X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষকের অমর্যাদা!

প্রভাষ আমিন
২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৬আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৫১

প্রভাষ আমিন কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ শিরোনামে একটি কবিতা সবারই পড়া। বাদশাহ আলমগীরের ছেলে তার শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছিল। আর শিক্ষক নিজে পা পরিষ্কার করছিলেন। বাদশাহ তা দেখে ফেলায় ভয়ে ছিলেন শিক্ষক। বাদশাহ শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন এবং ছেলেকে আদব-কায়দা না শেখানোয় তাকে ভর্ৎসনা করেন। শিক্ষক বুঝতে পারেননি ভুলটা কোথায় হয়েছে। বিস্মিত শিক্ষককে বাদশাহ জানালেন, কেন তার ছেলে নিজ হাতে শিক্ষকের পায়ের ময়লা পরিষ্কার করে দিচ্ছিল না, তাই তিনি মনে ব্যথা পেয়েছেন। কবিতার শেষ চার লাইন তুলে দিচ্ছি এখানে-
‘উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্নিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,

সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’

এই কবিতা থেকে আমরা কী শিক্ষা পেয়েছি? আসলে আমরা উল্টো শিক্ষা পেয়েছি। শিক্ষকের মর্যাদা দিতে পারিনি। পেরেছি শিক্ষকের অমর্যাদা দিতে। যাদের থাকার কথা ক্লাসরুমে। দুদিন পরপরই দেখি সেই শিক্ষকরা আন্দোলনে নামেন। দাবি আদায়ে কখনও আমরণ অনশন, কখনও অবস্থান ধর্মঘট। দাবি আদায় করতে এসে শিক্ষকরা পুলিশের পিটুনিও খেয়েছেন। সব দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে, অর্থে, সম্মানে, মর্যাদায় শিক্ষকতা পেশাটিই আছে তলানিতে। অথচ শিক্ষকদের থাকার কথা সমাজের সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে। মুখে মুখে আমরা যতই শিক্ষকদের মর্যাদার কথা বলি না কেন, বাস্তবে কিন্তু উল্টো। এমন তো নয় যে শুধু মুখে মুখে মর্যাদার কথা বললেই শিক্ষকদের পেট ভরবে, তাদের ভরণপোষণ হবে, সন্তানের পড়ালেখা হবে। তাদেরও তো পরিবার নিয়ে একটা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করার মতো অর্থ লাগবে। যখন শুনি একজন শিক্ষক ক্লাস নেওয়া শেষে বাকি সময়টা কৃষিকাজ করেন, তখন খারাপ লাগে। কৃষিকাজ খারাপ সেটা বলছি না। কিন্তু একজন শিক্ষকের তার ছাত্রের মেধার বিকাশ, তাদের নৈতিক উন্নয়ন নিয়ে ভাবার কথা। কিন্তু তিনি যদি পেটের ভাত জোগাড় করতেই হিমশিম খান, তাহলে কখন তিনি শিক্ষার্থীদের কথা ভাববেন।

একজন মানুষের জীবনে পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকের গুরুত্ব। শিশুর হাতেখড়ি হয় শিক্ষকের হাতে। শিক্ষকের দেওয়া শিক্ষা শিশুর মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। তারা যেভাবে একটি শিশুকে গড়ে দেবেন, সেভাবেই এগুবে তার জীবনভাবনা। কিন্তু সবচেয়ে অবহেলিত এই প্রাথমিক শিক্ষকরাই। তারপর স্কুলের শিক্ষক, তারপর কলেজের, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের- এভাবে ধাপে ধাপে অবহেলা বিরাজমান। শিক্ষকদের মধ্যেও বৈষম্যের নানা ধরন আছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা একরকম, নন-এমপিওভুক্তরা আরেকরকম। অবহেলায় রকমফের আছে, কিন্তু অবহেলার কোনও কমতি নেই।

প্রশিক্ষিত প্রাথমিক শিক্ষকরা তিনদিন আমরণ অনশন শেষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীর আশ্বাস নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে তাদের। যদিও তারা যেতে চাননি। নেতাদের প্রতি ক্ষোভ নিয়েই তারা ফিরে গেছেন। তারা চেয়েছিলেন, দাবি আদায়ের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তারা অনশন চালিয়ে যাবেন। প্রয়োজনে মরে যাবেন, কিন্তু দাবি আদায় না করে ঘরে ফিরবেন না। কিন্তু মন্ত্রী শুধু আলোচনার আশ্বাস দিয়েছেন। তার মানে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ হবে আরও। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি কিন্তু সহজ। তারা মন্ত্রী-এমপি-সচিবের মর্যাদা চায়নি। তারা চেয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কমিয়ে আনতে। শিক্ষাগত যোগ্যতা এক হওয়ার পরও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের বেতনে বৈষম্য আছে এবং ক্রমশ বাড়ছে। তবে ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এটা ছিল না। এরপর ১৯৮৫ সালে এক ধাপ, ২০০৬ সালে দুই ধাপ এবং ২০১৪ সালে থেকে তিন ধাপের পার্থক্য তৈরি করা হয়েছে। এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান একাদশ গ্রেডে। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকরা পান চতুর্দশ গ্রেডে। বর্তমান নিয়মে একজন প্রধান শিক্ষক বেতন স্কেলের দ্বাদশ গ্রেডে চাকরি শুরু করেন। আর সহকারী শিক্ষকরা ১৬ বছর চাকরি করে শেষ করেন সেই গ্রেডে। এই তিন গ্রেডের পার্থক্য নিয়ে সহকারী শিক্ষকদেও ক্ষোভ ছিল অনেকদিন ধরেই। তবে প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল দশম গ্রেডে উন্নীত করার উদ্যোগেই বিস্ফোরণ ঘটেছে সহকারী শিক্ষকদের। প্রধান শিক্ষকরা দশম গ্রেডে উন্নীত হলেও সহকারী শিক্ষকরা থাকবেন চতুর্দশ গ্রেডেই। তার মানে তাদের মধ্যে পার্থক্য হবে চার ধাপ। প্রধান শিক্ষকদের গ্রেড বাড়লে সহকারী শিক্ষকদের আপত্তি নেই। সহকারী শিক্ষকরা খালি চান তাদের যেন প্রধান শিক্ষকদের এক ধাপ নিচে রাখা হয়। প্রধান শিক্ষকদের যদি দশম গ্রেডে উন্নীত করা হয়, তাহলে তাদেরও যেন একাদশ গ্রেডে উন্নীত করা হয়। প্রধান শিক্ষকরা দশম গ্রেডে যাবেন আর সহকারী শিক্ষকরা থাকবেন চতুর্দশ গ্রেডে। আমার আশঙ্কা, সহকারী শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে এখন প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেডে তুলে আনার উদ্যোগও থেমে যাবে। বঞ্চিত হবে প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষক সবাই।

সহকারী শিক্ষকদের দাবি মেনে নিলেই কি শিক্ষকদের সব সমস্যা মিটে যাবে? তা কিন্তু নয়। চতুর্দশ গ্রেডে সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১০ হাজার ২০০ টাকা। আর একাদশ গ্রেডে প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১২ হাজার ৫০০ টাকা। প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেডে উন্নীত করলে তাদের বেতন স্কেল দাঁড়াবে ১৬ হাজার টাকা। শিক্ষকরা সমাজের সর্বত্রই সম্মানিত। সেই সম্মান রক্ষায় তারা প্রাণপণে মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করার চেষ্টা করেন। তাদের সমস্যা হলো, শিক্ষক হিসেবে তারা হাত পাততে পারেন না, ত্রাণ নিতে পারেন না, ন্যায্যমূল্যের চালের লাইনে দাঁড়াতে পারেন না। কিন্তু তাদের ক্ষুধা তো আর সবার মতই। একবার ভেবে দেখুন, বেসরকারি অনেক অফিসের ড্রাইভার-পিয়নের বেতনও একজন শিক্ষকের চেয়ে বেশি।

এতক্ষণ তো কথা হলো, সরকারি শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া-বঞ্চনা নিয়ে। কিন্তু সহকারী শিক্ষকরা ক্ষোভ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ারা পরদিনই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাবি নিয়ে হাজির হন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। তাদের দাবি এমপিওভুক্তির। দেশে এখন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সাড়ে ২৬ হাজার। এগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারি আছে ৪ লাখেরও বেশি। এছাড়া সরকারি স্বীকৃতি আছে, কিন্তু এমপিওর বাইরে আছে আরও ৫ হাজার ২৪২টি প্রতিষ্ঠান। এগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারি আছেন প্রায় ৮০ হাজার। এই ৮০ হাজার শিক্ষক আসলে কিছুই পান না। তারা শিক্ষকতা করেন, এটুকুই সান্ত্বনা। তারা চলেন পেটে ভাতে। তারা সবাই কাজীর গরু; কেতাবে আছেন, গোয়ালে নাই।

এই লেখা যখন লিখছি, তখন এমপিওভুক্ত দুই শিক্ষক এলেন অফিসে। তাদের অভিযোগ, এমপিওভুক্তির ৮ বছর পর তারা একটি উচ্চতর টাইম স্কেল পেতেন। কিন্তু সেটি এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

তার মানে দেখুন প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক, এমপিওভুক্ত শিক্ষক, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছে সবারই। বাংলাদেশে শিক্ষকরা শুধু পাঠদান করেন না। ভোটার তালিকা করা, নির্বাচন করা, টিকা দান কর্মসূচি, সরকারের জরিপ নানা কাজে লাগানো হয় তাদের। সবকিছুই করানো হয়, কিন্তু সুবিধা পায় সবচেয়ে কম। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু সেই মেরুদণ্ডের মূলস্তম্ভকে এভাবে ভেঙে দিয়ে, শিক্ষকদের পদে পদে তলানিতে রেখে আপনি জাতিকে এগিয়ে নেবেন; এটা আশা করা ভুল। আপনি যদি আপনার সন্তানকে সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান, নৈতিকভাবে উচ্চতর শিক্ষা দিতে চান; তাহলে আগে শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে হবে। আর সেই মর্যাদা শুধু মুখে মুখে দিলে হবে না; তাদের একটা সম্মানজনক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সমস্যাটা হলো যারা নীতিনির্ধারণ করেন, তাতের সন্তানদের কেউ সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ে না। তাই তারা তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষকদের বেদনাটা বোঝেন না, অমর্যাদাটা অনুভব করেন না। তাই তারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে মাঝে মধ্যে ঢাকায় চলে আসেন; অনশন করেন, আন্দোলন করেন।

শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ। শিক্ষামন্ত্রী তো প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্যও শিক্ষকদের দায়ী করেছেন। তারা ক্লাসরুমে না পড়িয়ে কোচিং করান। লাখ লাখ শিক্ষকের মধ্যে সবাই ভালো হবেন, এমন আশা করা ভুল। তবে হাত পা বেধে সাঁতার কাটতে বলা আর টাকা না দিয়ে তাদের কাছে উচ্চ নৈতিকতা আশা করাও ভুল। আমাদের শহুরে লুটেরারা ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা  লুটে নেন; গোটা ব্যাংক গিলে ফেলেন। সেই তুলনায় শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া, অর্থমন্ত্রীর ভাষায়- ‘নস্যি’।

তাই ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার মতো তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই তারা একটি শিক্ষিত, উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তুলবে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি বা জিডিপি দিয়ে দেশের অগ্রগতি মাপাটা একটা বড় ভুল। জাতির সত্যিকারের অগ্রগতি নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। সেটা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবো, ততই মঙ্গল।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ