X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধ্রুপদী সন্ধ্যায় রবাহুত যারা

শেগুফতা শারমিন
৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৮আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:০২

শেগুফতা শারমিন ‘বাসায় যাবো। ক্ষিধা পাইছে। ঘুমাবো। বাসায় চলো। আর কতক্ষণ? ভাল্লাগেনা’।
ছয় সাত বছরের এক শিশু করুণ গলায় একটানা বলে যাচ্ছে। মা-বাবার কাছে। মা-বাবা পাত্তাও দিচ্ছেন না। অথবা কখনও কখনও থামানোর জন্য বলে যাচ্ছেন, এইতো আর একটু বাবা আর একটু। নিয়ে যাচ্ছেন আইসক্রিম কিনে দিতে। রাত তখন সাড়ে এগারোটা। আকাশে বড় চাঁদ। খোলা মাঠে সামিয়ানা টানা। চলছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব। কয়েক হাজার দর্শকের সঙ্গে এই শিশুটিও একজন দর্শক। এসেছেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে, সারা রাত জেগে।
শিশুটির ঘুম পাচ্ছে। মা তার পাশে বসে বিরাট বিরক্ত, শিশুর প্রতি আর তার বাবার প্রতি। তিনি চেয়েছিলেন সন্ধ্যা রাতে ঘুমিয়ে খেয়ে দেয়ে বেশ রাত হলে আসবেন। কিন্তু শিশুর বাবা সন্ধ্যা রাতেই নিয়ে এসেছেন। একরাশ বিরক্তি ঝেড়ে তিনি মন দিলেন পাশের সিটে বসা আত্মীয়ের সাথে জমি  কেনা সংক্রান্ত আলোচনায়। কাঠাপ্রতি রেজিস্ট্রেশন ফি কত, ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও মঞ্চে তখন বাজছে বিশ্ব মোহন ভাটের মোহন বীণা।

কিছুক্ষণ পর শুনি দু’চেয়ার পরে একজনের ফোনালাপ। কারো জন্য হয়তো অপেক্ষা করছেন ভদ্রলোক (!), একটা সিট পাশে খালি রেখে। সেই মানুষটি মনে হয় দেরি করছেন বা খুঁজে পাচ্ছেন না এই লোককে। ঘটনা যাই হোক ফোনের এ প্রান্তের দর্শকটি যে ভাষায় কথা বলছেন। যে খিস্তি উচ্চারণ করে আরেকজনকে সম্বোধন করছে, এত অশ্রাব্য শব্দ আমার নিজ কানে সেই প্রথম শোনা। যদিও তখন প্রথমবারের মতোই শুনছিলাম ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের খেয়াল, সরাসরি। মঞ্চে খেয়াল বাজে, দুই সিট পরে বাজে খিস্তি। খিস্তিওয়ালাও শ্রোতা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের!

রাত বাড়ে, শেষ রাতে মূল আকর্ষণ চৌরাসিয়ার বাঁশি। চৌরাসিয়াকে আমরা আসলে তার বাঁশি শুনে চিনিনি। আমাদেরকে চৌরাসিয়া চিনিয়েছে সুমন। তো সুমনের গানে শুনে শুনে আমরা চৌরাসিয়ার ভক্ত। চৌরাসিয়া মঞ্চে উঠবেন সবার শেষে। ততক্ষণ থাকতে হলে, নিজের সকালটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সূর্য উঠলেই আফিস। অতএব জাগতিক বাস্তবতার টানে যতরকম শৈল্পিক আকর্ষণ পেছনে ফেলে ওঠে পড়ি, ঘরে ফিরতে, উবারে। উবারের চালক জানতে চান কে এখন মঞ্চে। এক কথায় দুকথায় বোঝা যায়, তিনি বিরাট সমঝদার গানের। নিজেই বলেন, রাতে গাড়ি চালাই। তাই ভেতরে ঢুকতে পারি না, গাড়ি ফেলে রেখে। তবে আশেপাশ দিয়েই থাকি। ভালো লাগে। এই যে এত মানুষ আসে, সবাই যে গান শুনতে আসে, তা না। তবে তারা যে একেকজন পণ্ডিতের নাম শিখছেন এই আয়োজন থেকে তাই বা কম কী!

গত কয়েক বছর জুড়েই বেঙ্গল ফাউন্ডেশন খুব সুন্দরভাবে আয়োজন করছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব। যে দেশে একসময় জাতীয় টেলিভিশনের সাপ্তাহিক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পরিবেশনার অংশটুকু ছিল সবচেয়ে অনাকর্ষণীয়। সে সময় টি আর পি রেটিং নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে দেখা যেত, সবচেয়ে কম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সুরলহরী নামের সেই আয়োজন। সেই দেশে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে হাজার হাজার মানুষ, রাতের পর রাত জেগে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে যাচ্ছেন, এ এক বিস্ময়ই বটে। বলা যায় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের সবচেয়ে বেশি শ্রোতা বাংলাদেশে। এর মানে কি  কোনোরকম ওরিয়েন্টশন ছাড়াই এদেশের হাজার হাজার মানুষ বোদ্ধা হয়ে গিয়েছে? সম্ভবত বিষয়টা তেমন না। বিষয় হলো সেই উবার চালকটির মতো বা তার চেয়ে বেশি সংগীত সমঝদার এদেশে সব সময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায়। পেশাগত জীবনে যাই করেননা কেন, আর্থিক সঙ্গতি যাই হোক না কেন। কাজ ফেলে উৎসবে যাওয়ার বিলাসিতা থাকুক বা না থাকুক। আবার অন্যদিকে নানা বয়সী, নানা পেশার, নানা রুচির, নানা ঘরানার মানুষ হাজারে হাজারে এই রকম উৎসবে আসবেও, সে যতই গান বুঝুক বা না বুঝুক।

আসবে কারণ, আমাদের অপশন কম। আসবে, কারণ আমাদের প্যাশন অনুযায়ী কিছু করার সুযোগ কম বলে। শুধু তাই না, এই কয়েক কোটি মানুষের শহরে নেই পর্যাপ্ত বিনোদনের সুযোগ। না শিশুদের, না বড়দের। তাই মানুষ সুযোগ পেলেই ছোটে এমন জায়গায়, যেটা আদৌ তার আগ্রহের জায়গা না। অনেক দর্শককে একসঙ্গে দেখলে সংখ্যাগত দিক থেকে আমরা আয়োজনের সার্থকতা ধরে নেই। অথচ অপ্রাসঙ্গিক দর্শক প্রাসঙ্গিক দর্শককে বিরক্ত করতে পারে কিনা সেই গুণগত মান বিচারের ধার ধারি না।

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবে গেলে মনে হয়, শুধু পাঁচদিন নয়, বাকি তিনশ’ ষাট দিনও যদি এরকম আয়োজন করা হয়, এরকম নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং পরিকল্পিত। তাহলেও দর্শক যাবে। প্রতিদিনই যাবে, হাজারে হাজারেই যাবে। এখানে গান গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ মানুষের একটু শ্বাস নেওয়ার জায়গা পাওয়ার সুযোগ। এই যে শুরুতে যেই পরিবারের কথা বললাম। বাবার অফিস শেষে, মায়ের সারাদিনের গৃহকর্ম শেষে পরিবারের শিশুদের নিয়ে একদণ্ড ফুরসতের জন্য কোথাও যেতে চাইলে, ধরা বাঁধা জায়গা সেই খুপড়ি রেস্টুরেন্ট। তার বদলে পাঁচদিন যদি এমন একটি সুযোগ পাওয়াই যাই, তাইলে তারা কেন যাবে না? সে তখন উচ্চাঙ্গই হোক না যাই হোক। খোলা মাঠ, লাইট, সাউন্ড, চকচকে মানুষজন, খাওয়া দাওয়া। সর্বোপরি নিরাপত্তা।

এই ঢাকা শহরে যদি একই দিনে কোথাও উচ্চাঙ্গ, কোথাও ব্যান্ড, কোথাও গণসংগীত বা পল্লীগীতির আয়োজন করা হয়। অথবা কোথাও যদি একটা খালি মাঠ শুধু খাওয়া দাওয়া ঘোরা ফেরার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বেঙ্গল যেভাবে আয়োজন করে, সেভাবে সুশৃঙ্খল রেখে, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বজায় রেখে দেখা হোক। দেখা যাবে সব জায়গাতেই উপচে পড়া ভীড়। মানুষ তখন বেছে নিতে পারবে, যে যা পছন্দ করে সেই আয়োজন। উচ্চাঙ্গ সংগীতের শ্রোতাকে তখন পাশের সিট থেকে শুনতে হবে না উচ্চাঙ্গের খিস্তি, বা জমি বিক্রির সাতকাহন।

এ শহরের মানুষের বিনোদন দরকার। তার পছন্দ, রুচি অনুযায়ী বিনোদনের জোগান দরকার। সবার জন্য সব কিছু নয়, যেমন সত্যি। তেমন সবার জন্য সব কিছুর ব্যবস্থা থাকাটাও অনস্বীকার্য। সবার জন্য যখন একটাই আয়োজন এবং তা ধ্রুপদী সংগীতের আয়োজন। হয়তো মানুষ যায়, আর কিছু পায় না বলে। কিন্তু তা কতটা ধ্রুপদী সঙ্গীতের মর্যাদা বাড়ায় কে জানে। এমন দিন আসুক, মানুষ যেখানেই যাক, যাই করুক ভালোলাগা থেকে যাক, ভালোবেসে থেকে করুক। রব শুনে নয়।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ