X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

একুশে ফেব্রুয়ারি: বাংলাদেশে, বিশ্বে

দাউদ হায়দার
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:২৩আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:২৬





শোকের ঐতিহ্য, পরম্পরা আছে। দাউদ হায়দার শোক যদি উৎসবে পরিণত হয়, ইতিহাস ভুলে যায়। ইতিহাসের হানি দেশের সার্বিক চারিত্রনীতিও বিভ্রান্ত। পৃথিবীর নানাদেশেই এই ঘটনা। সাম্প্রদায়িকতার জোয়ার, বার্ট্টান্ড রাসেল বলছেন, ‘আধুনিকতার প্রবাহ।’ অর্থাৎ একই কথা। বাংলাদেশও আবর্তমান। জোয়ারে বা প্রবাহে।


আতুরঘর থেকে শুনে আসছি, বাংলাদেশ ঐতিহ্যবাহী, আবহমান সংস্কৃতির ধারক, বিপ্লবের উত্তরাধিকার। কথাটি বোধ হয় ইদানীং খুব গোলমেলে। অসাম্প্রদায়িকতার তিলকে কলঙ্ক স্পষ্ট, সখন। এর সঙ্গে ধর্মব্যবসায়ী নয় শুধু, ক্ষমতাসীন,রাজনীতিকও জড়িত। এই নিয়ে বুদ্ধিজীবী-কবি সাহিত্যিক-শিল্পী-অধ্যাপকরা কাড়তে নারাজ। ভয়ে? না কি নিজের আখের নিয়ে? তা হলে ‘মাঝে-মাঝে’ বিপ্লবের কথা, বিপ্লবের সবক কেন?
টোমাস মান (নোবেলজয়ী সাহিত্যিক) ‘জোসেফ ব্রুডাস’ উপন্যাসে বলছেন, ‘হুজুগে বিপ্লবী, হুজুগে সমাজসংস্কারক, হুজুগে বুদ্ধিজীবী দেশ ও দশের সর্বনাশ।’ প্রায় ৯০ বছর আগে বলা এখনো মিথ্যে নয়।
বলতে ভুলে গিয়েছি, আফ্রিকার কোনো-কোনো দেশে, ট্রাইবাল গোষ্ঠী, মৃত্যুর পরে শোকের বদলে নাচ-গান-আনন্দ-উৎসব করে। বিশ্বাস, স্বর্গে গিয়ে ফুর্তিতে থাকবে। তবে মৃতের সৎকারের পরে তার কর্ম, পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে পায়ের-হাতের নখ, চুল, দাঁত যথাস্থানে সজ্জিত রাখে। পরবর্তী প্রজন্ম ও ভাবিকালের জন্যে, প্রেরণাদায়ক হিসেবে। দেখেছি আফ্রিকার ঘানায়, মালিতে।
-আচ্ছা,‘আসাদের শার্ট’ (স্মরণ করুন শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা) কি কোনও জাদুঘরে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত? কিংবা ভাষা আন্দোলনে শহীদ রফিক, সালাম, বরকত প্রমুখের কোনও কিছু?

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি নিয়ে কোনও মহৎ উপন্যাস লেখা হয়নি। জহির রায়হান চেষ্টা করেছেন বটে, সার্বিক বিচারে উত্তীর্ণ হয়নি। কিছু পদ্য রচিত, তাৎক্ষণিক। আবেগমাখা। আবেগাক্রান্ত। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ মূলত আবেগভরা পদ্য। আলতাফ মাহমুদের সুরে গান হয়ে বাংলার ঘরে-ঘরে।

স্মরণ আছে অনেকের হয়ত, ১৯৭৩ সালে, ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে, কবি-গবেষক হুমায়ুন কবির প্রবন্ধপাঠে শুরুই করেন, ‘আবদুল গাফফার চৌধুরীর এই গান, বাংলাদেশের সর্বত্র, একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে…’ শ্রোতাকুলের আপত্তি নেই,বরং তুমুল করতালি। এই প্রবন্ধ বাংলা একাডেমির সাময়িকীতেও প্রকাশিত। এই প্রবন্ধ কি কোন সাময়িকপত্রে বা সংকলনে পুনমুর্দ্রণ সম্ভব এখন?
প্রকাশকের উদ্বিগ্নকণ্ঠে টেলিফোন, ‘নাম দিয়েছি কুসুমমঞ্জরী’ রিপ্রিন্ট করছি তবে ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ কবিতা বাদ দিচ্ছি। ছাপলে বই নিষিদ্ধ করবে সরকার। মোল্লারা কতলও করতে পারে।’

বলা দরকার, ১৯৯৫ সালে ওই বই ঢাকা-কলকাতা থেকে প্রকাশিত। সরকার নিষিদ্ধ করেনি। প্রকাশকও কতল হননি। এখন ভয় কেন? হেতু কী? কৌতুক-অভিনেতা ভানু ব্যানার্জির একটি ডায়লগ আছে, ঢাকাইয়া ভাষায়: ‘হগগলে জানে,তুমি মিয়া জানো না? অন্য কথা কও।’
১৯৬২ সালে প্রথম ঢাকায় এসেছি, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায়। প্রথম আস্তানা ২৩ বেচারাম দেউড়ি, খোদ কুট্টি এলাকায়। পরে মালিবাগে (১৯৬৪ সালে)।
১৯৬৫ সাল থেকে, একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে প্রভাতফেরি, আজিমপুর কবরে গিয়ে শহীদের কবরে ফুল দেওয়া (স্বীকার করছি, রমনা পার্ক থেকে নানারকম ফুল ছেঁড়া), শহীদ মিনারে যাওয়া, খালি পায়ে, সাতসকালে। বিন্রম যাত্রা। বিন্রম শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। একা নই। বন্ধুবান্ধব, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে।
-ষাট বছর আগের কথা বলছি।

দিনকাল পাল্টেছে, রাসেলের কথায় ‘আধুনিকতা’ হয়তো। নানামুখে শুনি, প্রভাতফেরি, খালি পায়ে হাঁটা (একুশের সকালে), কবরে ফুল দেওয়ার বিপ্লবী ঐতিহ্য ‘প্রায়-নেই।’ ইতিহাস।
‘দাও ফিরে সেই অরণ্য’, কবিতায় বিলাপ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আর্তনাদ, কোথায় গেল পরম্পরা, ইতিহাস, বিপ্লবের চেতনা, প্রেম?

বছর কয়েক আগে মোজাম্বেকের তিনটি শহরে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম, আয়োজকদের নেতা বললেন, ‘এথনিক ল্যাঙ্গুয়েজ রক্ষার্থে সংগ্রাম করছি, সংগ্রামের প্রেরণা বাংলাদেশ। আপনারাও নিশ্চয় করছেন। বিশ্বব্যাপী করপোরেট-ব্যবসায়ীর চাপে মাতৃভাষাও লোপ পাচ্ছে’।

-কীভাবে উদ্ধার করা যায়?

জার্মানির চারটি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ নিয়েছে। বিরাট অর্থ দিচ্ছে। সমস্যা এই, এক্সপার্টের অভাব, ভাষাবিদ, গবেষকের অভাব। ধরা যাক বাংলাদেশের কথা। বাংলা একাডেমির ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৫। প্রধান সম্পাদক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ)-এ যে আঞ্চলিক ভাষা ছিল (কিছু), কালক্রমে পরিবর্তিত। এথনিক ভাষা লুপ্ত। উদ্ধারের দায় নেবে ভাষার মাসে?

ভাষার মাস নিয়ে ঝামেলায় আছি। বাংলাদেশের ৯৯.০৯ ভাগ সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী বাংলা লেখক, সাংবাদিক অশুদ্ধ বাংলা লেখেন। আগাপাশতলা চাপকিয়েও ‘মানুষ’ করা যাবে না। ওদের লেখা পড়ে আপনারা যা শিখছেন, শিবেরও অসাধ্য শুদ্ধ করা।

এই পর্যন্ত লিখে, লেখার ইতি টেনে, বিছানায় যাবো, মঈন চৌধুরী ওরফে পিটু টেলিফোনে প্রশ্ন করেন, ‘আজ  একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে আপনার জন্ম, এই দিনে আর কারো জন্ম হয়নি?’

বলি, ‘পূর্ব পাকিস্তানের আদম শুমারির হিসেবে, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ৬৬৮ জনের জন্ম হয়েছিল। একা নই। আজ প্রত্যেকের জন্মদিন। এই জন্মদিনে বাংলাদেশেরও জাগরণ, জন্মদিন।

একুশে ফেব্রুয়ারি শোকের নয় আনন্দের। গোটা বাংলাদেশ আমাদের জন্মদিন পালন করছে। গোটা বিশ্বও।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

আপ- এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ