X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

তরুণের মৃত্যুর জন্য আমরাই দায়ী...

জোবাইদা নাসরীন
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪:২৭আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪:৩২

জোবাইদা নাসরীন যখন ফেসবুকে আমরা করপোরেট ভালোবাসা দিবসের বিভিন্ন ছবি দেখি, ক্যাম্পাসকে দেখি হলুদ, লালে ভেসে যেতে, ভালোবাসা ভরা তারুণ্যের দাপট দেখি মোহিত হই কিন্তু আমাদের এই ভালোবাসা দিবসের ‘দেখানো’ ভালোবাসাকেই ব্যঙ্গ করেছে তরুণ নামের আরেক তরুণ। এই তরুণ তার তারুণ্যের ডানা মেলতে পারেনি। এই ক্যাম্পাসেই অনাদরে, বন্ধুবান্ধবদের ভালোবাসাহীনতায়, বুলিং এবং শিক্ষকদের অবহেলা সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহত্যা করেছে। বিষয়টি খুব কম গণমাধ্যমেই এসেছে, কারণ সেই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল। শিক্ষার্থীদের মৃত্যু নিয়ে কখনও খুব বেশি নড়াচড়া হয় না বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে এটি যদি হয় আত্মহত্যা তাহলে তো কথাই নেই। একটু আহা, উহুর মধ্য দিয়েই ভুলে যাই সেই শিক্ষার্থীর কথা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র তরুণ হোসাইনের আত্মহত্যার কারণ হতাশা। তার সহপাঠী আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও সেটিই জানেন। বুধবার দুপুরে হাজারীবাগের সেকশন এলাকায় বেড়িবাঁধের কলার আড়তের পাশে নির্মাণাধীন একটি মসজিদের পাশ থেকে তরুণের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
কুষ্টিয়ার একটি গ্রাম থেকে এসেছিল তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুযোগ পেয়েছিল বাণিজ্য অনুষদের একটি ‘বনেদি’ বিষয়ে পড়াশোনা করার। কিন্তু সে হয়তো জানে না এই সমাজ ব্যবস্থায় মানুষকে নানাভাবে হেয় করার কলাকৌশল, যা আমরা নানাভাবে রপ্ত করেছি এবং সেগুলো প্রশ্নহীনভাবেই চর্চিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ছিল সে। থাকতো ১১৩ নম্বর কক্ষে,যেটি সেই হলের গণরুম হিসেবেই পরিচিত।

সেখানেই অন্যদের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতেন তরুণ হোসাইন। হলে তরুণ সবসময় হতাশায় ভুগতেন, গণরুমে তার বন্ধুরা নানা সময় বিভিন্নভাবে তাকে উপহাস করতো। এই ধরনের উপহাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই ঠিকভাবে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারে না। তরুণের ঘটনা যখন পড়ছিলাম তখন মনে পড়ছিলো আমারই বিভাগের এক ছাত্রের কথা। আমি ভাবছিলাম আমার ছাত্রটিও তরুণ হতে পারতো, সে ক্ষোভে, যন্ত্রণায় অসম্মানে আত্মহত্যা করতে পারতো। একদিন সে আমাকে বলেছিলো তার একটি কোর্সের খারাপ ফলাফল হওয়ার কারণে সে অনেক পিছিয়ে গেছে। সেটিরও কারণ ছিল এমনই পীড়ন। খুব কষ্ট নিয়ে সে যা বলেছিলো তা ছিল এই রকম, ‘আমি দরিদ্র ছাত্র বলে ওই গণরুমের প্রায় সব ছাত্র আমাকে উপহাস করতো। তাদের কোনও কিছু হারালে প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞাসা করতো এবং সন্দেহ করতো। সেই পরীক্ষার আগের রাতে গণরুমের এক বড় ভাইয়ের মোবাইল হারানো যায় এবং তিনি আমাকে সন্দেহ করে নিয়ে যান আরেক রুমে। সেখানে আমাকে মানসিকভাবে নিপীড়ন করেন এবং বেঁধে রাখেন। সারারাত আমাকে বেঁধে রেখেছিলো। আমি অনেক কান্নাকাটি করে বলেছি আমার পরীক্ষা পরের দিন। কিন্তু আমাকে সারারাত আটকে রেখেছিলো, আমার একটাই দোষ,তারা জানতো, আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান, টিউশনি করে বেঁচে আছি। পরের দিন যখন সেই ভাইয়ার মোবাইল পাওয়া গেল অন্য জায়গায় এবং আমাকে ছেড়ে দিল, তখন অলরেডি ১০:৩০, যেখানে আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে সকাল ৯টায়। আমি যখন পরীক্ষার হলে পৌঁছলাম,তখন ১০:৪৫।’

পত্রিকার খবর থেকে আরও জানা যায়,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চাকচিক্যে’ ঝলকানিতে ভরপুর বাণিজ্য অনুষদের ফিন্যান্স বিভাগে কোনও এক কোর্সের প্রেজেনটেশনের (উপস্থাপনা) সময় অন্যদের মতো চটপটে ইংরেজি বলতে না পারায় শিক্ষকের উপস্থিতিতে তরুণকে পড়তে হয়েছিল বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। ফিন্যান্স বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর মুখ থেকে জানা যায়, ‘তার আত্মহত্যার প্রধানতম কারণ হলো বিভাগের চাপ। কারণ, প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের একটা কোর্সে বারবার মানোন্নয়ন দেওয়া সত্ত্বেও তার ফলাফল ভালো হচ্ছিল না।’ তরুণ তার বন্ধুদের বিভাগ থেকে পাস করতে পারবেন কিনা,সে বিষয়ে সংশয়ের কথা বলতেন। যদি ড্রপআউট হয়ে যায় তাহলে কী করবেন,সে কথাটাও তুলতেন।

অন্যকে হেয় করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা আমাদের সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে। প্রথম বর্ষ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে,ঢাকা বনাম মফস্বল/ গ্রাম, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, স্মার্ট-আনস্মার্ট এগুলো নিয়ে বুলিং চলে,চলে মনস্তাত্ত্বিক নিপীড়ন। এটি প্রথম বর্ষেই বেশি হয়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে কোন ধরনের আইন নেই। নেই কোনও ধরনের অন্যকে সম্মান দিয়ে জীবনযাপনের প্রতিশ্রুতি আদায় করা কোনও শক্ত ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম। প্রতিবছরই প্রথম বর্ষ থেকেই এই ধরনের বুলিংয়ের শিকার হয়ে হতাশার মধ্য দিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করে অনেক শিক্ষার্থী। অনেকেই মোকাবিলা করতে না পারায় ঝরে পড়ে। তরুণের বন্ধু এমএসআই খান এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন,গণরুমে ‘তরুণ’ (তরুণ হোসেন) ছিল সবচেয়ে নিরীহ একটি ছেলে। শৈশবে মা-হারা অযত্নে বড় হওয়া এই ছেলেটি ২০১৫-১৬ সেশনে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। আর্থিক সংকটে জর্জরিত ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নানা কারণে চরম হতাশায় ভুগতে শুরু করে। তার শারীরিক গঠন ও দেহের কালো রঙের কারণে অনেকের কাছেই সে যেন একটু বেশিই নিগৃহীত হতো। কিন্তু আমি জানতাম ছেলেটা কতটা মেধাবী,কতটা সংগ্রামী। সহপাঠীরা জানতেন, তরুণ ফিন্যান্স বিভাগ পাল্টে অন্য বিভাগে যেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন শিবলী রুবায়েতুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু তিনি তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে বলেছিলেন।

আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাথা ঘামাই না,আমরা তাদের হতাশা নিয়ে কথা বলি না। ছেলেটি হতাশ হয়ে পড়ছিল, এ বিষয়টি যখন তার বন্ধুরা জানতেন,নিশ্চিতভাবেই টের পাওয়ার কথা তার শিক্ষকদেরও। আর জানার পর তাকে কাউন্সিলিং (পরামর্শদান) করার জন্য বিভাগের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি কোনও উদ্যোগ। অথচ ছাত্রদের কাউন্সিলিং করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আছে কাউন্সিলিং সেন্টার।

তাই তরুণের এই মৃত্যুর জন্য আমরাই দায়ী। আমরা তাকে ডানা মেলে ওড়বার ক্ষেত্রে সহায়তা করিনি বরং তাকে ঠেলে দিয়েছি, দূরে,অনেক দূরে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ, জরুরি ভিত্তিতে বুলিংবিরোধী আইন করুন,যেন কোনও তরুণ অনাদরে অভিমানী না হয়ে ওঠে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সম্মানজনকভাবে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করবেন শিক্ষকরাই।

লেখক:  শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ