X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে ফুলির মা’র কী?

মাসুদা ভাট্টি
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:১০আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:২২

মাসুদা ভাট্টি দুর্নীতির দায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে বন্দি। তার এই বন্দিত্ব নিয়ে বাংলাদেশ মোটাদাগে বিভক্ত। বিএনপি সমর্থকদের দাবি তিনি নির্দোষ এবং রাজনৈতিক কারণে বিশেষ করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে আওয়ামী লীগ সরকার কারাগারে আটক রেখেছে। দীর্ঘ ১০ বছর মামলা চলার পর, একাধিকবার উচ্চ আদালতের কাছে ধরনা দেওয়ার পর যে মামলার রায় ঘোষণা করলেন আদালত, সেই মামলাকে তাড়াহুড়ো করে রায় দেওয়া হয়েছে বলে যখন অভিযোগ করলেন বিএনপি নেতারা তখন সেটি ধোপে টিকলো না। কারণ, মানুষ সেরকমটি মনে করে না। যদিও বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি যে বেগম জিয়া দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড লাভ করায় তাদের দল আগের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়। বিএনপি নেতাদের এই দাবিটি গ্রহণযোগ্য। একদিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জেলে গেলে তা দোষ করেই যান আর নির্দোষ হিসেবেই যান, তাতে জনগণের কাছে তার জনপ্রিয়তা বাড়ে মূলত দুটি কারণে, এক. সাধারণ জনগণ মনে করে যে যদি তিনি দোষ করেই জেলে গিয়ে থাকেন তাহলে জেলে যাওয়ার ফলে তার পাপ কিছুটা হলেও স্খলন হয়, দুই. আর সংশ্লিষ্ট দলের নেতাকর্মীরা মনে করে যে রাজনৈতিকভাবে এরকম একজন নেতাতে হেনস্থা করা হয়েছে, ফলে তার পক্ষে দাঁড়ানোটা এখন নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, দেশের যে সাধারণ ভোটারশ্রেণি, যাদের ভোটে নির্বাচনে কোনও নেতা বা তার দল জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন সেই ভোটারদের কতটুকু উপকার হয় নেতার কারামুক্তি হলে? এক্ষেত্রে বেগম জিয়া সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা হচ্ছে কিন্তু আজকে তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও একই প্রশ্ন তোলা যেত।

বিএনপি নামক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মটি আজ এগারো বছর ধরে বলতে গেলে রাজনীতির বাইরে। রাজনীতির বাইরে এ কারণেই বলছি যে ১/১১’র সরকার থেকেই তারা মূলত রাজনীতি করছে নিজেদের বাঁচাতে, বিশেষ করে দলটির নেতাকর্মীদের বাঁচাতে। কখনও তারেক জিয়া, কখনও বেগম জিয়া কিংবা তার অপর পুত্র কোকো, এদের জন্যই দলটি মূলত গত এগারো বছর যাবৎ রাজনীতি করছে। এর বাইরে কারও জন্য দলটি রাজনীতি করেছে কিনা সেটা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। লক্ষ্ করলে দেখা যায় যে ১/১১’র আমলে বেগম জিয়ার কারামুক্তি ছিল দলটির মূল উদ্দেশ্য। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দলটির উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তারা সেই সময় নির্বাচনে পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তাতে তাদের বাজে ধরনের পরাজয় হয়েছে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি আসন নিয়েও যদি কোনও দল সংসদে প্রবেশ করে তাহলে তার দায়িত্ব হয় জনগণের ভোটের প্রতি সম্মান জানিয়ে সংসদকে কার্যকর করে তোলা এবং জনগণের পক্ষে কথা বলার কোনও সুযোগকেই হাতছাড়া হতে না দেওয়া। কিন্তু আমরা দেখেছি মুখে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বললেও বিএনপি বিশেষ করে বেগম জিয়া সংসদের প্রতি এক ধরনের অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন সেই শুরু থেকেই। সংসদে অনুপস্থিতির রেকর্ড তৈরি করেন বেগম জিয়া ও তার দল বিএনপি। ফলে সেই সময় জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্য আর কেউ সংসদে ছিল না, আমরা ধরেই নিচ্ছি যে জনগণের ভোটের নির্বাচিত হয়ে সরকার জনগণের পক্ষে কাজ করে না। যে কারণে বিরোধী দলকে সংসদের ভেতরে ও বাইরে থাকতে হয় সরব। কিন্তু কার্যত বিরোধী দল হিসেবে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জনগণের পক্ষে না থেকে মূলত যোগ দিয়েছে দেশের শত্রুদের সঙ্গে। যারা একাত্তরে গণহত্যায় অংশ নিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে, যারা রাজাকার, আল-বদর তাদের রক্ষায় বিএনপি দেশে-বিদেশে শক্তি ক্ষয় করেছে। অথচ বিজয়ী দলটি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই ক্ষমতায় এসেছে এবং সেই ম্যান্ডেটে জনগণ স্পষ্ট ভাষায় তাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার করার নির্দেশ দিয়েছে। বিএনপি জনগণের এই নির্দেশটি কেবল অমান্য করেছে তাই-ই নয়, জামায়াতের সঙ্গে মিলে দেশকে একেবারে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছিল সেই সময় দলটি।

দলটির নেতাকর্মীদের মিথ্যাচার এমন একপর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল যে, টকশো হোস্টদের বেগ পেতে হতো তাদের মিথ্যাচার মোকাবিলায় কিছু বলতে। আর হুমকি-ধমকি তো ছিলই। তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করা গেলেই বুঝি ক্ষমতা তাদের সামনে এসে ধরা দেবে। কিন্তু এদেশের জনগণ তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর পক্ষে তারা নেই।

ইতিহাসের আরেকটি বড় ভুল বিএনপি করলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা হলো নির্বাচনে অংশ না নেওয়া এবং নির্বাচনকে সহিংসতা দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা কিন্তু এক কথা নয়। নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা জনগণের বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকদের প্রতি সম্মান দেখানো হিসেবে ধরে নেওয়া গেলেও নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে দেশ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা কেবল বিঘ্নিত করাই নয়, পুরো দেশকে দেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলাটা অন্য যেকোনও দেশের রাজনীতির জন্যই আত্মঘাতী হতে পারতো। কিন্তু কেবলমাত্র বাংলাদেশ বলেই বিএনপি এখন পর্যন্ত রাজনীতি করে যাচ্ছে, না হলে দলটির রাজনীতির ইতি ঘটতো তখনই। তবে জনগণ কিন্তু বিএনপিকে একথা জোর দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে যে ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তারা বিএনপি’র পাশে থাকবে না, কারণ, বিএনপি’র সরকার-বিরোধী আন্দোলন কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, জনগণের জন্য নয়। সত্যিই গত এগারো বছরে জনগণের পক্ষে যায়, জনগণের জন্য কল্যাণকর এমন কোনও আন্দালন বা দাবি নিয়ে কি বিএনপি মাঠে নেমেছে? নামেনি। অথচ আমরা দেখতে পাই যে কখনও বিএনপি নেত্রীর ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির জন্য, কখনও তারেক জিয়ার জন্য, কখনও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য ছাড়া জনগণের পক্ষে বিএনপি কথা বলে না। গত এগারো বছরে জনগণ কত কী হারিয়েছে, কতভাবেই জনজীবনের ওপর সরকারের চাপ এসে পড়েছে, কতভাবেই না জনগণ বঞ্চিত হয়েছে ন্যায্যতা থেকে, কিন্তু কোথায় বিএনপি? বিএনপি ব্যস্ত থেকেছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কীভাবে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায় সেটার জন্য আন্দোলন করে, রাজনীতি করে, টকশো করে। প্রথমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য গো ধরে, যা তারা নিজেরাই একেবারে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিলেন বিচারপতি কে এম হাসানের বয়স বাড়ানো এবং ইয়াজ উদ্দিনকে একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে। এরপর কোনো সুস্থ রাজনৈতিক দল কি আর ভুলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চাইবে? নাকি যাওয়া উচিত?

কিন্তু বিএনপি সে আন্দোলনেও ব্যর্থ হয়। কারণ, সাধারণ মানুষ মনে করে বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে যোগ দিলে তারা কী পাবে? ধরা গেলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি আবার ক্ষমতায় গেলো, তাতে জনগণের লাভটা কী হবে? এখন পর্যন্ত বিএনপি কি এ ব্যাপারে জনগণকে কিছুই জানিয়েছে? জানায়নি। এখনও জানা যায়নি যে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নতুন করে কোনও হাওয়া ভবন গড়ে উঠবে কিনা? এখনও জনগণ নিশ্চিত নয় যে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় গেলে এদেশে এতিমদের জন্য গঠিত প্রধানমন্ত্রীর তহবিলটি নতুন করে তসরুপ হবে না। তার চেয়েও বড় কথা হলো, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারেক জিয়ার মতো চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে আসলে দলটি কোথায় কীভাবে রাখবে? যদিও বেগম জিয়ার কারাদণ্ড হওয়ার আগেই বিএনপি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। তারা আইনের চোখে পলাতক কিন্তু লন্ডনে অবস্থানরত তারেক জিয়াকে দলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, ফলে জনগণ একথা মানতেই পারছে না যে বিএনপি আসলে ক্ষমতায় গেলে কোনভাবে বদলাবে। ২০০১ সালে যে বিএনপি’কে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে জনগণ ক্ষমতায় এনেছিল, ক্ষমতায় বসেই তাদের যে হিংস্র রূপ জনগণ দেখেছে তা থেকে বিএনপি’র একচুলও বদল ঘটেছে বলে কোনও প্রমাণ নেই এখনও।

এখনও নেই জনগণের সামনে দলটির আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনও প্রোগ্রাম। এমনকি ভিশন ২০৩০ বলে যে প্রোগ্রাম বিএনপি নেত্রী জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন তার বেশিরভাগই ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হয়েছে বা হওয়ার পথে এগুচ্ছে। এমতাবস্থায়, যখন বিএনপি নেতৃবৃন্দ বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন তাতে কোনও অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার বিএনপিকে বহুবিধ চাপে রেখেছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু একথাও তো সত্য যে প্রকৃত রাজনৈতিক দলের পরীক্ষা তখনই সম্পন্ন হয় যখন সরকারের প্রবল চাপের মুখে থেকেও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক দলটি প্রকৃত গণআন্দোলন জমিয়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশে এখন গণআন্দোলনের জন্য ইস্যুর কোনও অভাব নেই। শেষ সময়ে এসে সরকারের ভুলেরও অন্ত নেই। কিন্তু সেসব ভুল বা জনবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলার যে কেউ নেই তা এখন কেবল স্পষ্টই নয়, জনগণ সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি থেকে বাঁচানোর জন্য আগুন সন্ত্রাসের আন্দোলন করে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে বিএনপি রাস্তার আন্দোলনে এখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তাই এখন তারা বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলনটিও ঠিকমতো করতে পারছে না। এমতাবস্থায় সামনের দিনগুলোতে বিএনপি’র রাজনীতির অনিশ্চয়তা তাদের সমর্থকগোষ্ঠীর সামনেই চরমভাবে স্পষ্ট। ভাসমান ভোটারদের পক্ষেও আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপি নিজেদের প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ। তাহলে মানুষ কেন বেগম জিয়ার কারামুক্তি নিয়ে আন্দোলনে নামবে বলুন? সবচেয়ে বড় কথা হলো, বেগম জিয়া কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাগজে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কোটা না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন বারাক ওবামা প্রশাসনকে। জনবিরোধী রাজনীতির এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এখন বলুন, গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করা কোনও ফুলি কিংবা ফুলি’র মায়ের জন্য বেগম জিয়ার কারামুক্তি কী কাজে আসবে? দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে নিজেকে এ প্রশ্ন করে কোনও সদুত্তর পান কি?

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ