X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়ঙ্কর কৈশোর: উদাসীন পরিবার

তুষার আবদুল্লাহ
০৩ মার্চ ২০১৮, ১৬:৪৮আপডেট : ০৩ মার্চ ২০১৮, ১৬:৫০

তুষার আবদুল্লাহ আজকাল সব সময়েই ভীত থাকি। শহরে-গ্রামে, যে পথেই চলি। চলাফেরাতে সমীহ ভাব নিয়ে এসেছি। কেউ যেন আমার হাঁটা, তাকানো দেখে ক্ষুব্ধ না হোন। কারও দিকে তাকানোর সময়েও বুক কাঁপে তিনি কিছু মনে করলেন না তো। মনে করলেই সর্বনাশ। ঝাঁপিয়ে পড়বেন, শুধু আমার ওপরই নয়, আশপাশের অনেকেই সেই তাণ্ডবে উড়ে যেতে পারেন। আমার এই ভয়, আতঙ্ক নষ্ট শহরের, দূষিত গ্রামের কিশোরদের নিয়ে। তরুণদের বলছি না এই জন্য যে আমরা তরুণদের বখাটেপনায় বা সরাসরি বললে বলা যায় মাস্তানিতে অভ্যস্তই আছি।
রাজনৈতিক প্রভাব, সামাজিক দাপট, ব্যবসায়িক পৃষ্ঠপোষকতায় তারা বেপোরায়া ছিল, আছে। তাদের সামলে চলতেও আমরা শিখে নিয়েছি। কিন্তু যে কিশোরকে মায়ের আচঁল ধরে, বাবার হাত ধরে সেদিনও স্কুলে যেতে দেখলাম, বাড়ি ফিরতে দেখেছি খেলনা হাতে, সেই এখন আমার, আমাদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্লাস সেভেনে পড়া স্কুলছাত্রেরও মহল্লাতে, স্কুলে গ্যাং আছে। হয় সে কোনও গ্যাংয়ের সদস্য অথবা দলনেতা। দশম শ্রেণিতে উঠতে উঠতে এই কিশোরই হয়ে উঠছে মহল্লা কিংবা মহল্লার গণ্ডি পেরিয়ে কোনও শহরের বড় আতঙ্কের নাম।

ওরা কেন গ্যাং তৈরি করছে? প্রথমত দূরদর্শন বা টেলিভিশন দেখে তারা অ্যাডভেঞ্জার করতে গিয়ে এমন একটা গ্রুপ তৈরি করছে, যারা স্কুলে সহপাঠীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করবে। নিয়ন্ত্রণ করবে সহপাঠীদের। খুব সরলভাবে তারা ভাবতে থাকে স্কুলের যেকোনও অনুষ্ঠানেই তাদের গ্রুপটির প্রাধান্য থাকবে। এই প্রভাব বিস্তার করা আয়ত্তে চলে এলেই- একসময় তারা খেয়াল করে দেখে কোনও সহপাঠিনীকে বা স্কুলের কোনও ছাত্রীকে প্রতিপক্ষ গ্রুপের বা গ্রুপের বাইরের কেউ পছন্দ করছে বা তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। এই হওয়াটিকে কিশোর গ্যাং মেনে নিতে পারে না। গ্যাংয়ের কোনও সদস্য বা দলনেতা তখন ওই ছাত্রীকে জয় করতে চায়। ছিনিয়ে নেওয়া মানেই তাদের কাছে জয়। ছিনিয়ে নিতে গিয়েই প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাত। স্কুলে, স্কুলের বাইরে সেই সংঘাত ঘটাতে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে একের পর এক। স্কুল ছাড়াও মহল্লা, আবাসিক এলাকা, অ্যাপার্টমেন্টেও এক কিশোরের হাতে অপর কিশোর হত্যার মূল কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রেমের সম্পর্ক। স্কুল পেরোনোর আগেই নাকি তাদের প্রেম ও সম্পর্কের সংখ্যা শুনলে চমকে যেতে হয়। দশ-বারোটি সম্পর্ক গড়া-ভাঙা এখন ওই বয়সীদের কাছে সহজ হিসাব।

এই সহজ হিসেবের টানাপোড়নের মাঝেই কিশোরদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে যাচ্ছে মাদক, অস্ত্র ব্যবসার গোষ্ঠীদের সঙ্গে। ছোট্ট পরিসরের গ্যাং থেকে তারা বড় গ্যাংয়ের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। এতে অপরাধ ঘটানোর দুঃসাহস আরও তীব্র রূপ নেয়। এই তীব্রতাকে আশ্রয় দেয় রাজনৈতিক যোগাযোগ। ফলে এলাকার মুরব্বি গোত্রের মানুষেরাও কিশোর গ্যাংকে সমীহ বা খাতির করে চলার অভ্যাস শুরু করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে থাকলেও, ইচ্ছে করলেই এই কিশোর গ্যাংদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বা অভিযান চালাতে পারেন না। কারণ, এই গ্যাংয়ে যেমন বিত্তহীন পরিবারের সন্তানেরা আছে, তেমনি আছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কর্তা এবং বিত্তশালীর সন্তান। ফলে এই কিশোররা স্পর্শকাতর। তাদের স্পর্শ করলেই প্রশাসন নড়ে ওঠে। কিশোরদের আটক করার দুঃসাহসও দেখাতে পারে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে একাধিকবার এই প্রকৃতির কিশোরদের আটক করা হয়েছে। পরে তাদের অভিভাবকদের ডেকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে সেই কিশোররা আবারও ফিরে আসে অপরাধ চক্রে।

কিশোর বলতে শুধু ছেলেরাই যে অপরাধে জড়াচ্ছে তা নয়। সঙ্গে আছে কিশোরীরাও। অর্থাৎ আমাদের আদরের মেয়েটিও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজর রাখলেই বোঝা যাবে বিভিন্ন গ্রুপ ও গ্যাংয়ে আমাদের মেয়েরাও কতটা সক্রিয়। আমাদের মেয়েরা সহপাঠী বা বন্ধুকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে খুনির হাতে তুলে দিচ্ছে, এই প্রমাণও মিলছে। সহপাঠী, বন্ধুকে কত নির্মমভাবে নির্যাতন করা যায়, হত্যা করা যায় তার প্রমাণ তো আমাদের ছেলেরা ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল করেই দেখিয়ে দিয়েছে। স্কুলপড়ুয়া আমাদের ছেলেমেয়েরা ধূমপান, মাদক ও অসুস্থ যৌনতার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে। বলা যায় অপরাধের অন্ধকার গহবরই তারা হারিয়ে যাচ্ছে। নিখোঁজ সেই কিশোর-কিশোরীদের ফিরে আসার সংবাদ বিরল।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমার সন্তানকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে আনবে, আমি এই ব্যবস্থাপত্রে বিশ্বাসী নই। কারণ, আমার সন্তান অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছে আমার নীরব সম্মতি, উন্নাসিকতা বা অবহেলার জন্যই। আমার সন্তান কোথায়, কখন কীভাবে সময় কাটাচ্ছে, তার বন্ধু কারা, কী পোশাক পরছে, চুল ও অন্যান্য সাজসজ্জায় কেমন পরিবর্তন আসছে? এই সামান্য প্রশ্ন ও নজর না রাখতে পারার জন্যই আমাদের সন্তানরা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তারা শুধু পরিবারের জন্যই নয়, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্যও হয়ে উঠছে আতঙ্কের কারণ। আমাদের সন্তানদের কৈশোর সুন্দর করার জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি পালন করতে হবে পরিবার নামক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটির। দুঃখজনক হলেও সত্যি এই প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, গড়ন এবং সক্ষমতাই এখন প্রশ্নের মুখে। সন্তানদের সুন্দর আগামীর কথা ভেবে ‘পরিবার’-এর শক্তিময়তা বাড়াতে হবেই। একই সঙ্গে পাড়া, মহল্লার বিলুপ্ত প্রায় অভিভাবক মনস্ক সংস্কৃতির চর্চা আবার শুরু করা প্রয়োজন। সময়ের প্রয়োজনেই।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘অ্যাকটিভ অর্গানাইজেশন অ্যাওয়ার্ড’ পেলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
‘অ্যাকটিভ অর্গানাইজেশন অ্যাওয়ার্ড’ পেলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
সনদ বাণিজ্য: কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে
সনদ বাণিজ্য: কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে
পদ্মায় গোসল করতে নেমে ৩ মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যু
পদ্মায় গোসল করতে নেমে ৩ মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যু
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ