X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি এখন কী করবে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০১ মার্চ ২০১৮, ১৩:৪৫আপডেট : ০১ মার্চ ২০১৮, ১৩:৪৭

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আগামী ডিসেম্বরে একাদশ সংসদের সাধারণ নির্বাচন। দেশে এখন প্রধান দল তিনটি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। তিন দলেরই সামর্থ্য আছে তিনশত আসনে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করার। আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি নির্বাচনের প্রচারণা কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি এখনও নির্বাচনি প্রচারণায় আসেনি। তারা তাদের দলীয় চেয়ারম্যান এবং ভাইস-চেয়ারম্যানের মামলা নিয়ে ব্যস্ত।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ ৮/৯ বছর পর জিয়া অরফানেজ মামলার রায় হয়েছে। রায়ে বেগম জিয়ার ৫ বছরের সাজা হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়াসহ অন্যান্য আসামির ১০ বছরের জেল ও অর্থদণ্ডও হয়েছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়ার আপিল শুনানির জন্য বিচারপতি এনায়েতুর রহিম আর বিচারপতি শহিদুল করিমের বেঞ্চে গৃহীত হয়েছে। ২২ তারিখ হাইকোর্ট তার জরিমানা স্থগিত করেছেন। জামিনের আবেদনে দণ্ড স্থগিত করার আবেদনও আসামি পক্ষের উকিলেরা করেছিলেন। কিন্তু বিচারপতি এনায়েতুর রহিম বলেছেন, দণ্ড স্থগিত করার কোনও বিধান নেই। আসামি পক্ষের উকিলেরা বলেছেন তারা তা গতানুগতিকভাবে উল্লেখ করেছেন।

২৫ ফেব্রুয়ারিও মামলার তারিখ ছিল। জামিনের শুনানি হলেও কল করা নথি বিচারিক আদালত থেকে আসার পর জামিনের শুনানির আদেশ প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারিই বিচারপতি এনায়েতুর রহিম বিচারিক আদালতকে ১৫ দিনের মধ্যে নথি প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল অবশ্য ২২ তারিখই বলেছিলেন মূল নথি ছাড়া জামিনের শুনানি সম্ভব নয়।

এ মামলাটা বিচারিক আদালতে গত ৯/১০ বছর চলেছে। আসামির উকিলেরা ২৬ বার এই মামলা নিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। নথিতে হাইকোর্টের ২৬টা নির্দেশনা রয়েছে। শুরুতেই তারা মামলার যৌক্তিকথা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং মামলা বাতিলের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্ট তাদের আবেদন নাকচ করে বিচারিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিন তিনবার তারা বিচারকের প্রতি অনাস্থা দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত চতুর্থবার হাইকোর্ট কোনও বিচারক বদলাতে আর সম্মত হননি।

ট্রায়াল কোর্টে বিচার নিষ্পত্তির আগেই এ বিচারটা সম্পর্কে হাইকোর্টের বহু মতামত লিপিবদ্ধ আছে। নথি পর্যালোচনা ছাড়া জামিন নিষ্পত্তিতে হাইকোর্ট সম্ভবত তাই সম্মত হননি। সুতরাং বেগম জিয়ার জামিন নিষ্পত্তি মার্চের ১০/১২ তারিখের পূর্বে হবে বলে মনে হয় না। শুনেছি আরো ৩/৪টা গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। জিয়া অরফানেজ মামলায় মাননীয় হাইকোর্ট জামিন প্রদান করলেও নতুন গ্রেফতারি পরোয়ানা পুনরায় গ্রেফতার হতে পারেন। অবশ্য জিয়া অরফানেজ মামলায় জামিন হবে তার নিশ্চয়তাও জোরালোভাবে দেওয়া যায় না।

জিয়াউর রহমান সাহেব যখন রাষ্ট্রপতি তখন খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি থাকার সময় বঙ্গভবন থেকে কাপ পিরিচ চুরি করেছেন অভিযোগ এনে মামলা দিয়েছিলেন। সেই মামলা হয়েছিলো বিশেষ আদালতে। মোশতাককে আদালত বঙ্গভবনের কাপ পিরিচি চুরির অপরাধে তিন বছর জেল আর এক লাখ টাকা জরিমানা করেছিলো। তিন বছরের মাঝে তার জামিন হতে দেখিনি। এক লাখ টাকা জরিমানা প্রদানের জন্য তার দলকে চাঁদা তুলতে দেখেছিলাম।

আজ কয়েকদিন ধরে ‘খালেদা প্রেমিক’ কলামিস্টদের আফসোস দেখছি তাদের লেখায়। তাদের অনুরোধ করবো খালেদা জিয়ার ২ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা দেখে আফসোস হলে তারা যেন মোশতাকের কাপ পিরিচ চুরির মামলা দেখেন। তারা অনেকে বলতে চেয়েছেন দুই কোটি টাকা কি একটা টাকা? গণনায় না মিললে ধরে নিতে হবে কাপ পিরিচ ভেঙে গেছে সেজন্য কি মামলা করতে হয়। অপমানে হতে হবে সবার সমান। প্রতিটি ক্রিয়ারই উল্টো প্রতিক্রিয়া আছে। অলি আহাদকে বিআরটিসি বাসের জগ চুরির মামলা দিয়েছিলো।

আমি পূর্বে আমার এক লেখায় বলেছিলাম, বিএনপির সামনে ঘোর দুর্দিন। তাদের চেয়ারম্যানের ৫ বছর জেল হয়েছে আর ভাইস চেয়ারম্যানের ১৭ বছর জেল হয়েছে। জরিমানা হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান দেশ ছাড়া গত ৯ বছর। এখন নেতৃত্বে কেউ নেই। ড. মোশাররফ সম্ভবত এখন মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন। তার বিরুদ্ধেও মানি লন্ডারিং মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এত শক্ত প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে হয়েছে যে জেল থেকে বাঁচা হবে দায়।

অনেকে বলেন বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তা নাকি ৫ শতাংশ বেড়েছে। বেড়েছে না কমেছে তা বুঝার উপায় নেই। কারণ, বিএনপির কয়টা কর্মী ভিন্ন ময়দানে কোনও রাজনৈতিক সচেতন মানুষ নেই। আসলে কাপ চুরি, পিরিচি চুরি, জগ জুরি, টাকা চুরির অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে মানুষ রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদের ওপর সহানুভূতি হারিয়েছে। সাধারণ মানুষ আর রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তফাৎ মুছে গেছে।

বিএনপি আন্দোলন করতে গেলে বাসে আগুন দেয়, রেললাইন উপড়ে ফেলে, পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ মারে, পুলিশ জবাই করে দেয়। এসব কারণে নিরাপত্তা বাহিনী বিএনপিকে নিয়ে খুবই সতর্ক। ২০১৩ সালের চার মাসের আন্দোলনে ৩১৯ জন মানুষ মেরেছে আর ২০১৫ সালের প্রথম ৯৩ দিনের আন্দোলনে ১৫২ জন মানুষ মেরেছে। শত শত মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। সেই দুই আন্দোলনে বিএনপির নিষ্ঠুরতার সীমা ছিল না। এখন বিএনপির মিছিল দেখলে সে নিষ্ঠুরতার কথা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। সত্যকে গুলিয়ে ফেলে নিজেকে নিষ্পাপ মনে করলে তো হবে না। যার থেকে অগ্নিবোমা খেয়ে দগ্ধ হলাম, যার দা কুড়ালের কোপে বিদীর্ণ-হলাম তার জন্য মাঠে নামবো কেন?

তারাও দশ বছর ক্ষমতায় ছিল। দেশে তো দুধের নহর তখন বয়ে যায়নি। যা কিছু হয়েছে সবই তাদের জন্য। তারা সবাই ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের লোক, বর্তমানে তাদের উচ্চবিত্তের পরিমাপ করা মুশকিল।

বিএনপি রায়ের আগে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের ডেকে কথা বলেছিলেন। বিদেশিরা বিচারালয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা কী বলেছেন জানি না। তবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা বিএনপির এক ঐতিহাসিক বদ অভ্যাস। তাদের সঙ্গে কোনও পর্যায়ে আলোচনা করাও মুশকিল। কারণ, তারা প্লেনে ওঠার আগে পাইলটের সার্টিফিকেট চেয়ে বসে থাকে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি জানে না। যাক।

একথা বলা যায় যে বিএনপি যত কথাই বলুক, এখন তারা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। শুনেছি ভারতের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য দিল্লিতে লোক বসে আছে। আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধু দিল্লিতে গিয়েছিলেন। তাকে নাকি অফিসারেরা বলেছেন, বিএনপি তো ভারত যা চায় তা দিতে প্রস্তুত। অথচ শেখ হাসিনা যখন উলফা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় তখন বেগম জিয়া বলেছিলেন তারা তো স্বাধীনতা সংগ্রামী। শেখ হাসিনা সাত রাজ্যে যাওয়ার জন্য যাতায়াতের সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল তা দিয়েছেন। উলফা তৎপরতা বন্ধের প্রয়োজন ছিল, প্রতিবেশী হিসাবে তা করেছেন। অস্ত্র-সরবরাহের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর অতিরিক্ত আর কিছু করাতো সম্ভব নয়।

জেনারেল রাওয়াতের কথায় বুঝা যায় ভারত আরো পেতে চায়। চীনের থেকে দুটা সাবমেরিন কেনাতে ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ। ভারত প্রতিবেশীদের সঙ্গে কঠোর ব্যবহার করলে তো চলবে না। সব প্রতিবেশীই তো ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অদৃষ্টের হাতে সোপর্দ করে কোনও দেশ তো তার নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে বসে থাকতে পারে না।

ডিসেম্বরে নির্বাচন। আমার মনে হয় সব দলেরই উচিত বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি আর জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। বিএনপির জন্য মুশকিল আসান হলো আপাতত নির্বাচন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ