X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের ভাষা, আমাদের স্বাধীনতা

আনিস আলমগীর
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:৪৫আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:৪৯

আনিস আলমগীর বাংলা ভাষা আমাদের আত্মপরিচয়। সৌভাগ্য যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভাষাগত পরিচয়ের পাশাপাশি এই ভাষায় কথা বলা মানুষরা একটি দেশও পেয়েছে। বিশ্বে ২৫ কোটি বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে। অবশ্য সবাই এক রাষ্ট্রে বসবাস করি না। পশ্চিম বাংলার সবাই তো বাংলাভাষী। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের অংশ নয়। তারা ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য।
পেলিকান পাখি যেমন নিজের রক্ত দিয়ে নিজের শুশ্রুষাকরে পূর্ব বাংলার মানুষও নিজের রক্ত দিয়ে নিজের ভুলের শুশ্রুষা করে সেরেছে। সব ক্ষেত্রে ভাষাও প্রতিষ্ঠা করেছে। আবার খণ্ডিত হলেও ভাষাগত পরিচয়ের একটা রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। বাংলা ভাষা নিয়ে বাংলাদেশে যত আবেগ পশ্চিম বাংলায় তা নেই। সেখানে মানুষ ভাষার ব্যাপারে উদাসীন মনে হয়েছে। শহরাঞ্চলের বাঙালিরাও ঘরের বাইরে হিন্দি ভাষায় কথা বলেন।
আমি একবার কলকাতা সফরে গিয়ে তিনদিনের জন্য একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে আশপাশের বিভিন্ন শহর দেখতে গিয়েছিলাম। ড্রাইভারটি ছিল যুবক। সে আমার সঙ্গে হিন্দি ভাষায় কথা বলতো। তাকে যেদিন কলকাতা শহরে এসে বিদায় করি তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুম কাহাকা রেহনেওয়ালা’। ছেলেটা আমাকে হাসিমুখে বলল, ‘হামারা খাদ্দানতো বাগেরহাটকা রেহনেওয়ালা’। আমি দেখলাম এরা হিন্দিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আবার ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতে যখন গিয়েছি, বাংলাদেশি শুনলে লোকজন উর্দুতে কথা বলতে চাইতো। ওদের ধারণা মুসলমান মানে উর্দু ভাষায় কথা বলে। এমনকি কলকাতাতেও দু-একবার এমন ঘটেছে।

পশ্চিমবঙ্গে গ্রামাঞ্চলের চিত্র ভিন্ন। তারা বাংলায় কথা বলা অব্যাহত রেখেছে। পশ্চিম বাংলার সুশীলরা এ নিয়ে কোনও মাতামাতি করে না। অথচ তারা বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছেন অব্যাহতভাবে। শুধু কবি আলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর এক সাক্ষাৎকারে দেখেছিলাম, ২০১৩ সালে তিনি বলেছিলেন যে ‘ভাষার জন্য আমাদের নতুন করে শহীদত্ব নেওয়ার সময় এসেছে।’ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন না হলে আর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশটা প্রতিষ্ঠা না হলে বাংলাদেশেও ভাষা নিয়ে এমন এলোমেলো অবস্থা সৃষ্টি হতো।

১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেন ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু শেল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’ বলেছিলেন জানি না। জিন্নাহ ছিলেন ইংলিশ লিবারেলিজম মুভমেন্টের সন্তান। সম্ভব তো ইংলিশ সভ্যতার প্রতি আসক্তির কারণে তিনি ভারতের ইতিহাসকে উপেক্ষা করেছিলেন। না হয় আজ থেকে শত শত বছর আগে সুলতানি আমলে সুলতানেরা যে বাংলা ভাষার ওপর হাত দেননি বরং ভাষা সাহিত্যের উন্নয়নে সহযোগিতা করেছিলেন, সেখানে জিন্নাহ কেন হঠাৎ করে এ কথা বলে বসলেন। অথচ জিন্নাহ নিজেই উর্দু ভাষা জানতেন না। তিনি তার সারাজীবন বক্তৃতা দিতেন ইংরেজি ভাষায়। সম্ভবত তিনি ইতিহাস থেকে কোনও শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেননি।
অথচ প্রাচীনকাল বাদ দিলেও ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ১১টি প্রদেশের মাঝে ৮টি প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠন করেছিলো। সরকার চলতো কংগ্রেসের হাইকমান্ডের নির্দেশে। হাইকমান্ড বলেছিলেন প্রাদেশিক পর্যায়ে হিন্দি ভাষা চালু করার জন্য। তখন মাদ্রাজ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন রাজা গোপাল আচারি। তিনি হাইকমান্ডের নির্দেশ অনুসারে হিন্দি চালু করেছিলেন। গোপাল আচারির এ সিদ্ধান্তের পর পুরো দক্ষিণ ভারত আন্দোলনের তোড়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। সরকার বলেছিলো ৬/৭ জন লোক নাকি মারা গিয়েছিলো। কিন্তু জনশ্রুতি আছে ৫০০ লোক শহীদ হয়েছিলো।

এরপর কংগ্রেস হাইকমান্ড তাদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৬৫ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী রেডিওর মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন যে অনির্দিষ্টকালের জন্য ইংরেজি ভারতের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এখনও ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইংরেজি। এ দৃষ্টান্তটা জিন্নাহর চোখের সামনের ঘটনা। তিনি কিন্তু এ ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষা গ্রহণ করেননি।

পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি ছিলো সাম্প্রদায়িক দাবি। ভারত বিভক্তির পর জিন্নাহ ছাড়া যারা পাকিস্তান সংগ্রাম করেছিলেন তারা অতিরিক্ত মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। তারা আবদার করলেন আরবি হরফে বাংলা লেখার জন্য। আবার কেউ কেউ বললেন ল্যাটিন হরফে বাংলা লেখার জন্য। আর এ দলে কবি গোলাম মোস্তফা, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের মতো মানুষও ছিলেন।

চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অধ্যক্ষ এ.এ. রেজাউল করিম চৌধুরী ওই সময়ে কলেজ ম্যাগাজিনে আরবি হরফে বাংলায় একটা মুখবন্ধ লিখেছিলেন। তিনিও আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে ছিলেন, অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে লেখাপড়া করা লোক ছিলেন তিনি। কলেজ ম্যাগাজিনে তার মুখবন্ধটা ছিলো অনুরূপ, ‘সাহিত্য নূরও নয় নারও নয়, ইহা রুহানি তজ্জলির রুহে আতকসদা।’ লোকে কী বুঝেছে জানি না। আমি এর কিছুই বুঝছি না।

অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির পর একগোষ্ঠী চাইলো বাংলা ভাষাটাকে টুপি পরিয়ে মৌলভি বানাতে, আবার আরেক গোষ্ঠী ভাষার ভেতর অসংখ্য সংস্কৃতি শব্দ ঢুকিয়ে চেষ্টা করলো পৈতা পরা ব্রাহ্মণ বানাতে। সুখের বিষয় যে ভাষা আন্দোলনের কারণে কোনোটাই সফল হয়নি। আসলে ভাষা হচ্ছে প্রবহমান নদীর মতো। এটি কারো আদেশ মানে না, আপন খেয়ালে চলে। প্রয়োজনে গ্রহণ করে প্রয়োজন না হলে বর্জন করে। জোর করে তার ওপর কিছু চাপাতে চাইলে মরু পথে হারা নদীর মতো গতি হারিয়ে ফেলে। বাংলা ভাষায় প্রতিদিন সংযোজন হচ্ছে নতুন নতুন শব্দ। সোশ্যাল মিডিয়া যুগে এসব শব্দ পরিচিতিও পাচ্ছে, ভাষায় ঢুকে যাচ্ছে দ্রুত।

একটু যদি ইতিহাসে তাকাই দেখতে পাই, ভাষা আন্দোলনে প্রাথমিক অবদান ছিল তমদ্দুন মজলিসের। তাদের একটা পত্রিকাও ছিল ‘সৈনিক’ নামে। প্রফেসর আবুল কাশেম সাহেব ছিলেন তার নেতা। পরবর্তী সময়ে প্রফেসর আবুল কাশেম সাহেব মিরপুর বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা সন্তান। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের এমপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তমদ্দুন মজলিস ল্যাটিন অক্ষরে বাংলা লেখা বা আরবি হরফে বাংলা লেখার পক্ষে ছিল না সত্য, তবে তাদের লিটারেচার পড়ে মনে হয়েছে তারা প্যান ইসলামিজমে বিশ্বাস করতেন। তাদের হাতে বেশি দিন নেতৃত্ব ছিল না। জাতীয়তাবাদীরা নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। জাতীয়তাবাদীদের নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুল মতিন, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন, মোহাম্মদ তোহা, নারায়ণগঞ্জের শামসুজ্জোহা প্রমুখ। ২১শে ফেব্রুয়ারির নায়ক তারাই। তমদ্দুন মজলিসও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। তারাও আন্দোলনে ছিল।

ভাষা আন্দোলনের কারণে বাঙালি জাতি যে ভাষাভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র জাতি, এই উপলব্ধির জন্ম নেয় তখনই। বিচিত্র ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের জন্মের ঠিকুজিতেই মৃত্যুর তারিখটা লেখা ছিলো। বড় লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, পাকিস্তান ২৫ বছর টিকবে। মওলানা আজাদ বলেছিলেন ২৩ বছর আর নেহরু বলেছিলেন ১৫/১৬ বছর। তাদের কথাই সত্য হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই বিচিত্র ভৌগোলিক রাষ্ট্র শাসকশ্রেণির অদূরদর্শিতার কারণে টিকে থাকতে পারেনি।

ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা উন্মোচিত হয়েছিলো তার পরিচর্যা করেছেন ভাষা আন্দোলনের প্রায় সব নায়করা। দীর্ঘ ২৩ বছরের উত্থান পতনে বহু নায়ক প্রান্তিক ভূমিকায় চলে যান। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান অব্যাহতভাবে এই আন্দোলন চালিয়ে যান। সুশৃঙ্খলভাবে অব্যাহত রাখেন এই সংগ্রাম। যে কারণে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো। তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘামে ভেজা ত্বকের যত্নে...
ঘামে ভেজা ত্বকের যত্নে...
চট্টগ্রামে ক্রিকেটারদের ‘ক্লোজড ডোর’ অনুশীলন
চট্টগ্রামে ক্রিকেটারদের ‘ক্লোজড ডোর’ অনুশীলন
হাসপাতালের ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
হাসপাতালের ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রাঙামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে ৬ শ্রমিক নিহত
রাঙামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে ৬ শ্রমিক নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ