X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকাবাসীর ওপর এ কোন ‘অভিশাপ’

লীনা পারভীন
১৫ জানুয়ারি ২০১৮, ২০:২৩আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০১৮, ২০:২৬

লীনা পারভীন অফিসে কলিগের সঙ্গে বসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মিটিং চলছিল। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। বুঝলাম ব্যক্তিগত ফোন। কথা বলতে বলতেই দেখতে পেলাম, তার মুখের অভিব্যক্তি পাল্টাচ্ছে। এক ধরনের উদ্বেগের ছাপ নেমে এসেছে কপালে। ব্যক্তিগত হলেও বুঝতে পারছিলাম, খুব টেনশনের কিছু একটা ঘটেছে। ফোন রাখার পর জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘বাসায় কোনও ঝামেলা?’ জানালেন তার দুই বাচ্চা স্কুল থেকে ফিরতে পারছে না। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে উত্তরায় বাচ্চাদের স্কুল পর্যন্ত যেতে পারেনি। উপায় না দেখে ড্রাইভার গাড়ি দূরে রেখেই হেঁটে যাচ্ছে বাচ্চাদের আনতে। কারণ স্কুল ছুটি হয়ে গেছে এবং সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে বাচ্চারা হয়তো ভয় পেয়ে যেতে পারে। শুনলাম ড্রাইভার দুটি ছোট বাচ্চাকে নিয়ে রাস্তা ক্রস করে এপারে এসে রিকশা দিয়ে কোনও রকমে যদি জ্যামের জায়গা পার হয়ে আসতে পারে, সেই চেষ্টায় আছে। শুনে আমিও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কারণ সকালেই খবর পেয়েছি বিমানবন্দর এলাকায় বিক্ষোভ চলছে। গোটা এলাকা অনির্ধারিত অবরোধের মধ্যে। এছাড়া উত্তরার রাস্তায় পার হওয়া খুব রিস্কি ব্যাপার। তার বাচ্চারা খুব চঞ্চল। তিনি বিষণ্ন মুখে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনে নিজেই যে যাবেন, সেই উপায় নেই। রাস্তা তো বন্ধ। এছাড়া আগে থেকে জানলে হয়তো বিকল্প ব্যবস্থা নিতেন। ঘটনাটা দুপুর ১ টার দিকের। পরে বিকাল ৫ টার দিকে খোঁজ নিয়ে জানলাম, তার বাচ্চাদের নিয়ে ড্রাইভার কোনও রাস্তা দিয়েই আসতে পারছিল না বলে এদিকে-সেদিকে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত মিরপুরের কোনও একটি এলাকায় আটকে গেছে।

আমার সেই কলিগ আর তার স্ত্রী দু’জন দু’দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন বাচ্চাদের উদ্ধার করতে। এই একই দৃশ্য দেখেছি আমার আরও দুই কলিগের বেলায়ও। একজনের পরিবার ঢাকার বাইরে থেকে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে সকাল ১০ টার দিকে কিন্তু বের হতে পারেনি বিকাল পর্যন্ত। তার গাড়িও পৌঁছাতে পারছে না। আরেকজনের মেয়ের পরীক্ষার জন্য গিয়েছেন উত্তরায়। আর ফিরতে পারেননি।

আমি জানি, এমন ঘটনা অনেকেরই ঘটেছে। ফেসবুকে ছবি দেখছিলাম দলে দলে মানুষ আটকে আছে। কেউ টঙ্গি পর্যন্ত এসেছে দূরের জেলা থেকে কিন্তু এরপর জ্যামে বসে আছে ৪/৫ ঘণ্টা ধরে। কিন্তু কেন এই ভোগান্তি?

ঘটনার পেছনের ঘটনা ছিল দুই গ্রুপে বিভক্ত তাবলিগ জামাতের একটি পক্ষের একজন শুরা সদস্যের আসন্ন তাবলিগ জামাতে আগমন ঠেকানোর লক্ষ্যে অবস্থান নিয়েছে। অন্য গ্রুপের লোকেরা সকাল নয়টা থেকেই বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকা সমস্ত গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে রাস্তা দখল করে রেখেছে। সেখানে মুখোমুখি ছিল দুটি গ্রুপই। সমস্যা তাদের মধ্যে যাই থাকুক না কেন, এভাবে কি জনগণের চলাচলকে আটকে দিয়ে, স্কুলের বাচ্চাদের অভিভাবকদের এমন টেনশনে ফেলে দিয়ে বিমানবন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর জায়গা দখল করে তারা আটকে রাখতে পারে?

বিমানবন্দরের সিকিউরিটি ও ভাবমূর্তি যেমন বড় বিষয় ঠিক তেমনি জনগণের স্বাধীন চলাচলকে এভাবে আটকে দিয়ে পুলিশ পাহারায় জানমালের প্রতি হুমকি তৈরি করার অধিকার কি কারও থাকতে পারে?

এর কোনও উত্তর কেউ দেবে? এ যেন এই ঢাকাবাসীর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে যখন, যেমনভাবে পারছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, মিছিল-মিটিং-সমাবেশ করে আটকে দিচ্ছে জনগণের চলাচলের জায়গাটুকু। হাজার হাজার মানুষ আটকে থাকছে রাস্তায়। স্কুল, কলেজের বাচ্চারা আটকে পড়ছে, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে অভিভাবক। অফিসগামী মানুষ জানে না কখন পৌঁছাতে পারবে তার গন্তব্যে। শ্রমজীবী মানুষগুলোর সে দিনের আয়ের রাস্তাও থাকছে বন্ধ। অসুস্থ রোগীকে রাস্তায়ই হয়তো করুণ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

এ কেমন দেশের বাসিন্দা আমরা? এ কেমন গণতন্ত্র দেখছি? সভা-সমাবেশ হবে, মিছিল-মিটিংও হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি হবে না সেটা আমরা বলছি না। কিন্তু এভাবে দু’দিন পর-পর রাস্তা আটকে, মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে এ কোন রাজনীতি? কাদের জন্য রাজনীতি তবে? কাদের ভোটের জন্য এত আন্দোলন, কর্মসূচি বা জমায়েত? এর উত্তর দেবে প্রশাসন? জানি পাবো না।  

কেউ নেই এই হতভাগা নগরবাসীর কান্না শোনার। দেশটা কি আমাদের সবার নয়? দেশের প্রশাসনের কি দায়িত্ব নয় আমাদের চলাচলের জন্য রাস্তাগুলোকে নিরাপদ রাখা? প্রায়ই এই দলের সমাবেশ উপলক্ষে রাস্তা বন্ধ, ভিআইপি আসা-যাওয়া উপলক্ষে রাস্তা বন্ধ, এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাতে রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। এসব দেখে আজকাল মনে হয়,  তারাই যেন এই দেশের মালিক। তারাই লিজ নিয়ে রেখেছে এই ঢাকার রাস্তাঘাট। আর আমরা যারা এর বাইরে থাকি, যারা আশায় থাকি কবে একটি যানজটমুক্ত নিরাপদ ঢাকার রাস্তাঘাট পাবো, তারা সবাই যেন করুণার পাত্র। যদি তাদের দয়া হয়, তবেই হয়তো পেতে পারি একটি উৎকণ্ঠাহীন ঢাকা শহর। অথচ কর দেওয়ার সময় এই সাধারণ মানুষগুলোই দেয়, ভোটের সময় এই মানুষগুলোর দুয়ারেই আসেন নেতারা। অথচ সামান্য একটা দিন নির্বিঘ্নে চলাচলের নিশ্চয়তা পায় না এরা। কর্মসূচি করবে একদল কিন্তু ভোগান্তিতে পড়বে সবাই। এ কোন রীতি?

এখন যদি সাধারণ মানুষগুলো একটি নিরাপদ ও যানজটমুক্ত রাস্তার জন্য মিছিল বা সমাবেশ করতে চায়, তখন? তখন কি তারা অনুমতি পাবে? তখন হয়তো আমাদের প্রশাসনের কর্তারা নগরবাসীর নির্বিঘ্ন চলাফেরাসহ আরও অনেক অনেক কারণের বেড়াজালে বেঁধে দেবেন বা নিয়ম না মানলে লাঠিপেটা করবেন।

তবে আমরা সাধারণ মানুষ মিছিল মিটিং করে আর কোনও জটলা পাকাতে চাই না। কেবল চাই, একটা সুস্থ-স্বাভাবিক যানজটমুক্ত নগরী। যেখানে আমাকে সময়মতো অফিসে পৌঁছানোর তাড়নায় রক্তচাপ বাড়াতে হবে না। আমার সন্তান কেমন করে স্কুল থেকে বাসায় ফিরবে, সেই চিন্তায় কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে না। কোনও অসুস্থ রোগীকে ডাক্তারের অ্যাপোয়েন্টমেন্ট মিস করে রোগযন্ত্রণায় ভুগতে হবে না।

আমরা চাই, আমাদের পুলিশ ও সরকার প্রশাসন হবেন নাগরিক সুবিধাবান্ধব এবং সেবাবান্ধব। যেখানে সব ধরনের বে-আইনি কার্যক্রমকে শক্ত হাতে দমন করবে। সবার আগে নাগরিকের অধিকার। তারপর রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। কিন্তু পাবো কি এমন একটি নিশ্চিত ঢাকা শহর?

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মোহনায় শতাধিক পাইলট তিমি আটক
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মোহনায় শতাধিক পাইলট তিমি আটক
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ