X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রংপুরের নির্বাচনে কী বার্তা আছে

আনিস আলমগীর
২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:৪৪আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:৩৮

আনিস আলমগীর রংপুরবাসীর তাদের সন্তানের জন্য প্রীতি আছে। তাদের সন্তান এইচ এম এরশাদের বয়স হয়েছে, রোগে-শোকে আক্রান্ত তিনি। জীবনের এটাই হয়তো হতে পারে শেষ নির্বাচন–এমন ধারণা থেকে রংপুরবাসী তার শেষ ইচ্ছে পূরণ করে লাঙল প্রতীককে জয়ী করেছে বলে অনেকে মনে করেন। প্রতীক যে একটা বড় ফ্যাক্টর, সেটা রংপুরে বরাবরই দেখা গেছে। লাঙল নিয়ে ২১ ডিসেম্বরের রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ। রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটা সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে। এক পত্রিকা জিপিএ-৫ দিয়েছে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ নম্বর। ধন্যবাদ শুধু নির্বাচন কমিশনকে দিলে হবে না, রাজনৈতিক দলগুলোকেও দিতে হয়। কারণ তারা সরল পথে থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, নির্বাচনে সহযোগিতা করেছে, বাঁকাপথে হাঁটলে সবই কলুষিত হয়ে যেত।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ এদেশের প্রাচীন দল। আবার বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে তার একক অবদান। সব মিলিয়ে তার কাছ থেকে দেশের মানুষ যে আচরণ আশা করে, তা তারা এই নির্বাচনে পাই পাই করে পালন করেছে। পরাজয় মেনে নিয়ে মোস্তফাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। গণতান্ত্রিক নিয়ম নৈতিকতার পথ অনুসরণ করাও গণতন্ত্র চর্চার শামিল।

অন্যদিকে বিএনপির দুই নেতা দুই কথা বলেছেন। তাদের সজ্জন, সৎ ও নিষ্ঠাবান হিসেবে পরিচিত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন ও ফল মেনে নিয়েছেন। কিন্তু যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন। অবশ্য অতিকথন আর প্রায় সারাক্ষণ মিথ্যা বয়ান দেওয়ার জন্য দেশের মানুষ রিজভী আর গয়েশ্বর রায়ের কথাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। ফরমায়েশি দশ কথার এককথা বলে মনে করে।

আরেকটি মন্দ কাজ করেছেন বিএনপি প্রার্থী কাওছার জামান। তিনি ভোট শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচনের ফল নাকচ করেছেন। তিনি আবার কোনও সুনির্দিষ্ট কারচুপির অভিযোগও উত্থাপন করেননি। তিনি মনে হয় বাইচান্স প্রার্থী হয়েছেন। ভোটের রাজনীতি কিছুই বোঝেন না। গত দফা যে কটা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, মাঝপথে বিএনপি সব কয়টি থেকে প্রার্থী প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিল।

অথচ যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন, তারা কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেখেছেন বেলা ১২টার মধ্যে কোনোখানে কোনও কারচুপির আভাসও  ছিল না। অথচ বিএনপি নির্বাচন থেকে তার প্রার্থী প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিল ১২টার সময়। ফলে যা হওয়ার হয়েছে, কারচুপি হয়েছে। খালি মাঠে কারচুপি হওয়া এই দেশে কী বিচিত্র কোনও ঘটনা! যারা ভোট করেন তারা তো ফেরেশতা নন।

আসলে এটা বিএনপির অরাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ঠুনকো বিষয়েও তারা কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর প্রথম মেয়র নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা ভোটে ইভিএম মেশিন ব্যবহার করবে। বিএনপি বলেছিল ভোট কারচুপির জন্য ইভিএম ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে এবং সে ব্যবস্থা প্রত্যাহার না করলে বিএনপি কুমিল্লার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেনি আর বিএনপিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু বিএনপি প্রার্থী দলের কথা অমান্য করে মেয়র পদে নির্বাচন করেছিলেন আর তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিতও হয়েছিলেন।

ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের রেওয়াজ বিএনপির নেই। এখন বিএনপি নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে এক উকিল নোটিশ দিয়ে বসে আছেন। রাজনৈতিক বক্তব্য রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হয়। এর জন্য উকিল নোটিশের রেওয়াজ প্রবর্তন হলে সম্ভবত রাজনীতিটাই অচল হয়ে যাবে। অথচ তিনি নিজেও কোনও খানে বক্তব্য দিতে গেলে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ এনে কথা বলেন।

রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তফা আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে প্রায় এক লক্ষ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। অনেকে বলছেন, নির্বাচনটা নির্ভেজাল হলেও ফলটা অনুরূপ হলো আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির উপরতলার সমঝোতার কারণে। অনেকে বলছেন, ঝন্টুর সঙ্গে নেতা কর্মীদের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। যে কারণে আওয়ামী লীগকর্মীরা কাজ করেননি। সে কথা অবহেলা করার মতো নয়।

আমরা দেখেছি তৃতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম সিটি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গেও নেতা কর্মীদের দূরত্ব তৈরি হতে। যে কারণে চতুর্থবার মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগকর্মীরা সিংহভাগ তার পক্ষে কাজ করেননি। তিনি হেরেছিলেন ও পরের বার দলীয় নমিনেশনও পাননি। কিন্তু তার অভাব অনুভূত হতে দেরি হয়নি। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেখেছেন অনেকে।

ব্যাপক জনসমর্থন থাকলে কী হবে! ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে এনে ভোট প্রদান করানোর জন্য কর্মীর তো প্রয়োজন রয়েছে। ভোট ক্যাশ করা কঠিন কাজ। রংপুর সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ৩৩জন। প্রতি সিটে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী ছিলেন। একাধিক প্রার্থী না হলে আওয়ামী লীগ ৩০টি আসনে জিতে আসতো। এখনও ১৫ আসনে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে। কর্মীরা ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গে বিভক্ত হয়ে কাজ করেছেন। মেয়রের দিকে কেউ ফিরে তাকাননি।

যেভাবে হোক কারচুপি ছাড়া ভোটে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এরশাদ সামরিক স্বৈরশাসক ছিলেন। প্রথা অনুসারে তিনিও ‘হ্যাঁ’/ ‘না’ ভোট করেছেন। দল গঠন করেছেন। বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে এনেছেন। ইচ্ছামতো নির্বাচনি ফল নিজের অনুকূলে রেখেছেন। সব সামরিক স্বৈরশাসকের দেশ পরিচালনার তরিকা যেরূপ হয় এরশাদেরও অনুরূপ ছিল।

এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন প্রায় ২৭ বছর হলো। এর মাঝে ৪/৫ বছর জেলেও ছিলেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি রাজনীতি ও রাজনীতির ময়দান ত্যাগ করে যাননি। এটা অন্য সামরিক স্বৈরশাসকের চেয়ে তার ভিন্নরূপ। তিনি সংগঠন বুঝেন না তাই সংগঠনের প্রতি যত্নবান নন। না হয় তিনিও পুনরায় ক্ষমতায় আসতেন। রংপুরের নির্বাচনে জেতার আবেগকে কাজে লাগতে জানে কিনা কী জানি? তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটাররা একজন শক্তিশালী পুরুষ রাজনীতিবিদের প্রয়োজন অনুভব করেন।

ধর্মীয় রাজনীতি দেশে কখনও পরিত্যক্ত হবে না। ইসলামী আন্দোলন রংপুর সিটি করপোরেশন এর নির্বাচনে যে প্রার্থী দিয়েছিল তিনিও ২৪ হাজার ভোট পেয়েছেন। নতুন একটা বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী দল সৃষ্টি হওয়া যেমন প্রয়োজন জামায়াতের বিকল্প একটা ইসলামপন্থী দলেরও প্রয়োজন। সম্ভবত সে অভাব ইসলামী আন্দোলন পূরণ করতে পারবে। জামায়াতের মতো হাতকাটা রগ কাটার অভ্যাস তাদের নেই। তারা শান্তিপূর্ণভাবে রাজনীতি করার পক্ষে। মুফতি হান্নান, মওলানা রহমানি প্রমূখের মতো হত্যার রাজনৈতিক দর্শনও তারা বিশ্বাস করে না বলে দাবি করে।

বি চৌধুরী বলেছেন রংপুরের নির্বাচন নাকি প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির জনপ্রিয়তা নিম্নগামী। তারা জনপ্রিয়তা হারালে বি চৌধুরীর কী লাভ! বি চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট তৃতীয় শক্তি হিসেবে কি আত্মপ্রকাশ করতে পারবে? চরমোনাইর পীর সাহেবের দল ইসলামী আন্দোলন কোনও মহিলা নেতৃত্বের সঙ্গে হাত মেলায় না। বি চৌধুরী তো পুরুষ মানুষ, তার উচিত তার ফ্রন্টে ইসলামী আন্দোলনকে আনার চেষ্টা করা।

আওয়ামী লীগ বিএনপি যতই জনপ্রিয়তা হারাক না কেন জাতীয় নির্বাচনে তারাই ময়দান মাত করবে। অবশ্য কোনও তৃতীয়ধারা যদি তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে পারে তবে জাতি তাদেরকে বিবেচনায় নেবে না–তাও নয়। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে জাতি সুযোগও দিয়েছে, তাদের কর্মকাণ্ডও দেখেছে। তারা ছাড়া বিকল্প নেই বলে তাদের ভোট দেয়।

সাপের চোখের আকর্ষণ দেখে বন্যপ্রাণী যেমন তার দিকে দৌড় দেয়, বিবেচনা না করে দৌড় দিলে তো সাপের খোরাকের মতো হতে হবে। জাতি বিশ্বাস সমর্পণ করতে পারে অনুরূপ কোনও শক্তি তো এখনও আত্মপ্রকাশ করেনি। দেখা যাক বি চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট কতটুকু এগিয়ে যেতে পারে। ড. কামাল, বি চৌধুরী, খালেদা জিয়া এরা তো শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। বিকল্প নেতৃত্ব কোথায়! রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্ব কোথায়?

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ