X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি কি পারবে ‘দূরদর্শী’ সিদ্ধান্ত নিতে?

চিররঞ্জন সরকার
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:৪০আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:৪২

চিররঞ্জন সরকার আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। এই মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় হতে পারে বলে অনেকেই অনুমান করছেন। বিএনপির মধ্যেও এক ধরনের প্রস্তুতি লক্ষ যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দলের সর্বোচ্চ ফোরামের সভা হয়েছে। খালেদা জিয়াকে যদি সত্যিই জেলে যেত হয়, সেক্ষত্রে বিকল্প নেতৃত্ব কী হবে, তা নিয়েও শলা-পরামর্শ হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের মধ্যেও এক ধরনের প্রস্তুতির আভাস রয়েছে। গত শনিবার হোটেল লা মেরিডিয়ানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘যেখানেই থাকি আপনাদের সঙ্গে আছি।’ মামলার রায় নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘নিম্ন আদালত সরকারের পুরো কব্জায়। কতটা কব্জায় তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা সত্য, সঠিক রায় দেওয়ার ক্ষমতা এখন তাদের (বিচারকদের) নেই।’ তার মানে তিনি মোটামুটি ধরেই নিয়েছেন, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির রায় তার বিপক্ষে যাবে।
এই রায়কে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতিতে আবারও টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। গত ৩০ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার আদালত থেকে ফেরার সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একাধিক মামলা করে। এসব মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ প্রায় ২৫০০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ইতিমধ্যে গ্রেফতারও করা হয়েছে। অনেকের বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি যদি বিএনপি চেয়ারপারসনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করা হয়, তাহলে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো নৈরাজ্য ও সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর পুলিশি অভিযান চালানো হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

ক্ষমতাসীনরা বলছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা চলছে প্রচলিত আইনে, বিচার বিভাগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। এই মামলাটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা হয়েছে। মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় সরকার কোনও হস্তক্ষেপ করেনি। বরং বিএনপির আইনজীবীরা যতভাবে সম্ভব মামলার কার্যক্রম বিঘ্নিত ও বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছে। আইনের সীমার মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মেই তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার রায় হবে। এখানে সরকারের কোনও ভূমিকা নেই।

উল্লেখ্য, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এখন দুর্নীতি, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানিসহ মোট ৩৫টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে দুর্নীতির মামলা পাঁচটি। এই পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে।

কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা সরকারের এই ভাষ্য মানছেন না। তাদের কথা হলো, এটা তো অনেক পুরনো মামলা। আরও অনেক মামলা আছে, অনেক দুর্নীতি আছে, সেগুলো নিয়ে এতকিছু হয়নি। কিন্তু খালেদা জিয়ার এই মামলাটি কেন সামনে চলে এলো? আসলে এটি একটি মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এমন মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ হবে।

তবে অনেকের ভাষ্য, পুরো সময়টায় বিএনপি আইনের পথে থেকেছে। এখন রায় হলে কেন রাজনৈতিক কর্মসূচি আসবে? এটা তো হতে পারতো যে শুরু থেকেই এই মামলায় না লড়া। তা যেহেতু হয়নি, তবে কেন এখন মাঠ গরমের চেষ্টা? বরং বিএনপির উচিত আইনি পথেই মামলা মোকাবিলা করা। যদি নিম্ন আদালতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়, তবে উচ্চ আদালতে এর বিরুদ্ধে আপিল করা। অহিংস পথে প্রতিবাদ জানানো। তা না করে বিএনপি যদি সহিংস আন্দোলনের পথে যায়, তাহলে সরকার পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। বিএনপিকে আরও বেশি কোণঠাসা করার মওকা সরকার পেয়ে যাবে।

বিএনপি সমর্থক অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীও চান বিএনপি যেন এই মামলার রায়ের পর ‘ধীশক্তি ও প্রজ্ঞার’ পরিচয় দেয়। সম্প্রতি এক গণমাধ্যমে বিএনপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবী গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, বিএনপির উচিত হবে রায় যাই হোক না কেন, আচরণ ও প্রতিক্রিয়ায় সীমা লঙ্ঘন না করা। এমনকি রায় নিজেদের প্রত্যাশার বাইরে গেলেও প্রতিবাদ কর্মসূচি হতে হবে জোরালো, কিন্তু অহিংস। এর ব্যত্যয় ঘটলে আগামী নির্বাচনের পথরেখা থেকে বিএনপির দূরে সরে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর আরেকটি নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিএনপি। এ বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে যেকোনও মূল্যে দলটির অংশগ্রহণ দেখতে চান বিএনপি মতাদর্শের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা। তারা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না বিএনপির। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার রায়ে যদি দণ্ডও ঘোষিত হয়, তবু ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার কোনও বিকল্প নেই।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ৮ ফেব্রুয়ারি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বা আন্দোলন দমনে ক্ষমতাসীনরা হার্ডলাইনে রয়েছে। বিএনপির যে কোনও হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকেই সহিংস করে তুলতে পারে।

গত শনিবার বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় বেগম খালেদা জিয়া অনেক কথাই বলেছেন, আবার অনেক কিছু অস্পষ্টও রেখেছেন। তিনি মূলত বর্তমান সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি কর্মীদের অভয় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনও ভয় নেই। বিএনপির সঙ্গে প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে, সশস্ত্র বাহিনী আছে। দেশের জনগণ আছে। দেশের বাইরে যারা আছেন, তারা আছেন। কাজেই বিএনপির কোনও ভয় নেই, ভয়টা আওয়ামী লীগের।’ তার এ ধরনের কথায় কর্মীরা কতটুকু সাহস পাবেন, কতটুকু উজ্জীবিত হবেন, সে ব্যাপারে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ, কর্মীরা প্রতিনিয়ত দেখছেন পুলিশ তাদের দাবড়ে বেড়াচ্ছে। প্রশাসনিক আনুকূল্যও তারা খুব একটা পাচ্ছেন না। তাহলে কীভাবে সবাই বিএনপির পক্ষে থাকে? আর বিএনপির সঙ্গে যদি প্রশাসন, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, জনগণ সবাই থাকে, তাহলে বিএনপি নেতাকর্মীদের তো নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেই হয়। শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। তবে কেন এই নির্দেশনা? সবাইকে জেগে ওঠার, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেওয়া? আসলে কর্মীদের চাঙ্গা করার জন্য বেগম জিয়া অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু প্রকৃত দিকনির্দেশনা তার বক্তব্যে পাওয়া যায়নি। এটা দলের কৌশলও হতে পারে। হয়তো পরে তা জানানো হবে।

এ কথা ঠিক, আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষকেই সংযমের পরিচয় দিতে হবে। তা না হলে মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ক্ষোভ-রাগ-ঘৃণা-হতাশা থেকে বিএনপি কর্মীরা যেমন সংঘাত ও নৈরাজ্যের পথ বেছে নিতে পারে, একই সঙ্গে সরকারি দলের অতি-উৎসাহী কেউ বিভিন্ন নাশকতামূলক ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারে। আর সহিংসতা একবার শুরু হলে তা আরও বেশি সহিংসতা ও নৈরাজ্যকেই উৎসাহ জোগাবে। দেশ মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই সতর্ক ও সচেতন হওয়ার কোনও বিকল্প নেই।

আমাদের মনে আছে পাঁচ বছর আগে বিএনপির-জামায়াত জোটের অসহযোগ আন্দোলনের কথা। সেই আন্দোলনে কাজের কাজ কিছুই হয়নি, হয়েছে সাধারণ মানুষের অপরিমেয় ক্ষতি, দুর্দশা-দুর্ভোগ আর জান-মালের বিনাশ।

আরেকটি কথা, বিএনপির অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করার দক্ষতা ও সাফল্য নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। গত পাঁচ বছরে বিএনপি কোনও ইস্যুতেই তেমন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এবার দলের চেয়ারপারসনের দুর্নীতি মামলার রায় নিয়ে বিএনপি আগে থেকেই মাঠ গরম করার একটা চেষ্টা করছিল। কিন্তু সরকার মারমুখী অবস্থান নিয়ে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু করার পর আকস্মিকই বিএনপি নেতাকর্মীরা যেন চুপসে গেছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দিলেও তাতে কতটা সফল হওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে।

বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতারা ২০১৪ সালের মতো এবার নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে চান না। তবে একই সঙ্গে তারা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার রায়কে ঘিরে রাজপথে আন্দোলন করার পক্ষে। তারা চান এটাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আবারও আন্দোলন গড়ে তুলুক বিএনপি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নির্বাচনকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির স্পষ্ট কোনও অবস্থান নেই। যে কারণে তারা গত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছিল, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবারও যদি অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে বিএনপি কী করবে? তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলে দাবি আদায়ের ক্ষমতা ও বাস্তবতা তাদের এখন আছে কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।

এ পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতৃত্বকে যেমন বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ঠিক তেমনি সরকারকেও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু গায়ের জোরে বিএনপিকে দমন করার চেষ্টা করা হলে দলের কর্মীরা নৈরাজ্যমুখী হয়ে উঠতে পারে। আর নৈরাজ্য সব সময় নৈরাজ্যকেই বিস্তৃত করে। তাতে কারোরই কোনও লাভ হয় না। মনে রাখতে হবে, দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারীরা সব সময়ই সক্রিয়। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে তারা মুখিয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত পুরো দেশকে কয়েক যুগ পিছিয়ে দিতে পারে।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে দেশের মানুষ আপাতত সংযম, সহিষ্ণুতা আর দূরদর্শিতাই প্রত্যাশা করে।

লেখক: কলামিস্ট

 

 

/এসএএস/ওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক 
তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক 
গাজায় ৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি ইসরায়েলের
গাজায় ৫০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি ইসরায়েলের
থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা
থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা
জেল থেকে বেরিয়ে ফের শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে জড়ান শিশুসাহিত্যিক টিপু!
জেল থেকে বেরিয়ে ফের শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে জড়ান শিশুসাহিত্যিক টিপু!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ