X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘মুক্ত’ কারাগার, গাছ এবং খালেদা জিয়া

আহসান কবির
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪:২৪আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪:২৬

আহসান কবির এক ভুবনের এক বাসিন্দা খালেদা জিয়া (জাদুঘরে রূপান্তরিত হওয়া পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের একমাত্র বাসিন্দা তিনি। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং একই সঙ্গে দেশের কোনও সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দণ্ড পাওয়া প্রথম মানুষ তিনি) মুক্ত কারাগার সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা সেটা আমার জানা নেই। ভারতবিরোধী রাজনীতি করলেও ইন্ডিয়ান অশোক লিল্যান্ড, টাটা বা সিএনজি আমদানির (পিয়াজ, গরু, পোশাক, সিনেমা, পড়ালেখা বা আরও অনেক ভারতীয় জিনিস এদেশে জনপ্রিয় এবং আমদানি করা হয়ে থাকে!) মতো মুক্ত কারাগার কনসেপ্টটাও তিনি আমদানি করে এদেশে বাস্তবায়িত করতে পারতেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য এটাকে ভাবনার তালিকায় রাখতে পারেন! ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মেদিনীপুর জেলায় চতুর্থ ‘মুক্ত’ কারাগার খোলা হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে। মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলায় ১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই একটি পুরনো রাজবাড়িতে প্রথম মুক্ত কারাগার চালু করে ভারত। চারটি মুক্ত কারাগার আছে পশ্চিমবঙ্গে। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা বাইশ বছর পার করলে তারা মুক্ত কারাগারে আসতে পারেন। মুক্ত কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী সকাল আটটায় উঠে কয়েদিরা কারাগারের বাইরে যেতে পারেন, নিজস্ব আয়ের জন্য চাকরি বা ব্যবসাও করতে পারেন। তবে কোনও কোনও মুক্ত কারাগারে কয়েদিদের ফিরতে হয় রাত আটটায়, কোনোটায় বিকেল পাঁচটায়। কারাগার থেকে বাইরে থাকাকালীন সময়ে কয়েদিরা চাকরি বা ব্যবসা ছাড়াও নিজ পরিবার পরিজনের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন। ‘মুক্ত’ কারাগারের কনসেপ্টটা সম্ভবত খারাপ না। সাতাশ বছর কারাগারে কাটানোর পর দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা যেদিন মুক্তি পান তখন তাকে নিয়ে দেশ-বিদেশে একটা পোস্টার বেরিয়েছিল। পোস্টারের শিরোনাম ছিল–‘ম্যান্ডেলা-বদ্ধ কারাগার থেকে মুক্ত কারাগারে’!

কারগারও কখনও-সখনও মুক্ত হয়। ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডে পর পর আঠারটি জেলখানা মুক্ত হয়েছে। আসামি ও কয়েদির অভাবে জেলখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এক দুটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডের সর্বশেষ জেলটা কয়েদি সংকটে পড়ে গেলে প্রতিবেশী দেশ নরওয়ে থেকে দুইশত চল্লিশ আসামি আনা হয়েছিল। এরা মুক্তি পাওয়ার পর জেলখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জেলে পচিয়ে মারার চেয়ে এই দুটো দেশ আসামি ও কয়েদিদের অপরাধ প্রবৃত্তি মন থেকে দূর করার জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ভেতর নিয়ে আসে। তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দেওয়া হয় এবং সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখা হয়। অপরাধী আর নেই বলে নেদারল্যান্ড ও নরওয়েতে এখন আর কোনও জেলখানা নেই।

বাংলাদেশ কখনও আসামি এবং জেলখানামুক্ত হবে কিনা জানি না। আসামিদের জেলে রাখার জন্য বাংলাদেশে যত আইনই থাকুক না কেন, কিছু কিছু নিয়মের প্রয়োগ হয়তো আদৌ নেই। বাংলাদেশে এখনও যে কেউ চিবানো চুইংগাম কিংবা কলার খোসা যেখানে সেখানে ফেলতে পারেন। বাসে বসে রাস্তায় (আগে বাসের গায়ে লেখা থাকত- হাত ভেতর, থুথু বাহির!) কিংবা হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার যে কোনও জায়গায় থুথু ফেলা কোনও ব্যাপারই না। সিঙ্গাপুরে কোনও একদিন নির্দিষ্ট ডাস্টবিন ছাড়া রাস্তায় চুইংগাম ফেললে এক হাজার ডলার জরিমানা, দ্বিতীয় দিন ফেললে দুই হাজার আর তৃতীয় দিন করলে শাস্তিস্বরূপ একদিন রাস্তা পরিষ্কার করতে হবে! আমেরিকার আইওয়াতে কোনও মেয়েকে চোখ মারলে আপনাকে জরিমানা গুনতে হবে। স্পেনে স্বামীকে স্ত্রী সেবা এবং বাচ্চাদের লালন পালনের জন্য সংসারের কাজে সময় দিতেই হবে। না হলে স্বামীর কপালে শাস্তি নেমে আসতে পারে।

বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, গুয়াম এবং আমেরিকার ওয়াশিংটনে প্রায় একই রকমের একটা আইন আছে। গুয়ামে কোনও কুমারী মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না! সেখানে একশ্রেণির পুরুষ আছে যারা টাকার বিনিময়ে মেয়েদের সঙ্গে ঘুমায় এবং তাদের সার্টিফিকেট দেয়। সেই সার্টিফিকেট নিয়ে তখন মেয়েরা বিয়ে করতে পারে! আর ওয়াশিংটনে একটা কুমারী মেয়ের সঙ্গে বিয়ের আগে কিংবা পরেও ঘুমানো যায় না। তবে মেয়েরা কীভাবে তার কুমারিত্ব বিসর্জন দেবেন সেটার কোনও আইনি ব্যাখ্যা ওয়াশিংটনের আইনে নেই! নিউ ইয়র্কে কোনও মেয়ে বা ছেলে প্রেমের অভিনয় করলে তাকে পঁচিশ ডলার জরিমানা গুনতে হবে! আর জাপানে আপনি যদি কোনও মেয়েকে ডেটিংয়ের প্রস্তাব দেন তাহলে আইনগতভাবে সেই মেয়ের না বলার অধিকার নেই! থাইল্যান্ডে যেসব মেয়ে ত্রিশ বছর বয়সেও বিয়ে করেনি তারা দেশের সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। আমেরিকার মিশিগানেও এমন আইন আছে। মিশিগানের মেয়েরা স্বামীর অনুমতি ব্যতীত মাথার চুল বিক্রি করতে পারে না। কারণ, মেয়েদের চুলও দেশের সম্পত্তি। আর আরকানসাসে স্বামীরা দুইবার বউ পেটালে তাদের শাস্তি হবে, মাসে একবার পেটালে তাদের কিছুই হবে না। নেভাদায় অবশ্য বউ পেটানোর সময় ধরা পড়লে আপনাকে আধাঘণ্টা বেঁধে রাখা হবে এবং আপনার বুকে টাঙানো থাকবে–আমি বউ পেটাই!

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দ্বীপদেশের নাম সামোয়া। এই দেশের বাসিন্দারা বিপদেই থাকে। যদি বউয়ের জন্মদিনটা কোনও স্বামী ভুলে যায় তাহলে স্বামীর জন্য সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ। হংকংয়ে যদি কারও স্ত্রী পরকীয়া করে তাহলে স্বামী বেচারা তাকে খুন করলেও স্বামীর কোনও শাস্তি হবে না যদি সে খুনটা করে খালি হাতে। আর স্ত্রী যার সঙ্গে পরকীয়া করতো সেই প্রেমিককে অস্ত্রহাতে খুন করলেও স্বামীর তেমন কোনও শাস্তি হবে না! হংকংয়ের একটি জনপ্রিয় কৌতুক এমন–এক স্বামী তার স্ত্রীকে খালি হাতে অর্থাৎ গলাটিপে হত্যা করে। আদালতে তার কাছে বিচারক জানতে চাইলেন-পরকীয়ার কারণে তোমার স্ত্রীকে খুন করতে গেলে কেন? তোমার বউ তোমার যে বন্ধুর সঙ্গে পরকীয়া করতো তাকে খুন করলেই তো পারতে। স্বামী উত্তর দিল-আমার বন্ধুর সংখ্যা অনেক। প্রতি সপ্তাহে একজন বন্ধুকে খুন করার চেয়ে একমাত্র স্ত্রীকে খুন করা আমার কাছে অনেক সহজ মনে হয়েছে!

হংকংয়ের মতো বিচিত্র আইন আরও আছে দেশে দেশে। আমেরিকার কোনও কোনও অঙ্গরাজ্যে চিৎকার চেঁচামেচি করে গান গাইলে শাস্তি পেতে হয়। শাস্তি পেতে হয় শব্দ করে চা বা সুপ খেলে। এথেন্সে গাড়ির চালকের লাইসেন্স বাতিল করার অনেক আইনের একটি হচ্ছে গোসল। চালক গোসল না করলে পুলিশ তার লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে। পুলিশের কথা যখন এলো তখন পাকিস্তান ও জাপানের একটা আইনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পাকিস্তানে একবার আইন করা হয়েছিল এই মর্মে যে পুলিশের কোমর ও ভুঁড়ি বেড়ে গেলে তাকে জরিমানা গুনতে হবে। জাপানে বয়স্ক নাগরিকদের কোমর নির্ধারিত সীমানার ভেতর রাখতে হয়। রাষ্ট্রই ঠিক করে দেয় কোমরের মাপ সর্বোচ্চ কত হতে পারে!

বাংলাদেশে একবার কোনও আইন হয়ে গেলে কোনও না কোনোভাবে সেটার প্রয়োগ বা ধারাবাহিক অপপ্রয়োগ চলতেই থাকে। পাকিস্তান আমলে এদেশীয় রাজনীতিবিদদের মামলার ফাঁদে ফেলে তাদের দমিয়ে রাখার কৌশল স্বাধীনতার পর থেকে আজও অব্যাহত আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ২০১৭ সালে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২০০৭-২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হয়েছিল।

তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে বোঝানো কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

তবে স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ক্রমশ বেড়েছে। খালেদা জিয়ার আমলে (২০০১ থেকে ২০০৬) শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা ছিল নয়টি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-০৮) শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছিল ছয়টি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলার সংখ্যা সাইত্রিশটার মতো!

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো আদালত বাতিল করেছে কিংবা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো এখনও চলছে। খালেদা তনয় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ষাট। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অন্য সরকারের আমলে হওয়া (২০০৯ থেকে ২০১৩ সালে) সাত হাজারেরও বেশি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছিল, বেশিরভাগ প্রত্যাহারও করা হয়েছে!

আবার শেখ হাসিনার আমলে (২০০৯ থেকে ২০১৮) আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া দুইশত ছয়টি মামলা নতুনভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার আমলে অর্থাৎ ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত একই রকমভাবে অর্থাৎ রাজনৈতিক বিবেচনায় পাঁচ হাজার আটশত আটাশি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয় এবং নয়শত পঁয়তাল্লিশটি মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। ওই সময় প্রায় চুয়াত্তর জন আসামি এই প্রক্রিয়ায় বিচার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। সঠিক বিচারকে পাশ কাটিয়ে বিচারহীনতার এই রিলে রেস দশক দশক ধরে চলছে। তারপরও বলতে হবে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে!

জর্জ অরওয়েল তার এনিম্যাল ফার্ম উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘এভরিবডি ইজ ইকুয়াল বাট সামবডি ইজ মোর ইকুয়াল’! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলেও তাদেরকে অন্য আসামিদের মতো প্রচলিত জেলখানায় নেওয়া হয়নি, নতুন করে সাবজেল বানানো হয়েছিল। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে জাদুঘরে রূপান্তরিত হওয়া সাবেক কেন্দ্রীয় জেলে।

স্বাধীনতার পর প্রায় সব সরকারই ‘গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’ এই কর্মসূচি পালন করেছে। জানি না সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের মতো খালেদা জিয়া কোনও গাছ লাগাবেন কিনা কিংবা এরশাদের লাগানো বরই গাছের বরই খুঁজবেন কিনা!

মানুষ আর গাছের পার্থক্য প্রতিশোধে। গাছ কখনও প্রতিশোধ নেয় না। তার ছায়া ও ফল দেওয়া অব্যাহত থাকে!

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
দক্ষিণ লেবাননে ‘আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ’ নিচ্ছে ইসরায়েল
দক্ষিণ লেবাননে ‘আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ’ নিচ্ছে ইসরায়েল
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯ মাসে ৪৩৫৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯ মাসে ৪৩৫৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ