X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা: তারেক কি বিএনপির জন্য বোঝা?

স্বদেশ রায়
২৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:১৬আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৩৬

স্বদেশ রায় ১০ বছরের বেশি হতে চললো তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। কোনও রাজনৈতিক দলের জন্য অপরিহার্য কোনও নেতা এভাবে গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটান না। বরং দেশে ফিরে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তিনি আরও বেশি জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেন। তারেক রহমান নিজে সে পথে চলছেন না, তার দলও এ বিষয়ে মোটেই আগ্রহী নয়। এর পেছনে আসলে কী রহস্য কাজ করছে?
তারেক রহমান যে সময়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে হাওয়া ভবনে বসে দেশ ও সরকার চালাচ্ছেন, সে সময়ে ব্যক্তিগত আলোচনায় খুবই ডিপ্লোম্যাটিক ভাষায় পশ্চিমা কিছু কূটনীতিক এমনটি বলেতেন— তাদের দেশের জনগণ কখনও এই ধরনের ব্যক্তিকে গণতান্ত্রিক দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পছন্দ করে না। বাংলাদেশের অনেক সিনিয়র সম্পাদকও ব্যক্তিগত আলোচনায় দুঃখপ্রকাশ করে বলেছেন, তারেক রহমান তাদের ডাকিয়ে নিয়ে যেভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাওয়া ভবনে বসিয়ে রেখেছেন, এমনটি তার মা তাদের সঙ্গে কখনও করেননি। তাদের মুখে এ কথা শুনে আতঙ্কিত হয়েছি। ভেবেছি, কোনোভাবে যদি এ ধরনের ব্যক্তি বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হন, তাহলে সাংবাদিকতা পেশা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
ওই সময়ে চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নির্বাচনে হারানোর জন্যে তারেক রহমান নিজে চট্টগ্রামে বসে নির্বাচনে কারচুপি করার চেষ্টা করছিলেন। আর তার বিপরীতে মহিউদ্দিন চৌধুরী নির্বাচন বিপ্লব ও গণবিপ্লব অর্থাৎ হাজার হাজার মানুষ দিয়ে প্রতিটি কেন্দ্র ঘিরে রেখে ফল ঘোষণা করান ও বিজয়ী হন। মহিউদ্দিন চৌধুরী যে সময়ে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ওই সময়ে তারেক রহমান চট্টগ্রাম থেকে বলতে গেলে পালিয়ে আসেন। এর কয়েকদিন পরে একজন পশ্চিমা কূটনীতিক আকার-ইঙ্গিতে যা বলেছিলেন তা এমন— বিএনপি ক্ষমতায় এলে তার দেশের আপত্তি করার কোনও কারণ নেই, তবে তারেক রহমানকে তার দেশ সরকারপ্রধান হিসেবে মানবে না।
পশ্চিমা অনেক দেশের এই মনোভাব, এমনকি প্রতিবেশী একটি দেশসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের একই মনোভাব বুঝতে পেরে সে সময়ে লিখেছিলাম, ‘তারেক রহমান কোনোদিন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হবেন না।’ কারণ, বর্তমান সময়ে প্রতিটি দেশই গ্লোবাল ভিলেজের অংশ। তাই বিশ্ব রাজনীতির হিসাব-নিকাশকে উপেক্ষা করে ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন। অনেকে বলতে পারেন— নরেন্দ্র মোদিরও তো আমেরিকা ভ্রমণের ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল, তিনি কিভাবে ভারতের সরকারপ্রধান হতে পারলেন? যারা রাজনীতির খোঁজ-খবর রাখেন, তারা সবাই জানেন, ভারতে গত নির্বাচনের আগে পশ্চিমা বিশ্বের কী বিপুল সমর্থন বিজেপি’র প্রতি ছিল। তবে নরেন্দ্র মোদির ওপর আমেরিকার যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা ছিল শুধু মানবাধিকার প্রশ্নে, প্রেসিডেন্টের আদেশে নয়।
অন্যদিকে সম্প্রতি উইকিলিকসে ফাঁস করে দেওয়া বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার সাবেক অ্যাম্বাসেডর জেমস এফ মরিয়র্টির ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর পাঠানো একটি রিপোর্ট অনেকেই পেয়েছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তারেক রহমানকে (তারেক নামে বেশি পরিচিত, জন্ম ২০ নভেম্বর, ১৯৬৭, বাংলাদেশ) আমেরিকার ইমিগ্রেশেন ও ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ২১২ (এফ)-এর আওতায় এবং প্রেসিডেন্সিয়াল প্রোক্লেমেশান ৭৭৫০-এর আওতায় আমেরিকায় প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্যে সুপারিশ করা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, দূতাবাস বিশ্বাস করে, তারেক রহমান খুবই খারাপ ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত একজন রাজনীতিবিদ। তাকে আমেরিকায় ঢুকতে দিলে আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমেরিকার ইমিগ্রেশান ও ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ২১২ (এফ) ১৯৫২ সালে প্রণীত। অর্থাৎ তাদের ১৮৮২ সালের ইমিগ্রেশান আইনে এটা যোগ হয় ১৯৫২ সালে। এখানে বলা হয়েছে, যদি কোনও বিদেশি নাগরিক আমেরিকার জন্যে ক্ষতির কারণ হন, তাহলে প্রেসিডেন্ট আমেরিকায় তার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবেন। অন্যদিকে ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্সিয়াল প্রোক্লেমেশন ৭৭৫০ জারি করেন প্রেসিডেন্ট জে ডাব্লিউ বুশ।
এই প্রোক্লেমেশন জারির ভূমিকা হিসেবে বলা হয়, বর্তমানের মুক্ত বাণিজ্যের পৃথিবীতে বিশ্বশান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে আমেরিকার পাবলিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে শক্তিশালী করতে দুর্নীতিমুক্ত রাখার স্বার্থে এই আইন প্রণীত হচ্ছে। এখানে এই প্রোক্লেমেশনের আটটি সেকশান আছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার অ্যাম্বাসেডর জে এফ মরিয়র্টি তার রিপোর্টে তারেক রহমান সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, এই প্রোক্লেমেশনের সেকশন ৪ অনুযায়ী তারেক রহমানকে আমেরিকায় প্রবেশ করতে দেওয়া যায় না। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, তারেক রহমান আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ। সেকশন ৪-এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, সেই সব ব্যক্তিদের জন্যে এই নিষেধাজ্ঞা, যারা আমেরিকার স্বার্থের জন্যে মারত্মক ক্ষতিকারক। আমেরিকার স্বার্থের অর্থাৎ আমেরিকার আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা, বিদেশি সাহায্য লক্ষ্য ও আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য যারা হুমকি; আমেরিকায় যারা অপরাধ ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিতে পারে এবং সর্বোপরি আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যারা হুমকির কারণ। এ থেকে স্পষ্ট, সেকশন ৪-এ যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তারেক রহমানের মধ্যে সেই বিষয়গুলো রয়েছে বিবেচনা করেই তৎকালীন অ্যাম্বাসেডর তার দেশকে সেই অনুযায়ী রিপোর্ট করেছিলেন। এদিকে, প্রতিবেশী ও এশীয় দেশগুলো তাদের অর্থনীতির জন্যে ক্ষতির কারণ মনে না করলেও তারেক রহমানকে সন্ত্রাস প্রসঙ্গে ভয়ংকর ব্যক্তি হিসেবে মনে করে তারা। আর শেষ অবধি সন্ত্রাস অর্থনীতিকে ধ্বংসই করে দেয়।
মরিয়র্টি তার রিপোর্টে তারেক রহমানকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি নটরিয়াস এবং ওয়াইডলি ফিয়ার্ড; অর্থাৎ খুবই খারাপ প্রকৃতির একজন। তিনি প্রায়ই বিভিন্ন সরকারি কেনাকাটা থেকে অর্থ নিতেন। অ্যাম্বাসি বিশ্বাস করে, তারেক রহমানের বেশ কয়েকটি পাসপোর্ট রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশি বেশ কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ মার্কিন ডলার ঘুষ নিয়েছেন তারেক। এছাড়া তারেক ও তার ভাই কোকো সিমেন্সের কাছ থেকে ২ পার্সেন্ট ও হারবিয়ান কোম্পানির কাছ থেকে সাড়ে সাত লাখ ডলার ঘুষ নিয়েছেন। আবার একটি বড় কোম্পানির মালিকের ছেলেকে তার কর্মকর্তাকে খুন করার মামলা থেকে রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়ে ৩১ লাখ ডলার ঘুষ নিয়েছেন। তারা জিয়া অরফানেজ থেকে লুট করেছেন দুই কোটি টাকা। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সব কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলেও ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছে।
মরিয়টির এই রিপোর্ট নিশ্চয়ই তারেক রহমান সম্পর্কে আমেরিকার অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে যে ব্রিটেনে তিনি আছেন, সেখানে তিনি ইনকাম ট্যাক্স ফাইলে তার আয়ের উৎস হিসেবে কী দেখাচ্ছেন, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। তাছাড়া ব্রিটেনে তারেক রহমানের কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসবাদের পক্ষে— এমন বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেশী কয়েকটি রাষ্ট্রের চাপও রয়েছে ব্রিটেনের ওপর।
এই বিষয়গুলো বিএনপির সাধারণ কর্মীরা হয়তো জানে না, তবে বিএনপির উচ্চশিক্ষিত সব নেতা জানেন। এমনকি মরিয়র্টিসহ আমেরিকার অন্য রাষ্ট্রদূতরাও বিএনপির অনেক নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। তাই তারাও তারেক রহমানকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে বিব্রত। কেবল বেগম জিয়ার কারণে তারা কোনও কথা বলতে পারেন না। তবে যতই দিন যাচ্ছে, ততই তারেক রহমানের কর্মকাণ্ড ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সম্প্রতি তারেক রহমানের কিছু ভিডিও ক্লিপ সোস্যাল মিডিয়ায় এসেছে। সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যেভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, তা তরুণ প্রজন্মের অনেকেই পছন্দ করছে না। সব মিলিয়ে এখন এমন প্রশ্নই স্বাভাবিক— তারেক রহমান কি এখন বিএনপির সম্পদ, নাকি তাদের জন্যে এমন একটি বোঝা যা তারা ফেলে দিতে চায় কিন্তু ফেলতে পারছে না।
লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

/টিআর/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ