X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অসন্তোষের নেপথ্যে কী?

আনিস আলমগীর
২৩ জানুয়ারি ২০১৮, ১৯:৪৪আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:২০

আনিস আলমগীর বাংলাদেশ ও ভারতে প্রায় একই সময়ে প্রধান বিচারপতিরা নিজেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছেন।বাংলাদেশের বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা চেয়ে বেশি গুরুতর অভিযোগ ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে। এস কে সিনহা তার ৭৯৯ পৃষ্ঠার এক রায়ের ৪৯৯ পৃষ্ঠায় তার অবজারভেশন দিয়ে প্রজাতন্ত্রকে অকার্যকর বলে চিত্রিত করেছেন। আর ভারতের প্রধান বিচারপতি মিশ্র তার পরবর্তী চার সিনিয়র বিচারপতির মতে, এ পর্যন্ত যা যা করেছেন, তাতে ভারতের ‘টোটাল ফিলোসফি অব জুডিশিয়ারি’ ধ্বংস করে দিয়েছেন।
আর এমন পরিস্থিতিতে ভারত সরকার কার্যত দীপক মিশ্রের পাশে আছেন, আর বাংলাদেশ সরকার এস কে সিনহাকে বিদায় দিতে আগ্রহী ছিল। আরেকটি বিষয়ে এখানে মিল আছে, তাহলো, তাদের দু’জনের বিরুদ্ধেই অনাস্থা এসেছে সহকর্মীদের কাছ থেকে। তবে বলতেই হচ্ছে, বাংলাদেশে সিনহার বিরুদ্ধে অনাস্থাটা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে, রাষ্ট্রপতির দ্বারা সিনহার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ শোনার পর তার সহকর্মীরা নিয়েছিলেন কিন্তু ভারতে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন তার সহকর্মীরা নিজেরাই।

গত ১২ জানুয়ারি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের চার জন বিচারপতি সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আনেন। বিদ্রোহী বিচারপতি জে চেলামেশ্বর, বিচারপতি কুরিয়েন জোসেফ, বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ও বিচারপতি মদন লোকুর হচ্ছেন প্রধান বিচারপতির পর চারজন সিনিয়র বিচারপতি। ১৯৯০ সালের শাসনতন্ত্র সংশোধন করে যে কলজিয়াম প্রথা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তারা চার জন সেই কলজিয়ামের সদস্য। কলজিয়ামের এ পাঁচ সদস্যই সাধারণত সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য সমস্যাগুলো আলোচনা করে সমাধান করে থাকেন।

মিডিয়ার খবর গত বেশ কিছু দিন ধরে দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে কিছু কিছু অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি তা সমাধান না করে অবস্থাটাকে বিস্ফোরণ্মুখ করে তুলেছেন। সম্প্রতি যে মুখ্য অভিযোগ প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে উঠেছে, তা হলো তিনি বার বার নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেছেন। বিচারপতির বিরুদ্ধে বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এ অভিযোগ গুরুতর অভিযোগ।  এটা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ। আবার তিনি নাকি বিচারপতি দেখে মামলা বণ্টন করে থাকেন। তিনি চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো জুনিয়রদের বণ্টন করছিলেন। বর্তমানে যেহেতু বহুরাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়। সুতরাং হাইকোর্ট থেকে যে সব বিচারক সুপ্রিম কোর্টে আসছেন, তাদের মাঝে আরএসএস-এর ক্যাডার থাকাও বিচিত্র নয়।

এর মধ্যে আগুনের সূত্রপাত হয় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহকে নিয়ে। তিনি একসময় গুজরাটের স্বরাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। তার হুকুমে গুজরাট রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনী সোহরাবুদ্দিন শেখ নামে এক ক্ষুদ্র অপরাধীকে হত্যা করেছিল ২৬ নভেম্বর ২০০৫ সালে। পুলিশ সাজানো এনকাউন্টারে বলেছিল, সোহরাবুদ্দিন শেখ তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেদ্র মোদিকে হত্যার পরিকল্পনা করছিল। সোহরাবুদ্দিনের সঙ্গে তার স্ত্রী ছিলেন, এক বন্ধু ছিলেন– তাদেরও গায়েব করে দেওয়া হয়েছে– হত্যার সাক্ষী যেন না থাকে।

ভারতের প্রধান তদন্ত সংস্থা ও নিরাপত্তা পরিষেবা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) বিচার বহির্ভূত এই হত্যায় অমিত শাহকে আসামি করে এক মামলা করেছিল। আর এই মামলার বিচার হয়েছিল মহারাষ্ট্র রাজ্যের মুম্বাই হাই কোর্টে। অমিত শাহ প্রভাবশালী মানুষ বলে তার বিচার তার রাজ্যে হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে গুজরাটের মামলাটি মুম্বাই হাইকোর্টে স্থানান্তরিত হয়। সিবিআই অভিযোগ করে যে তার বাড়ির রাজ্যে অমিত শাহের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব মামলার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

ভারতে ন্যায় বিচারের স্বার্থে অন্য রাজ্যে প্রভাবশালী লোকের বিচার হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জয়লতিতার বিচারও হয়েছিল পার্শ্ববর্তী কর্ণাটক রাজ্যে।  

অমিত শাহের বিচার শুরু হওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর মুম্বাই হাই কোর্টের বিচারপতি বি এইচ লয়া ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা যায়। কিন্তু ‘কারাভান’ নামের একটি ইংরেজি সংবাদ ম্যাগাজিন তুলে আনে চ্যাঞ্চল্যকর খবর। ওই মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। ডেথ বডি স্বাভাবিক ছিল না। তার পরিবার অভিযোগ করে মামলা চলাকালে বোম্বে সুপ্রিম কোর্টের তখনকার প্রধান বিচারপতির মোহিত শাহ বিচারপতি লয়াকে অমিত শাহের পক্ষে রায় দেওয়ার জন্য ১০০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন। লয়া তা গ্রহণ করেননি। এর ক’দিনের মাঝে বিচারক লয়ার মৃত্যু হয় এবং লয়ার মৃত্যুর পর যে বিচারপতি দায়িত্ব নেন, তিনি একমাস পার না হতেই অমিত শাহকে খালাস দেন।

লয়ার পরিবারের মাধ্যমে তার রহস্যজনক মৃত্যুর খবর প্রধান মিডিয়ায় জানাজানি হওয়ার পর অমিত শাহের বিরুদ্ধে জনস্বার্থে মামলা হয়। সেই মামলা বিদ্রোহী বিচারপতিরা যেই বেঞ্চে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র সেই বেঞ্চে দেননি। তিনি দিয়েছেন বিচারপতি অরুণ মিশ্রের বেঞ্চে। বিচারপতি অরুণ মিশ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি আরএসএস-এর ক্যাডার। বতর্মানে বিচারপতি থাকা অবস্থায়ও তিনি নিরপেক্ষ বিচারপতি হতে পারেননি। অমিত শাহের মামলা এই বেঞ্চে দেওয়ায় অবশ্য সরকার খুশি হয়েছে।

গত সপ্তাহ প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র বেঞ্চ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তিনি এখন সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করেছেন। আর সাংবিধানিক বেঞ্চটি হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চ। এ বেঞ্চে তিনি নিজে রয়েছেন আর যে সব বিচারপতি রাখা হয়েছে, তারা হলেন বিচারপতি এ কে সিক্রি, বিচারপতি এনএম খানইউলকার, বিচারপতি চন্দ্রচুড় ও বিচারপতি অশোক ভূষণ। কেন যে দীপক মিশ্র বিদ্রোহী চার সিনিয়র বিচারপতিকে এ গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চে রাখলেন না, তা অনেককে চিন্তায় ফেলেছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল প্রথমে একবার বিদ্রোহী চার বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, বিরোধ মিটে গেছে। কিন্তু তার পরদিন উল্টো কথা শোনালেন– বিরোধ মেটেনি। সরকার এ বিষয়টা নিয়ে নড়াচড়া করছে না। এটা বিরোধ মেটানোর সদিচ্ছার অভাব কিনা জানি না। তবে বিচারপতিরা নিজেরা এ বিরোধ মেটাতে পারেন কিনা, জানি না। অবসরে যাওয়া বিচারপতিরাই বিরোধটা মেটানোর জন্য উপযুক্ত লোক ছিলেন।

বিদ্রোহী বিচারপতিদের বর্ণনা অনুসারে, প্রধান বিচারপতির আচরণ নিয়মের মাঝে আনা প্রয়োজন। নতুবা বিচারব্যবস্থায় প্রচুর ক্ষতি হবে। অমিত শাহকে নিয়ে যে সরকারের মাথাব্যথা ছিল, তা আন্দাজ করা যায়। কারণ অমিত-নরেন্দ্র জুটি আগামী নির্বাচনেও বিজেপিকে ক্ষমতায় আনতে চায়। ২০১৯ সালের ১৭তম লোকসভা নির্বাচনের কথা চিন্তা করে অমিত শাহকে মামলামুক্ত রাখা প্রয়োজন। মামলার কারণে লাল কৃষ্ণ আদভানি গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। অথচ নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের এক সভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি এবার লালকৃষ্ণ আদভানিকে রাষ্ট্রপতি করে গুরু দক্ষিণা পরিশোধ করবেন। লাল কৃষ্ণ আদভানি, উমা ভারতীয়রা বাবরি মসজিদ নিয়ে মামলার সম্মুখীন হয়ে রয়েছেন বহুদিন ধরে।

ভারতের প্রবীন নেতাদের যারা এ প্রজাতন্ত্রটি গড়েছিলেন তারা কেউ আর বেঁচে নেই। নরেন্দ্র মোদিরা স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের লোক। নরেন্দ্র মোদি কথায় কথায় বলেন, ভারত থেকে কংগ্রেসকে বিদায় দিতে হবে। এখন ভারতের কংগ্রেস আর বিজেপিই সর্বভারতীয় পার্টি। আর সবাই আঞ্চলিক দল। কংগ্রেসকে বিদায় করতে পারলে বিজেপির আর কোনও পথের বাধা থাকে না। তখন হিন্দু জাতীয়তাবাদ কার্যকর করা সহজ হয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আইনের শাসন থাকতে পারে না। ভারতের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ধরে রাখার স্বার্থে কংগ্রেসসহ সবার উচিত হবে আইনের শাসনকে সমুন্নত করা।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ