X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আমরা কী বুঝেছিলাম?

রেজা সেলিম
০৫ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩:৪১আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:৩০

রেজা সেলিম ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর দিন বদলের সনদে যেদিন ঘোষণা করা হলো, ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা হবে, এই কথা শুনে সেদিন আমরা কী বুঝেছিলাম? নিশ্চয়ই এই রূপকল্পের কোনও তাত্ত্বিক কাঠামো সে ঘোষণায় ছিল না, বা শেখ হাসিনা কিছু না বুঝেই এই স্বপ্নের কথা তার ভোটের অঙ্গীকারের অংশ করে নেননি। কিন্তু আমরা যারা বহুদিন যাবত তথ্য-প্রযুক্তির সীমাহীন সম্ভাবনার স্বপ্নের জগতে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, আমরা ভেবে নিলাম এখন সরকার যদি এ কাজে সত্যি সত্যি সচল হয়, আমাদের স্বপ্ন বাস্তবরূপ নেবে, সেখানে আপাতত কোনও রূপের কাঠামো থাকুক বা না থাকুক।

যে স্বপ্নের জগতে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তা মোটেও অবাস্তব ছিল না। এই স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছেন মোস্তাফা জব্বার, সেই আশির দশকে যখন বাংলা হরফে কম্পিউটারে লেখা শুরু করলেন। এর পরে যুক্ত হলেন কম্পিউটার জগতের কাদের ভাই, আর অগ্রজ সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তান, যারা এই স্বপ্নকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিলেন গরীবের জন্যে প্রযুক্তির সেবা হিসেবে। তাদের এই সৃজনশীল অনুপ্রেরণায় আমরা ভাবতাম- এই দেশের সবাই একদিন ডিজিটাল প্রযুক্তির সেবা পাবে।  আমরা ভাবতে শুরু করলাম কেউ যদি কম্পিউটার না-ও কিনতে পারে, সে অবশ্যই কম্পিউটার কী কী কাজ করে তা বুঝতে পারবে ও তার ছেলেমেয়েদের কাছে গল্প করতে পারবে। একজন দরিদ্র কৃষক বা দিন-মজুর পিতা-মাতার পক্ষে সে সময় ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ করে কম্পিউটার কিনে দেওয়া অসম্ভব ছিল (এখনও অনেকের পক্ষে তা অসম্ভব)। কিন্তু আমরা যদি গ্রামে গ্রামে এমন ব্যবস্থা করে নিতে পারি যে, সবাই কম্পিউটার দেখতে, ছুঁয়ে দেখতে ও ব্যবহার শিখে নিতে পারবে। তাহলে ঘরে ঘরে কম্পিউটার পরিচিত হবে ও একটি প্রজন্ম জীবনের শুরু থেকেই এই প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে খাঁপ খাইয়ে নিতে অভ্যস্ত হবে। ২০০৮ সালে যে শিশুর বয়স পাঁচ, ২০২১ সালে তার বয়স হবে ১৮। মাঝখানের এই ১৩ বছরে তাদের পাশাপাশি যাদের বয়স প্রতি বছর পাঁচ হবে, তাদের হালশুমারি হাতে রেখে ক্রমে ক্রমে ১২, ১১, ১০, ৯ করে করে কমিয়ে এনে এনে ২০২০-২১ সালে আমরা গ্রামের ছেলেমেয়েদের কোথায় পৌঁছে দিতে পারবো, ভেবে কয়েকটি রাত ঘুমাতে পারিনি।   

একদিন এসব শুনে মোস্তাফা জব্বার ভাই উৎসাহ দিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়েই এই স্বপ্ন বাস্তব করতে হবে। তুমি লেনিনের অফিসে আসো, আমরা সব প্ল্যান ঠিক করে নেই।’

আমার রাজনৈতিক জগতের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র হাসান মাহমুদ-ই শেখ হাসিনার কাছে এসব বার্তা তুলে ধরতেন। ২০০৪ সাল থেকে আমি আর হাসান মাহমুদ কেমন করে তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে গ্রামে গ্রামে কাজ করা যায়, তা নিয়ে আলাপ করে আমাদের পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিলাম। যদিও সেসবই ছিল আমাদের স্বপ্নের অংশ। তার মাধ্যমে আমি নিজেও বেশ কয়েকবার ডাক পেয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে তথ্য-প্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে সুধা সদনে কথা বলতে গেছি। ব্যাখ্যা করেছি, কেমন করে আমাদের ‘এক্সেস’ বাড়াতে হবে, রামপালের উদাহরণ তুলে ধরে বলেছি, মানুষ বিষয়টা আগে বুঝতে চায়। শেখ হাসিনা আমাকে বললেন, ‘‘শুধু ‘এক্সেস’ দিয়ে হবে না, ‘এফরডেবল’-ও হতে হবে।’’ আমি আমাদের নিত্যদিনের প্রযুক্তি-কাজের সুপরিচিত এই‘এফরডেবল’ বা ‘সাশ্রয়ী’ শব্দটি তার মুখে শুনে সেদিন চমকে উঠেছিলাম। 
আমাদের অগ্রজ রাজনীতিক, যাকে আদর্শ বলেই জ্ঞান করি নূহ-উল আলম লেনিন ভাইয়ের সঙ্গে  এই নিয়ে আলাপ করতাম। শেষতক লেনিন ভাই একটা সেল গঠন করলেন, আমি আর মুনির হাসান মাঠের গল্প আর অভিজ্ঞতা এনে সিই সেল গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। আমাদের সাধ্যমতো গড়ে তুলেছি ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্যে রিসোর্স সেন্টার, যেখানে সব পাওয়া যাবে। আমরা উপলব্ধি করলাম চাষী-মজুর থেকে শিক্ষিত-দরিদ্র সবাই সেখানে সমান অংশ নেবে। নতুন নতুন ভাবনা এনে জমাতে হবে আর তা ছড়িয়ে দিতে হবে সারাদেশে। একদিন মাহবুবুল হক শাকিল আমার কাছে জানতে চাইলো,‘ভাই, ডিজিটাল বাংলাদেশে নাকি আপনারা ড্রাইভার-হেলপারদেরও যুক্ত করবেন? ক্যামনে?’  

আমি বললাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ শুধু কি কম্পিউটার? এটা তো রূপকল্প। আপনি এমন এক বাংলাদেশের কল্পনা করেন যেখানে কোনও ড্রাইভার বেপরোয়া গাড়ি চালাবে না। কোনও হেলপার যাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে না, অন্যায্য ভাড়া নেবে না। গাড়ি, ট্রেন, বাস, লঞ্চ ছাড়বে সব নিয়ম মতো। পথে-ঘাটে মানুষের কোনও ভোগান্তি থাকবে না। সেই বাংলাদেশে কোনও প্রসূতি মাতা যানজটে থেকে শেষে পথে সন্তান প্রসব করবে না। কোনও ফাইল কোথাও আটকে থাকবে না। আপনার আমার বাবা বা আমাদের স্কুলের শিক্ষক অবসরে গেলে তার পেনশন পেতে কোনও হয়রানি হতে হবে না। ছেলেরা মেয়েদের স্কুলের সামনে বসে থেকে শিস দেবে না। কারণ, সে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সীমাহীন শক্তি সম্পর্কে জেনে গেছে। এখন তার অনেক চিন্তা, তাকে একটা নতুন বাংলাদেশ গড়তে কাজ করতে হচ্ছে।

আমার মনে পড়ছে শাকিলের মুখটা, অবাক হয়ে শুনছিল আর বলেছিল, ‘এইটা হবে ভাই, এইটাই তো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা!’  
২০০৯ সালের মে মাসে একদিন মুনীর হাসান আমাকে বলল, ‘রেজা ভাই, ওনারা ডিজিটাল বাংলাদেশ কী বলে, আর আমরা কী বলি, মিলতেছে না!’ জব্বার ভাই তার লেখা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামের একটা বই আমাকে দিয়ে বললেন, ‘দেখো, তোমাদের চিন্তার সঙ্গে আমার কলমের মিল খুঁজে পাও কিনা!’  তিনি আমাদের কিছুতেই থামতে দিলেন না, বললেন, ‘যার যেই ভাবনা সেটা নিয়েই কাজ করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ শুধু কম্পিউটার দিয়ে রাতারাতি হবে না, এটা সবাইকে বুঝতে হবে।’ হাসান মাহমুদ বললেন, ‘আমার গ্রাম রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাসে চলেন, আমরা কাজ শুরু করি। দেখবেন, আমাদের সব স্বপ্ন আর চিন্তা একদিন মিলে মিশে এক হবে।’

আমরা কিছু কিছু কাজ করতে শুরু করলাম লেনিন ভাইয়ের গ্রাম মুন্সীগঞ্জের কনকসার-এ। প্রথম দিন আমাদের সঙ্গে গেলেন মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডাটাসফট-এর মাহবুব জামান ভাই, আর ওই গ্রামের এক সন্তান ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত পিনাকী রঞ্জন চক্রবর্তী। সেই থেকে আমাদের ভাবনায় ওই কাজে সহায়তা দিলো মাইক্রোসফট। তারা বললো, ‘দেখতে চাই কী হয়!’ শুরু হলো আমাদের মতো করে আমাদের কাজ- আমার কুমিল্লায়, ছাত্র জীবনের বন্ধু অমূল্য বড়ুয়ার বাঁশখালীর শীলকূপে, লেনিন ভাইয়ের কনকসার, হাসান মাহমুদের রাঙ্গুনিয়া, মিহির কান্তি মজুমদারের পিরোজপুরের জুজখোলায়। খালেক তালুকদার বললেন, ‘খুলনা শহরে একটা করে দেখেন। তার দেওয়া পরামর্শে সোনাডাঙ্গা, আমার সহকর্মী দীপকের গ্রাম বাগেরহাটের কচুয়ার দেপাড়া আর রামপাল, শ্রীফলতলা তো আছেই। আমি আর মুনীর হাসান এবার নড়ে চড়ে বসলাম- চলেন সবাইকে একসঙ্গে ডাকি আর দেখাই কেমন হতে পারে ডিজিটাল বাংলাদেশ! যেই কথা সেই কাজ। ২-৩ অক্টোবর ২০০৯ আমরা আয়োজন করলাম ‘বাগেরহাট হবে ডিজিটাল’- এই শিরোনামে জ্ঞান উৎসব। ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ ব্যবসায়ী, কর্মজীবী খেটে খাওয়া মানুষ সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই উৎসবে অংশ নিয়েছিল। সেখানে জ্ঞান আর বিজ্ঞানের মেলা, গণিতের উৎসব, তথ্য-প্রযুক্তির নানারকম উদ্ভাবন প্রদর্শন, স্থানীয় সরকার, জন প্রতিনিধি, সংসদ সদস্য, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা, বিজ্ঞান মন্ত্রী থেকে প্রযুক্তি শিক্ষাবিদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল থেকে শুরু করে মোস্তাফা জব্বার, প্রায় শতাধিক জাতীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশ নেন। পুরো বাগেরহাট শহরজুড়ে কয়েকদিন যাবত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার এক প্রত্যয় ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি এত নামিদামি অতিথি থাকার ভালো ব্যবস্থা ওই ছোট শহরে নেই বলে বাগেরহাটের অনেক সাধারণ পরিবার তাদের বাড়িতে দূরের মেহমানদের রেখে আতিথেয়তা দিয়েছেন, এমন উদাহরণও তখন তৈরি হয়েছিল। 

এই কর্মসূচিতে বাংলাদেশ টেলিসেন্টার নেটওয়ার্ক প্রদর্শন করেছিল গ্রামের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি সেবার কেন্দ্রগুলো কেমন হবে তার অভিজ্ঞতা ও ডি-নেট শেয়ার করেছিল তাদের পল্লী তথ্য কেন্দ্রের রূপরেখা। আমাদের গ্রাম শেয়ার করেছিল- জ্ঞান কেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রামের তথ্য ভাণ্ডার কেমন করে গ্রামের মানুষের নিজেদের অর্থনৈতিক বা স্বাস্থ্য অবস্থার বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারে, তার নানাবিধ নমুনা। বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সদস্যরা ডিজিটাল বাংলাদেশে সংবাদকর্মীদের ভূমিকা নিয়ে একটি সেমিনার করে। আরেকটি সভা হয় তাদের উদ্যোগে শুধুমাত্র মোস্তাফা জব্বারকে নিয়ে ‘মোস্তাফা জব্বার সন্ধ্যা’ । সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী ও অনেক সাধারণ মানুষ মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে আড্ডা দেন। আর তার সারা জীবনের কাজ বিশেষ করে কম্পিউটারে বাংলা অক্ষর বিন্যাস, বিজয় কী বোর্ড এসব নিয়ে অভিজ্ঞতা জানতে চান। বাগেরহাটের সেই উৎসবে পুলিশের এসপি ও র‍্যাবের আঞ্চলিক কর্মকর্তাসহ অংশ নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। সাধারণ মানুষের কাছে একটি সেমিনারে তারা তুলে ধরেন- ডিজিটাল বাংলাদেশে তাদের ভূমিকা কী হবে, কেমন করে অপরাধ দমনে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার হবে। জেলা প্রশাসন এই আয়োজনে ব্যাপক সমর্থন দেয়। জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন, এমনকি ওই অনুষ্ঠানেই প্রথম বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট উন্মুক্ত করা হয়, যেখানে স্থানীয় ভূমির ডিজিটাল তথ্য প্রকাশিত হয়। 

এই  সামান্য বর্ণনায় দুদিনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরা সম্ভব নয়। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই অনুমেয় ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আমরা তখন কী বুঝেছিলাম। আমরা এটাই বুঝেছিলাম, সেখানে সব মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে। সবাই নিজেদের প্রযুক্তি শিক্ষা ও ব্যবহারে কনফিডেন্টবোধ করবে। আর সে শিক্ষা হবে সমান সুযোগের, সাশ্রয়ী। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে মানুষের সঙ্গে প্রযুক্তির দূরত্ব সৃষ্টি নয়। মিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন দেখা নয়, বা ঘরের কোনে বসে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট নিয়ে প্রাইভেসির নামে যা খুশি করা নয়। এদেশের মানুষ কী চায়, প্রযুক্তির কোন কোন সেবা দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত করা যায়, ছেলেমেয়েদের জীবন কেমন করে আরও নিশ্চিত রাখা যায়, স্ত্রীর অসুখ হলে সুচিকিৎসা পাবে, বয়োবৃদ্ধ পিতামাতা ঘরে বসে পাবে রিমোট চিকিৎসা সেবা, ট্রেন চলবে কাটায় কাটায় ডিজিটাল তালে পা রেখে। ডাক্তারের কাছে থাকবে রোগীর সব উপাত্ত ও রোগের বিবরণ। শিক্ষক তার ল্যাপটপের এক টোকায় জানবেন, তার শিক্ষার্থী গত মাসের তুলনায় এ মাসে কতদূর এগিয়েছে। মুদি দোকানি এক লহমায় দেখে নেবেন তার মালামালের তালিকা। সবজিওয়ালা জানবেন, মাঝখানে কেউ তাকে ঠকাবে না । কারণ, মহাজনের সব হিসাব ওপরে রাখা আছে।  
ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আমরা কিন্তু বুঝেছিলাম- মোস্তাফা জব্বারই হবেন তার মন্ত্রী, যিনি আশির দশকে আমাদের শিখিয়েছেন, কেমন করে কম্পিউটারে বাংলা লেখা যায়। এই মোস্তাফা জব্বার যদি ঠিক সময়ে আমাদের ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার না শেখাতেন, তাহলে আরামবাগের শতশত কারিগর ফটোশপের দোকান দিয়ে সে আমলে নিজেদের সংসার চালাতে পারতেন না। তিনি যদি আমাদের নানা রকমের বাংলা হরফ এঁকে না দিতেন, আমাদের বাংলা প্রকাশনা কি এত সুনিপুণ হতো? এই বই মেলার দেশে কোথায় থাকতাম আমরা, যদি আমাদের দেশের অফসেট প্রকাশনা শিল্প আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে ডিজিটাল না হতো? এই প্রযুক্তিবান্ধব দেশপ্রেমিক মানুষটিকে আমরা সঠিক সময়ে নেতৃত্ব দিতে চিনে নিতে পারিনি কেন?  

মোস্তাফা জব্বার যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের হাল ধরেছেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক পূর্বশর্ত পূরণের কাজ বাকি রয়ে গেছে। এই দেশের মানুষের কাছে এখনও উচ্চ গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নাগালের বাইরে। নানারকম ইংরেজি নামের প্রজেক্টের কাছে ব্রডব্যান্ডকে বন্ধক দিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রামে গ্রামে যে ইন্টারনেট এতদিনে কূলপ্লাবিত হবার কথা, সেখানে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট। সাশ্রয়ী হবে কেমন করে? একটা স্মার্ট ফোন,ইন্টারনেট প্যাকেজ,সঙ্গে কাজের খোঁজ। কাজ পেলে সেই কাজ কি মোবাইল ফোনে করা যাবে? লাগবে কম্পিউটার, মডেম, প্রিন্টার আর নানা রকম অনুষঙ্গ। যন্ত্রপাতির জন্যে মোট বিনিয়োগ খরচ যদি ৫০-৬০ হাজার টাকাও হয়, সে-ও তো অনেক বেশি। একটা কাজ পেলো তো আপ করবে কেমন করে? এই ফোনের ইন্টারনেট তো কানেক্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে নানান ফাঁকিজুকির মাঝে তার ‘ডাটা’ শেষ হয়ে যায়! ওই যে গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো নানা চেষ্টায় একটা কাজ জোগাড় করলো, তার তখন কী হবে? তাকে একটা ভুল প্রতিযোগিতার স্বপ্ন ধরিয়ে দেওয়া হলো- মোবাইল ফোনের ‘অ্যাপ’ তৈরি নাকি একটা ভালো ‘অপরচুনিটি’। ঘুরে ঘুরে কোথাও সে কোনও কুলকিনারা পাচ্ছে না। এসব অর্থহীন ‘উদ্যোগ’ কি বন্ধ হবে? গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখনও দেখছে, তথ্য-প্রযুক্তি মানে আলোর চিকচিকি! বাংলা-ইংরেজির মিশেলে এক অদ্ভুত উচ্চারণে কথা চলছে ঢাকার বিশাল আলো ঝলমলে মিলনায়তনে। এসব কি ডিজিটাল বাংলাদেশে হবার কথা ছিল?        
এখন এই নতুন বাস্তবতায় মোস্তাফা জব্বারের চ্যালেঞ্জ তার সামনের সীমিত কর্মকাল। নির্বাচন যদি ডিসেম্বরে হয়, তো হাতে আছে দশ-এগারো মাস। বুঝে শুনে যদি সব কাজ গুছিয়ে নিতে হয়, তাহলেও আমরা বুঝতে পারি, তাকে অগ্রাধিকার ঠিক করে আর নির্বাচন বিবেচনা রেখেই কাজ করতে হবে। আর এতে ডিজিটাল বাংলাদেশের অনেক কাজই অসস্পূর্ণ থেকে যাবে। আমরা জানি যে কাজগুলো ইতোমধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারতো, তার মধ্যে জরুরি ছিল- সবার জন্যে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সারাদেশে সাশ্রয়ী মূল্যে উন্মুক্ত করা। আর ইন্টারনেট বিতরণের জন্যে একটি নীতিমালা তৈরি করা। কে কত গতি পাবে, কে কত টাকা দিয়ে কত মাত্রার গতি পাবে, আর কী কাজে ইন্টারনেট নেবে– এগুলো জেনে বুঝে এই ‘বিতরণ নীতি’-র কর্ম সংযোগ হবে। যা দুর্ভাগ্যবশত এখনও আমাদের হয়নি! এই অল্প সময়ে জানিনা মোস্তাফা জব্বার পারবেন কিনা তার ক্রমাগত উচ্চারিত ‘প্রযুক্তি সেবাকে গ্রামবান্ধব’ করার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে। একযুগ আগে খুলনায় ‘আমাদের গ্রাম’ আয়োজিত উদ্ভাবনী মেলার উপস্থাপনাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রামে গ্রামে যুবশক্তির সংযোগ ঘটিয়ে গ্রামভিত্তিক তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা দরকার’। যার কোনও উদ্যোগ গত নয় বছরে নেওয়া হয়নি। এখন কি তা সম্ভব হবে?

জব্বার ভাই আমাদের সঙ্গে সব আন্দোলনে একমত ছিলেন- বিটিসিএল-এর আমলাতান্ত্রিকতা থেকে ইন্টারনেট সেবাকে বের করে আনতে। এখন কি সেটা হবে? সোচ্চার ছিলেন আমাদের দাবির সঙ্গেও-আমাদের দেশের জন্যে বিদেশ থেকে কিনে আনা ইন্টারনেট যেন দেশের বাজারেই থাকে, সেরকম ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেওয়ার পক্ষে। তাকে দেখতে হবে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও অনুশাসনগুলো বুঝতে ও মেনে চলতে আমাদের সরকার ও মিশনগুলো যেন ঠিক ভূমিকা পালন করে সেটাও।

দেরি হয়ে গেলেও আমরা মোস্তাফা জব্বারের নেতৃত্ব ও কর্ম-দক্ষতার প্রতি আস্থাশীল। তিনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাষা বুঝেন। তিনি জানেন ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে শুধু যন্ত্র নয়, আলো ঝলমলে স্টুডিও সেবা নয়। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো- এই দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের রূপক। আশা করি, নানা রকম অনুষ্ঠানের আলোকচ্ছটায় তাকে ব্যস্ত রেখে, মূল কাজ থেকে তার দৃষ্টি কেউ সরিয়ে রাখতে পারবে না।

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য প্রযুক্তি প্রকল্প

/এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ