X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা: ব্রিটেন কি দায়িত্ব এড়িয়ে গেলো?

স্বদেশ রায়
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪:২৭আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৫:০৯

স্বদেশ রায় একটি বিদেশি দূতাবাসের কয়েক কর্মকর্তার বিদায় ও যোগদান অনুষ্ঠানে এক বিদায়ী কর্মকর্তার বিদায় ভাষণ শুনে শুধু লজ্জিত হইনি, নীরবে সেখান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। তার বক্তব্যের মূল কথা ছিল, এ বিদায়ে তিনি সবচেয়ে খুশি এ জন্যে যে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে পারছেন। কারণ, নিরাপত্তার অভাবে এতদিন তিনি তার পরিবার-পরিজনকে বাংলাদেশে আনতে পারেননি। এছাড়া সারাক্ষণ তাকে একটা মৃত্যুভয় নিয়ে থাকতে হতো। তার বক্তব্য শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমিও যেন জঙ্গি। আমার চারপাশে যত বাঙালি দাঁড়িয়ে আছেন বা বসে আছেন সকলে জঙ্গি।
হ্যাঁ, বাংলাদেশে হলি আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এমন ঘটনা কি লন্ডনে, আমেরিকায়, জামার্নিতে, ফ্রান্সে ও ভারতে ঘটে না? তাহলে সেখানে কি এসব দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করেন না? তাছাড়া বাংলাদেশে হলি আর্টিজানের ঘটনার পরে একের পর এক জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে কোনও জঙ্গি হামলা হতে পারেনি। অন্যদিকে ওই সব দেশে তো একের পর এক জঙ্গি হামলা হচ্ছে। তাহলে গোটা বাংলাদেশকে এভাবে চিহ্নিত করার অর্থ কী? এখানে স্বামী, সন্তান বা স্ত্রী নিয়ে চাকরি করতে অসুবিধা কোথায়?
অন্যদিকে বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোনও দূতাবাস বা কোনও কনস্যুলার অফিসে হামলা হয়নি। এমনকি ছোট ছোট শহরে বিদেশি দূতাবাসের যেসব স্যাটেলাইট অফিস বা অন্য কার্যক্রমের অফিস আছে সেগুলোও নিরাপদ। বাংলাদেশে এযাবৎকালের মধ্যে যা ঘটেছে তা জামায়াত-বিএনপি আমলে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপর জঙ্গি হামলা হয় তার নিজ জেলা সিলেটে। আনোয়ার চৌধুরী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এ জন্যে তিনি অনেকটা বাংলাদেশিদের মতো ঘোরাফেরা করতেন, তাছাড়া জামায়াত-বিএনপি আমলটা সত্যি অর্থে অনেক জঙ্গি তৈরির সময় ছিল। পাকিস্তানি জঙ্গি ট্রেনাররা এখানে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতো। বর্তমানে সেই বাংলাদেশ নেই। তাছাড়া এটাও সত্য, জামায়াত ও বিএনপি চেষ্টা করেও তাদের ক্যাডার ছাড়া অন্য কাউকে জঙ্গি বানাতে পারেনি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু। তাদের ধর্মমত বড়ই সহজ-সরল। তারা সকলকে গ্রহণ করে। কোনও অনুদার মনের পরিচয় দেয় না কখনই।
এর বিপরীতে আমরা বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে সাদা-কালোর একটা পার্থক্য দেখতে পাই। বর্ণ সাম্প্রদায়িকতা না হোক,বর্ণবাদী মানসিকতার ঊর্ধ্বে তারা অনেকেই উঠতে পারেননি। অবশ্য সেটা তাঁদের বিষয়। তবে এসব পশ্চিমা রাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশে তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তার ১০০ ভাগের এক ভাগ নিরাপত্তার কথা কি আমাদের যেসব দূতাবাস তাদের দেশে আছে তা নিয়ে তারা চিন্তা করে?
গত সাত তারিখ রাতে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে যে হামলা হলো এ ধরনের একটি হামলা যদি ঢাকার কোনও দূতাবাসে ঘটতো তাহলে গোটা পশ্চিমা মিডিয়া এ নিয়ে কী করতো? কিন্তু আমরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, কী পশ্চিমা মিডিয়া কী আমাদের বাংলাদেশের মিডিয়া, কারো যেন বিষয়টি নিয়ে ততখানি মাথাব্যথা নেই। বরং তাদের সকলের ভাবখানা এমন, এটা আওয়ামী লীগ-বিএনপির একটা ক্যাওয়াজ। কেউই এ প্রশ্ন তুললো না যে, ব্রিটেনে বাংলাদেশ দূতাবাসটি অরক্ষিত। কারণ, সেখানে যেভাবে একদল লোক ঢুকে পড়লো এবং বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছবি টেনে নামালো, ভাঙচুর করলো– সে ভিডিও দেখে তো মনে হয় না দূতাবাসের নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা ব্রিটেন কর্তৃপক্ষের আছে। যেভাবে একদল লোক দূতাবাসের ভেতর চলে গেলো তাতে তো শুধু ছবি ভাঙা এবং এই ছবিকে অপমান করা নয়, আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। তারা কয়েক কর্মকর্তার নাম ধরে ডাকাডাকি করছিলো– তাদের জীবনহানি ঘটতে পারতো।
বঙ্গবন্ধুর ছবিকে নিয়ে তারা যেভাবে অপমান করেছে,বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃপক্ষ কখনোই ব্রিটেনের রানীর ছবি বাংলাদেশস্থ ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে ওইভাবে টেনে নামিয়ে অপমানের সুযোগ দিতো কি? না, তার আগেই দুর্বৃত্তদের লাশ পড়ে থাকতো ব্রিটিশ দূতাবাসের সামনে? অথচ ব্রিটেনের পুলিশ বাংলাদেশের দূতাবাসে হামলা করার সুযোগ দিলো, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি শুধু ভাঙচুর নয়, তা নিয়ে প্রকাশ্যে আরও অবমাননাকর ঘটনা ঘটার সুযোগ দিলো। কীভাবে এটা সম্ভব হলো?
ব্রিটেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তারা ঐতিহ্যে বিশ্বাস করে। তারা অন্য দেশের গণতান্ত্রিক নেতা ও সর্বোচ্চ নেতার সম্মান বোঝে। তাই স্বাভাবিকই তাদের কাছে এখন বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক আশা করে, তারা ভিডিও ফুটেজ দেখে অবিলম্বে সকল আসামি গ্রেফতার করবে। এই আসামিদের ভেতর যদি কেউ কেউ ব্রিটেনের নাগরিক না হয়, তারা যদি বাংলাদেশের নাগরিক হয়, তাহলে অবিলম্বে তাদের বাংলাদেশের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে ইন্টারপোলের কাছে সমর্পণ করবে। কারণ, বাংলাদেশের কোনও নাগরিক যদি বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে কোনও অবমাননাকর কাজ করে, তাহলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার করার সুযোগ আছে। শুধু ব্রিটেন কর্তৃপক্ষ নয়, বাংলাদেশ সরকারের কাছেও বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক আশা করে, এই সরকারের পররাষ্ট্র দফতর এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। ব্রিটেন কর্তৃপক্ষ যাতে ভিডিও ফুটেজ দেখে সবাইকে গ্রেফতার করে, যারা যারা বাংলাদেশের নাগরিক তাদের ফেরত পাঠায় সে দাবি করবে।
ইতোমধ্যে লন্ডনের অনেক বাঙালি সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা জানতে পেরেছেন এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী লন্ডনে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিক, বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত আসামি তারেক রহমান। ব্রিটেনকে অবশ্যই ব্যাখ্যা দিতে হবে, কীভাবে এমন একজন হামলার পরিকল্পনাকারী তার দেশে অবস্থান করছে? পাশাপাশি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে অবিলম্বে এই অপরাধীকে দেশে ফিরিয়ে এনে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার করার।
ব্রিটেনে বাংলাদেশের দূতাবাসে হামলা শুধুমাত্র একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, একটি দেশের দূতাবাসে হামলার অর্থ বাংলাদেশের ওপর হামলা। ব্রিটেনের এই সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মূলত সে কাজ করেছে। পাশাপাশি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে তারা যে কাজটি করেছে তা গোটা দেশের, গোটা জাতির মুখের ওপর জুতো পেটা করার শামিল। এই ঘটনার পরে এখন পর্যন্ত ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের কোনও বক্তব্য ব্রিটেনের কাছে পাঠিয়েছে বলে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়নি। এ কাজটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে করতে হবে। পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে, প্রয়োজনে যাতে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট ও তাদের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন সে বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেই কথা বলতে হবে। দেশের সকলের কাছে এই হামলা শুধু লন্ডনে বাংলাদেশের দূতাবাসের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত নয়, দেশের ও জাতির সম্মানের সঙ্গে জড়িত।
লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ