X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড় দর্শন, পাহাড়ে ধর্ষণ

জোবাইদা নাসরীন
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:৫৮আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৮:৫১

জোবাইদা নাসরীন প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনের ছুটিতে সমতল থেকে বহু মানুষ ছুটে যায় পাহাড়ে। পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সেখানে যায় ছুটি কাটাতে। কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য, সাজেক ভ্যালি, বগালেক না দেখে কেউ ফিরে আসতে চায় না। মধ্যবিত্তের আরোপিত মর্যাদার শোকেসে পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে এগুলো না দেখে এলে নাকি ‘স্ট্যাটাস’ থাকে না। কেউ কেউ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নাচ-গানের খোঁজ করেন। আবার এদের কেউ কেউ এগিয়ে গিয়ে স্থানীয়দের তাদের আপত্তি,অনাপত্তির তোয়াক্কার ধারধারি না হয়ে ছবি তোলেন। ‘রূপসী বাংলায় আসুন এবং এর সৌন্দর্য দেখুন’–এরই তাগিদে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশের পর্যটন করপোরেশন বোর্ড প্রতিবছর হরেক রকম পোস্টার আর ক্যালেন্ডার ছাপে। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দেশের বিখ্যাত মোড়গুলোতে ভিডিও চলতে থাকে ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’। বিলবোর্ডগুলোতে ঝুলতে থাকে আদিবাসী মেয়েদের নাচের ছবি, বিভিন্ন উৎসবের ছবি। সবই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি কত সুন্দর, কত বৈচিত্র্যময় তার প্রকাশ। কিন্তু এর মধ্যে যা থাকে না তা হলো এই ছবিগুলোর অন্য পৃষ্ঠার গল্প। এই ছবি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্য দেখে কারো মনে হয় না এই পাহাড়ে কী চলে, কত নারীর ওপর নিপীড়ন ঘটে।

পাহাড়ে নারী নিপীড়নের ঘটনা এই প্রথম নয়, বরং এখন এটি লাগাতারই হচ্ছে, অন্তত সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান আমাদের এটিই জানান দেয়। কাপেং ফাউন্ডেশনের গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৩৬৪ আদিবাসী নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তার মধ্যে ১০৬ জন শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, ১০০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ৬৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি এই বছরের প্রথম মাসেই ১০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং এদের মধ্যে তিনজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েকদিন ধরে পাহাড় কাঁদছে, কাঁপছে, বিক্ষোভ, প্রতিবাদে ফুঁসছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া সংবাদ অনুযায়ী,২১ জানুয়ারিতে রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়িতে রাতে দুই মারমা সহোদরা ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন।  এই মুহূর্তে এরা দুজন রাঙামাটি সদর হাসপাতালে আছেন। আরও অভিযোগ আছে, হাসপাতাল ছাড়তে চাইলেও তাদের সেখানে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। তবে সেখানে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনজন শুধু তাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন। তারা হলেন মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা, চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় এবং রানী।তবে তাদের সেখানে প্রবেশও সহজ ছিল না, অন্তত চাকমা রাজা এবং রানী যেন যেনের তথ্য থেকে আমরা সেটাই জানি। এর মধ্যে জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলের প্রকাশিত খবরের রেশ দিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে থেকে আমরা জানতে পারি, হাসপাতালে তাদের দেখে সদস্য বঞ্চিতা চাকমা বলেন,‘তাদের একজন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অথচ এখনও কোনও মামলা হয়নি। তারা ভয়ের মধ্যে আছেন। জেলা প্রশাসক একটা প্রতিবেদন দেবেন। ওই প্রতিবেদনের পরে আমরা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেব।’

ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির শিকার মারমা দুই বোনের মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা যে আতঙ্কগ্রস্ত, তা স্পষ্ট। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে না, শুধু নিজের ভাষা মারমা ভাষাতেই কথা বলেন। চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় তাদের সাথে দেখা করে নিজেই ফেসবুকে জানিয়েছেন বিস্তারিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারীরা বিভিন্নভাবে প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। তারা নারী হিসেবে, জাতিগতভাবে, ধর্মীয়ভাবে এবং বেশিরভাগ অর্থনৈতিকভাবেও প্রান্তিক। ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমাকে অপহরণের ঘটনা প্রথম সমতলে নারীদের মধ্যে পাহাড়ের নারী নিপীড়ন নিয়ে মনোযোগ তৈরি করে এবং সমতলের নারী নেত্রীরা প্রতিবাদ করেন। এর আগ পর্যন্ত এই বিষয়ে পাহাড়ে নারী নিপীড়ন হলেও সেটি মিডিয়ায় কম আসতো এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তেমন ছিল না। পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিসরও ভিন্ন ছিল।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য নিপীড়নের মতো পাহাড়ে নারী নিপীড়ন থামেনি, বরং গবেষকরা বলছেন এটি বেড়েছে। কল্পনা অপহরণের বিচার এখনও হয়নি এবং সেটি প্রায় বন্ধ করে ফেলেছে রাষ্ট্রপক্ষ। চার বছর আগেও সাবিতা চাকমার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। আমার গবেষণা এলাকার তিন বছরের শিশু ইতি চাকমাও এই পাহাড়েই ধর্ষণের শিকার হয়েছিল।

মারমা দুই বোন খুব ভয়ে আছে। আমি জানি, নিশ্চিতভাবে জানি ভয়ে আছে তাদের পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনেরাও। ভয়ে মুখ খুলছেন না কিংবা খুলবেন না কেউই। হয়তো কোনও একদিন ভোরে কেউ ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই ওরা দেশ ত্যাগ করবে চুপিসারে। পাহাড়ে হয়েছে তাতে আমার কী? আদিবাসী মারমা মেয়ের ঘটনা, তাতে আমরা জড়াবো কেন? এটাতে বড়মাপের লোকজন জড়িত, তাই এর প্রতিবাদ করা যাবে না–এমনটি ঠিক নয়। এই ঘটনার বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সরকারের পাশাপাশি পুলিশসহ সকল নিরাপত্তা বাহিনীর, বিচারিক আদালতের, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এবং নাগরিক সমাজের এগিয়ে আসতে হবে। এতে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। বিচার নিশ্চিত করতে পারলেই মানুষ হিসেবে আমরা জিতে যেতাম অনেকখানিই।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/ওএফ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ