অস্তিত্ব নাই। শিক্ষক শিক্ষার্থী সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকছে। একজন শিক্ষার্থীর পড়াশোনার সমস্যা বা যে কোনও সমস্যায় শিক্ষকরা অস্থির হয়ে যায় কী করে তাকে সাহায্য করা যায় ভেবে। ক্লাস রুমে কোনও শিক্ষার্থী কথা বলতে চাইলে হাত ওঠাবে, প্রয়োজনে শিক্ষক তার কাছে গিয়ে তার কথা শুনবে, খুব নরম ভাবে তার সমস্যা সমাধান করবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে বিষয়টি বুঝতে পারবে। প্রয়োজনে এক্সট্রা সময় দিয়ে শিক্ষার্থীকে স্কুলেই পড়ানো হবে। উঙ্গদম স্কুলায় একজন রোদগিভার বা কাউন্সিলর থাকে। রোদগিভার শিক্ষার্থীদের নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা প্রফেশন সিলেক্ট করতে সাহায্য করে। একজন মিলিওথেরাপিস্ট বা সোশ্যাল থেরাপিস্ট থাকে যে কিনা শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে সোশ্যাল হতে সাহায্য করে থাকে। একজন হেলসেসোসতের বা নার্স থাকে যিনি পুরা স্কুলের সব শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা রাখে।

 

এই দেশে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে, মাথা নিচু করে নয়। আমরা চোখের ভাষা শুধু প্রেমের বেলায় ব্যবহার করি, এরা সবক্ষেত্রে চোখে চোখ রেখে কথা বলাকে খুব মূল্য দেয়। তিন কী চার জন শিক্ষক একটি ক্লাসের সবগুলো বিষয় পড়িয়ে থাকে, দশ বিষয়ের জন্য দশ জন শিক্ষক নয় বরং কম শিক্ষক খুব ভালো কেয়ার নিতে পারে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকরা সব শিক্ষার্থীর নাম জানে এবং তাদের সব রকম ইনফরমেশন জানে। আমাদের দেশের শিক্ষকদের মতো রোল নম্বর অনুসারে শিক্ষার্থীদের ডাকে না। কারো নাম ধরে কথা বলা একটি মাস্ট অ্যাফিসিয়েন্ট পয়েন্ট। কারো নাম হারিয়ে যাওয়া মানে তো আইডেন্টিটি ক্রাইসিস।

এখানে সব স্কুল কো এডুকেশন। কিশোর কিশোরী পাশাপাশি বসে ক্লাস করছে, কৈশোরের ধর্ম মতে সবাই সবার সঙ্গে খুনসুটি দুষ্টামি করছে। অনেকে প্রেমও করছে তবে সেটা কখনও আমাদের দেশের স্কুল কলেজের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থতি তৈরি করে মিডিয়ার নিউজে পরিণত হয় না বা শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করার জন্য পুরো স্কুল কমিটি মুখিয়ে থাকে না।  অথচ এটাই স্বাভাবিক কৈশোর বা তারুণ্যেই মানুষ বেশি আবেগী হয়ে ওঠে, প্রেমে পড়ে। আমাদের দেশের স্কুলে তো অনেকরে টিসি দিয়ে বেরও করে দেয় প্রেম করার কারণে। স্কুল কমিটি একবারও ভাবে না টিসি দেওয়ার পর পরবর্তীতে ওই সব শিক্ষার্থীদের কী হতে পারে। আমাদের শিক্ষকরা এমন শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার চাইতে তাদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে বেশি আগ্রহ বোধ করে থাকেন।

এদেশের স্কুলে টিফিন ব্রেকে বা অন্য ব্রেকের সময় শিক্ষকরা মাঠে, স্কুল করিডোরে গার্ডের মতো টহল দিতে থাকে আর ঝড় বৃষ্টি কী ভারী তুষারপাতের সময়ও শিক্ষার্থীদের ঠেলে বের করে দেয় খোলা মাঠে। যেন ওরা সব রকম আবহাওয়ায় ঘরের বাইরে থাকতে অভ্যস্ত হয়।

নরওয়ের স্কুলে ক্লাস ফাইভের পিএসসি বা এইটের জেএসসি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না। পরীক্ষাই নাই, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার চান্স নাই। ক্লাস নাইন আর স্কুল ফাইনাল বা ক্লাস টেনের প্রশ্নপত্র স্কুলের সাবজেক্ট টিচারই তৈরি করে, তার আন্ডারে শিক্ষার্থীরা স্কুলে, ক্লাসরুমে আরামসে স্যান্ডউইচ আর কোক খেতে খেতে পরীক্ষা দেয়। কোনও ধরনের জাতীয় পরীক্ষা হয় না, আলাদা এক্সামিনেশন সেন্টার বসে না, কোথাও কোনও বাড়তি প্রেসার নাই। আর প্রশ্নপত্র স্কুলের সাবজেক্ট টিচার নিজ স্কুলের জন্য তৈরি করে, তাই কোনও প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তার মাধ্যমে হতে হবে।

স্কুলগুলোতে (শুধু স্কুল কেন, এদেশের কোথাও দারোয়ান, পিয়ন জাতীয় কোনও পদ নাই। অফিসে, ঘরে সর্বত্র নিজের কাজ নিজেকে করতে হয়। অনেকটা দয়াল বাবা কলা খাবা গাছ লাগায়া খাও, নীতিতে চলে সবকিছু। মেয়র অফিসে মেয়রকে নিজের লাঞ্চের পাউরটি নিজেকে কিনতে হয় পাশের দোকানে হেঁটে যেয়ে।) কোনও দারোয়ান, আয়া বা এই জাতীয় কেউ নাই। সব কাজ শিক্ষকদের করতে হয়। ক্লাস শেষে প্রতি দিন দুইজন শিক্ষার্থী ক্লাসরুম ঝাড় দিয়ে ময়লা বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে আসে।

ক্রাফট এবং হাতের কাজের ক্লাসের বিভিন্ন কাজ ছেলে মেয়ে সবাই সমান ভাবে শেখে। উল বোনা, কাঠের কাজ, কম্পিউটার শিখার মতো কোর্সগুলো ছেলে মেয়েদের মাঝে আলাদা করে কোনোরকম বিভেদ করা হয় নাই, সবাইকে সমান সমান  শিখছে।

খাবার ও স্বাস্থ্য এদেশের স্কুলগুলার একটি ইম্পর্টেন্ট সাবজেক্ট। এই সাবজেক্টও ছেলে মেয়ে সবাই রান্না বান্না থেকে শুরু করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলা সমান সমান করতে হয়। এমন না যে গার্হস্থ্য অর্থনীতি মেয়েরা পড়বে আর কৃষিবিদ্যা ছেলেদের জন্য।

দুই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্যগুলো নিয়ে কথা বললাম এই কারণে যে, কোন শিক্ষা ব্যবস্থাটা শিক্ষার্থীদের জন্য অ্যাফিকটিভ আর কোনটা না? আমাদের দেশের বাচ্চাদের পড়াশোনার চাপ নিতে হয় চার কী পাঁচ বছর বয়স থেকে। তখন থেকে তাদের শৈশব কৈশোর তারুণ্য ধ্বংসের শুরু, আর ধ্বংস স্তুপে দাঁড়িয়ে একজন শিশু কতটা স্বপ্ন নিয়ে জীবন শুরু করতে পারবে কে জানে। তারপর এইসব শিশুদের ওপর পরীক্ষার নামে নিত্য নতুন এক্সপেরিমেন্ট চাপিয়ে শিশুদের জাস্ট গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। আমাদের দেশের স্কুলগুলাতে এমনিতে বাচ্চারা প্রথম থেকে পরীক্ষার চাপে কাতর থাকে, তার ওপর গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো এখন পিইসি, জেএসসি নামের আরও দুইটা ‘দানব’ যোগ দিয়েছে, তারপর তো আছে এসএসসির মতো বিশাল এক পরীক্ষা। দশ বছরের স্কুল লাইফে তিনটা বড়ো পরীক্ষার! আমার ধারণা, এই তিন পরীক্ষার জন্য যত না শিক্ষার্থীরা জ্ঞানী হচ্ছে তার চেয়ে বেশি প্রাইভেট টিউশন দেওয়া শিক্ষক আর কোচিং সেন্টারগুলোর পকেট ভারী হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থার নামে শিক্ষা কমিটি কার স্বার্থ রক্ষা করছে, শিক্ষার্থীর না শিক্ষা ব্যবসায়ীদের ?

লেখক: কথা সাহিত্যিক ও টেলিভিশন স্ক্রীপ্ট রাইটার।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ