X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন’: ‘নছুল্লা’ ও ‘কদু’

দাউদ হায়দার
১৯ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:৪৩আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০১৮, ১৪:৫০

দাউদ হায়দার গত শতকের ১৯৬৪ সাল থেকে স্বাধীনতার পরেও ঢাকায় আমাদের বাস ছিল মালিবাগে, আবুজর গিফারী কলেজের পেছনে। পাড়ায় আমরা উঠতি বয়সের কয়েকজন; লোকে বলতো— ‘পুংটা পোলাপান’। তখন পড়ি সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে।
পাড়ায় হাতেগোনা সাত বা ১০ জন কিশোরী, কেউ সদ্য যৌবনে পা দিচ্ছেন। ‘নারী অবলা জাতি’, ‘মাতৃতুল্য’ ইত্যাদি ভালো ভালো কথা খুব শুনেছি। চোখ তুলে তাকানোর হিম্মত হয়নি। ‘পুংটা পোলাপান’ হলেও পাড়ার মেয়েদের সম্মান রক্ষায় প্রভূত খ্যাতি ছিল আমাদের। বেপাড়ার, তথা অন্য পাড়ার কোনও ছেলে, হোক সে তাগড়া, পাড়ার মেয়েদের পেছনে ফিল্ডিং মারতে এলে আমরা দলবেঁধে ভেঙ্গাতে পিছু পা হই নাই। হাডিগুড্ডি ভাঙার শপথ। পাড়ার ক্যারম ভাই (এই নামেই পরিচিত। বয়সে তিনি বড়ো। দিনমান ক্যারম খেলাই তার নেশা। নাম হয়ে যায় ক্যারম ভাই) বলতেন, ‘শাবাশ! মহল্লা কা ইজ্জত কা সওয়াল।’
মাঝে-মধ্যে দুয়েকজন মাঞ্জা মেরে, সেজে-গুঁজে ফিল্ডিং মারতে আসতেন। আমাদের পাশের বাড়ির আলতাফ হোসেন ও তার স্ত্রীর কথা ছিল, ‘নছুল্লা করছে।’ জিজ্ঞেস করি, মানে কী? ‘নছুল্লা’ যশোরের আঞ্চলিক ভাষা। মানে, সাজসজ্জা করে, নানা পাঁয়তারায় ভড়ং দেখায়। মনে হবে কী না জানি!
পাবনার দহারপাড়ায় ‘নছুল্লা’র বদলে ‘কদু’। লোকটা বা ছাওয়ালডা ‘কদু’ করতেছে। আলিজালি ফুটানি মারতাছে। ভরং করে বাহবা লেচ্ছে। কদু করার ট্রেনিং লেছে। এখানেই শেষ নয়। কার কাছে ফুটানি, ভড়ং? দোহারপাড়ার মুন্নির মায়ের কথা, ‘তা চোকে (চোখে) দেখতিছ্যাও না? ওই লাউয়ের সাথে। লাউ হচ্ছে গিয়ে মিয়া মানুষ, কদু ব্যাটা ছাওয়াল।’
গ্রাম্য, অশিক্ষিত নারীর লিঙ্গভেদের এই ব্যাখ্যায় যুক্তি নেই, যা লাউ তাই কদু। যার নাম চালভাঁজা, তারই নাম মুড়ি। অঞ্চলভেদে ‘হুড়ুম’। সুপারির আরেক নাম ‘গুয়া’। আসামের রাজধানী গুয়াহাটি। সিলেট নিয়ে একদা আসাম। ইতিহাস বলছে, রাজা প্রাগজ্যোতিষীর (৪ খ্রিস্টাব্দ) কামরূপা (কামরূপ) প্রধান শহর। বাণিজ্যিক শহর। মূলত সুপারির হাট। ১৭৮৬ সালে গুয়াহাটি হয়ে যায় রাজধানী। গুয়া ও হাট মিলিয়ে গুয়াহাটি। আসামে ‘হাটি’ হাট। তাও আঞ্চলিক।
ওই যে বলেছি ‘নছুল্লা’ ও ‘কদু’— বলা গল্পচ্ছলে, কার্যকারণ আছে বৈকি।
গত বছর নভেম্বরেই ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’ হলো মহাসমারোহে। বিশ্বের বহু মান্য লেখকের উপস্থিতি। স্নেহভাজনীয়া কবি সাফাদ সায্ বার্লিনে বলেছিলেন (সাক্ষাৎ সময়ে), ‘‘বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের সাহিত্যকে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য। আমাদের দেশ, দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে হয়তো কিছুই জানে না, জানানোর দায় আমাদের। একদিনে হবে না, সময় লাগবে, লাগুক। বীজের গাছ একদিনে মহীরূহ হয় না। মহীরূহ হবে আমাদের ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’। সাহায্য চাই।’’
‘এতেক কহিয়া’ সাফাদ সায্, ‘আপনাকে ঢাকা লিট ফেস্টে নিয়ে যাবই। কেউ বাধা দিতে পারবে না।’ হেসে বলি, চমৎকার প্রতিজ্ঞা। ঢাকা লিট ফেস্ট বন্ধ করার আয়োজন। সাফাদ সাযের অল্প বয়স, দেশের গভীর-গোপন রাজনীতি, হাড়ে-মজ্জার খবর অজানা। বলি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ব্যাজার হবেন, নাকচ করবেন, যাওয়ার অনুমতি দেবেন না। যেমন আগে দেননি। বেশি জোরাজুরি করলে বিপদে পড়বেন। বরবাদ হবে ঢাকা লিট ফেস্ট। সাফাদ সাযের আবদার, ‘এই নিয়ে লিখুন।’
ঢাকা লিট ফেস্ট ক্রমশ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাচ্ছে, পঙ্কজ মিশ্রের মতো বহুখ্যাত লেখক, কবি এলিয়েট ডাইনমাস্টারও বলেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের খবরাখবর জানতে’ উৎসাহী। এই উৎসাহ সৃষ্টিই ‘ঢাকা লিট ফেস্টে’র কসরৎ, উদযোগ। নিশ্চয় সাধুবাদ।
‘ঢাকা লিট ফেস্টে’র পরে, জানুয়ারি মাসে ‘আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’। কয়েকজন বন্ধুর প্ররোচনায় খবরটি দেখতে হলো কাগজ, ইন্টারনেট সংস্করণে। উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে পণ্ডিতি কথা বলেছেন। কথায় রাজনীতিও আছে। থাকবেই, তিনি রাজনীতিক।
খবরের লাইনে লাইনে, অক্ষরে খুঁজছিলাম ‘আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য’র সংজ্ঞা। কেন আন্তর্জাতিক সম্মেলন? কোথাও খুঁজে পাইনি। সন্দেহ নেই, এই সম্মেলন ‘আন্তর্জাতিক’ নাম দিয়ে, আলী’র (আওয়ামী লীগ) কয়েকজন সাংস্কৃতিক পাণ্ডার আয়োজন। প্রধানমন্ত্রী তালেগোলে উদ্বোধন করেছেন। কী করে ‘আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’? আন্তর্জাতিক বলতে কি বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার বাংলা ভাষাভাষীর সাহিত্য সম্মেলন? এর নামই আন্তর্জাতিক? কোন আন্তর্জাতিক লেখকের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে বাংলা সাহিত্য? পশ্চিমবঙ্গের যারা (লেখক), অধিকাংশ চেনা, বন্ধু-বন্ধুস্থানীয়। দুই-তিন জনের ছাড়া বাংলাদেশের সাহিত্যই পড়েননি।
ধারণা করি (ভুলও হতে পারে), ‘আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে’ বাংলাদেশের আগ্রহ আট আনার বেশি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেই। এগিয়ে আসেন বাংলাদেশ প্রেমিক, বাংলাদেশের সাহিত্যপ্রেমী সত্যম রায় চৌধুরী। কবি, গায়ক, গীতিকার, প্রাবন্ধিক। কলকাতার বহুখ্যাত দৈনিক ‘আজকাল’-এর মালিক। ধনী ব্যবসায়ী।
হতে পারে (ভুল ভাবনা হয়তো), সত্যম রায় চৌধুরী বাংলাদেশ সরকার, আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজকদের সঙ্গে সম্মিলিত কাজ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার লেখকদের ঢাকায় যাতায়াত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থায় অকৃপণ, দুই দেশের একই ভাষাভাষীর প্রচারে উদ্বেল, অগ্রণী। সত্যম অচেনা, ওর গুণাবলী বিস্তর শুনেছি।
‘আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’-এ সত্যম থাকবেন, দৃঢ় বিশ্বাস; বাংলাদেশ সরকার কতটা থাকবেন, যারা সরকারি ছিটেফোঁটা খেয়ে নাদুস, কতটা বলীয়ান, নাকি একবারই উদ্যোগী? কিংবা ‘চকিতে দেখা, চকিতে চাহনি?’
‘নছুল্লা’ ও ‘কদু’র গল্পটি আঞ্চলিক না আন্তর্জাতিক?
লেখক: কবি ও সাংবাদিক

/টিআর/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘অভিনেতা’ ও ‘টিনের তলোয়ার’
মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘অভিনেতা’ ও ‘টিনের তলোয়ার’
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আ.লীগের, আছে শাস্তির বার্তাও
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আ.লীগের, আছে শাস্তির বার্তাও
সিংড়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে শোকজ, ইসিতে এসে জবাব দেওয়ার নির্দেশ
সিংড়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে শোকজ, ইসিতে এসে জবাব দেওয়ার নির্দেশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ