X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের শেষ বছর

বিভুরঞ্জন সরকার
১৫ জানুয়ারি ২০১৮, ১৩:২৯আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:৫৪

বিভুরঞ্জন সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তার দ্বিতীয় মেয়াদের চার বছর পূর্ণ করেছে। পা দিয়েছে পঞ্চম অর্থাৎ শেষ বছরে। চার বছরে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। সরকার ও সরকারের সমর্থকরা দাবি করবেন সরকার শতভাগ সফল, কোনও ব্যর্থতা নেই। আবার যারা সরকারবিরোধী, তারা সরকারের কোনও সফলতা দেখেন না। তারা শুধুই দেখেন, সরকারের ব্যর্থতা। এই দুই চরম অবস্থাই ক্ষতিকর। সরকার যা করেছে, তার সবই ভালো, সেটা যেমন ঠিক নয়; আবার সরকার কিছুই করেনি, এটাও ঠিক নয়। কোনও সরকারই যেমন শুধু ভালো কাজ করে না, তেমনি সরকার মানেই খারাপ নয়। শেখ হাসিনার সরকার টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে দেশের অনেক উন্নতি করেছে। সাদা চোখেই সরকারের উন্নয়নমূলক কাজগুলো যে কেউ দেখতে পারেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তিসহ অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের অগ্রগতি অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার সুশাসন, নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাফল্য দাবি করলে তাতে মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না।
সরকার সাফল্য দাবি করে পরিসংখ্যান দিয়ে। যেমন, এত হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছি, এতটা ব্রিজ বানিয়েছি, এত কিলোমিটার রাস্তা বানিয়েছি, এত মানুষকে ভাতা দিয়েছি ইত্যাদি। কিন্তু মানুষ এসব সংখ্যা দিয়ে সরকারের সাফল্য পরিমাপ করে না। মানুষ প্রতিদিনের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করে সরকারকে। যেমন, ঢাকা শহরের অসহনীয় যানজট মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়, তখন আর মানুষ সরকারের প্রশংসা করে না। শুধু ঢাকা শহরে নয়, ঢাকার বাইরে যাতায়াতও এখন নির্ঝঞ্চাট নয়। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ যেতে যে ‘হ্যাপা’পোহাতে হয়, তা এক কথায় অসহ্য। এটা ঠিক যে দেশের মানুষ এখন চরম অভাবে নেই। কেউই হয়তো এখন আর না খেয়ে থাকে না। সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দেশের জন্য, দেশের মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন, এটা মানুষ বোঝেন। তবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের এক শ্রেণির নেতা-কর্মী, এমনকি কিছু সংখ্যক মন্ত্রী-এমপির ভূমিকা মানুষকে হতাশ করছে।


দেশ নিশ্চয়ই এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক মেগা প্রজেক্ট সরকার হাতে নিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের চেহারা বদলে যাবে। বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সরকারকে ব্যর্থ বলার সুযোগ নেই। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ হাতে নিয়ে সরকার বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে নতুন মাত্রায় তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়ে এখন আর প্রশ্ন তুলতে পারবে না কেউ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার ও রায় কার্যকর করা শেখ হাসিনা সরকারের একটি বড় সাফল্য। ইতিহাসের কলঙ্ক মোচন সবার দ্বারা সম্ভব হয় না। শেখ হাসিনা যেটা পেরেছেন, আর কারও পক্ষে হয়তো সেটা সম্ভব হতো না। এই কাজটির জন্য এই সরকার স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সনীতি শেখ হাসিনার সরকারের আর একটি বড় ইতিবাচক দিক। জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশের নয়, একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকার দৃঢ় ও সক্রিয় আছে। এ সবের জন্য সরকার প্রশংসিত হবে।
আগেই বলেছি, অনেক বড় বিষয়ের চেয়ে ছোট ছোট কিছু বিষয় মানুষের কাছে সরকারকে অপ্রিয় করে তোলে। এখন, মেয়াদের শেষ বছরে এসে সরকারকে বড় বিষয়ের চেয়ে ছোট কিছু বিষয়ের প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। ছোট বিষয়ের একটি হলো দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালানো। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুফল-কুফল দুটোই আছে। সরকার টানা ক্ষমতায় থাকলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যেমন বজায় থাকে, তেমনি আবার দলের মধ্যে চাটুকার ঢুকে পড়ে। বঙ্গবন্ধু চাটুকারদের সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। সময় এসেছে, শেখ হাসিনাকেও চাটুকারদের বিরুদ্ধে সজাগ হওয়ার। এখন কিছু কিছু ব্যবস্থাও নিতে হবে। সরকারের সাফল্য যাদের কারণে ম্লান হচ্ছে, যাদের লোভের আগুন পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে সরকারের সব অর্জন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্বলতা দেখানোর পরিনাম ভালো হবে না। চাটুকারের দল কখনও বিপদের বন্ধু হয় না। কাজেই শেষ বছরে এদের থেকে সাবধান থাকতে হবে।
এই বছর সরকারকে নির্বাচন মোকাবিলা করতে হবে। নির্বাচন নিয়ে এর মধ্যেই হাওয়া গরম হতে শুরু করেছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক তথা গ্রহণযোগ্য হবে, নাকি আগেরবারের মতো একতরফা হবে–এ প্রশ্ন নানা মহলেই আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১২ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘আমি আশা করি, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সকল দল আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেবে।’ আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি হতে পারে–এমন আশঙ্কা থেকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আপনাদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। জনগণ অশান্তি চায় না। নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলনের নামে জনগণের জানমালের ক্ষতি করবেন–এটা আর এদেশের জনগণ মেনে নেবে না।’
নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি বড় দল। তাদের সমর্থকের সংখ্যাও প্রচুর। এই দলটি নির্বাচন থেকে দূরে থাকলেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। গত নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশগ্রহণ করতো তাহলেই নির্বাচনটি একতরফা হতো না। আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। খালেদা জিয়া যেসব কথা বলছেন তা থেকে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তিনি একমুখে বহু কথা বলছেন। বলছেন, এবার তাদের নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা যাবে না। সরকারকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না। আবার বলছেন, শেখ হাসিনার অধীন কোনও নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। বিএনপি কি মনে করছে যে, তারা তাদের দাবি মতো ‘সহায়ক সরকার’ আদায় করতে পারবে? সে রকম সম্ভাবনা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকরা দেখছেন বলে মনে হয় না।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে’। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় স্বভাবিকভাবেই বিএনপি খুশি হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী যে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলেছেন তা অবশ্যই শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই গঠিত হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভার আকার হয়তো ছোট হবে, কিন্তু তাতে বিএনপির স্থান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিএনপির সঙ্গে সরকার তথা আওয়ামী লীগের সম্পর্ক তিক্ত এবং ‘অ্যাকোমোডেট’ করার পর্যায়ে নেই। আন্দোলন করে দাবি আদায়ের মতো সাংগঠনিক শক্তি-সামর্থ্যও বিএনপির আছে বলে মনে হয় না। আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে গেলে সরকার যে কঠোরতা দেখাবে সেটা প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন।
সরকারি দলের নেতারা জোর দিয়েই বলছেন যে, শেখ হাসিনার অধীনেই বিএনপি নির্বাচনে আসবে। হয়তো সেটাই ঠিক। নির্বাচনে না যাওয়ার বিকল্প বিএনপির সামনে আছে বলে মনে হয় না। বিএনপি যদি সত্যি কোনোরকম টালবাহানা না করে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে দেশের জন্য মঙ্গল। নির্বাচনে জয়-পরাজয় দুটোই হতে পারে। জয়ের জন্য চেষ্টা করতে হবে, পরাজয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নির্বাচনে জয়লাভ করতে চায় বলেই সমস্যা দেখা দেয়। যেকোনও পরিস্থিতিতে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে–এই ঘোষণা যদি বিএনপি এখনই দেয়, তাহলে দেশের রাজনীতিতে কিছুটা নাটকীয়তা তৈরি হবে। সরকার ও সরকারি দলকে তখন নড়েচড়ে বসতে হবে। বিএনপি যে সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রবল প্রতিপক্ষ সেটা সবারই জানা। বিএনপি তার শক্তির সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। তারা ভুল রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে ভুল পথে হেঁটে অহেতুক শক্তিক্ষয় করেছে।
এখন বিএনপি সরকারের কাছ থেকে কিছু আনুকূল্য চায়। সরকার তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে অন্তত এটুকুও যদি তারা দেখাতে না পারে, তাহলে তাদের মান থাকে না। মানুষের কাছে বিএনপির একটি পরিজিত ইমেজ নিয়ে দলটি নির্বাচনে যায় কী করে? সে জন্য সরকারের সঙ্গে একটি সংলাপে বসতে চায় বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব কিছুদিন ধরেই সংলাপের কথা বলছেন। ১৩ জানুয়ারিও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, ‘আমাদের দল মনে করে, একটি আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে ২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে অর্থবহ সমাধানে আসা সম্ভব’। আওয়ামী লীগ আগেও বিএনপির সঙ্গে সংলাপে আগ্রহ দেখায়নি। এবারও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংলাপ-প্রস্তাব নাকচ করে বলেছেন, ‘সংবিধানে নির্বাচনের বিষয়ে পথনির্দেশনা আছে। সেই পথ নিয়ে আবার সংলাপের প্রয়োজন কেন? নির্বাচন বিএনপির অধিকার, সুযোগ নয়’।
সরকার বা আওয়ামী লীগ যদি বিএনপির সঙ্গে সংলাপে না বসে, বিএনপির ‘সহায়ক’ সরকারের দাবি যদি উপেক্ষিত হয় তাহলে কী করবে বিএনপি? আন্দোলনে যাবে? সেই আন্দোলনের ধরন ও কৌশল কী বা কেমন হবে? হরতাল-অবরোধ, আগুন-সন্ত্রাস নাকি শান্তিপূর্ণ কোনও কর্মসূচি? এ সব এখনও পরিষ্কার নয়। তবে মেয়াদের শেষ বছরে এসে সরকারকে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের রয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব শুধু আগামী নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমেই। দেশের মানুষ কি আর একবার শেখ হাসিনাকে সরকার পরিচালনার সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারাই সব ক্ষমতার মালিক। কাজেই লক্ষ্য আপনাদেরই ঠিক করতে হবে, আপনারা কী চান! আপনারা কি দেশকে সামনে এগিয়ে যাওয়া দেখতে চান, না বাংলাদেশ আবার পেছনের দিকে চলুক, তাই দেখতে চান। একবার ভাবুন তো, মাত্র ১০ বছর আগে দেশের অবস্থাটা কোথায় ছিল?’
মানুষ আগামী নির্বাচনের আগে যেমন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব করবে তেমনি নিশ্চয়ই অন্য রাজনৈতিক দলের ‘ঠিকুজিও’ দেখবে। অতীতের আয়নায় মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে চাইবে। প্রধানমন্ত্রীও তার ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই না, তবে অতীতকে ভুলেও যাবো না। অতীতের সফলতা-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে, ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাবো।’
প্রধানমন্ত্রী যদি তার সরকারের কোনও ‘ভুলত্রুটি’ দেখতে পান এবং সত্যি সেগুলো শুধরে নিয়ে সামনের লক্ষ্য স্থির করেন, তাহলে দেশের মানুষকে তার সঙ্গে না পাওয়ার কোনও কারণ থাকবে না।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ