X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিরোধী দলের ‘আকুতি’

আমীন আল রশীদ
০৫ মার্চ ২০১৮, ১৫:৫২আপডেট : ০৫ মার্চ ২০১৮, ১৫:৫৫

আমীন আল রশীদ সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় যে আত্মসমালোচনা করেছেন, যে গ্লানিবোধের কথা বলেছেন, সেটিকে দশম সংসদের ‘সেরা আকুতি’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
তিনি গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেছেন, জাপার এমপিরা বিরোধী দল হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পান। কারণ, তারা সরকারি দল না বিরোধী দল–সাংবাদিকরা তা জানতে চান।
রওশন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, আমাদের মন্ত্রীদের উইথড্রো (প্রত্যাহার) করে নেন। আপনি সেটা করেননি। আমরা বিরোধী দল হতে পারিনি। এভাবে বিরোধী দল হওয়া যায়?’ বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে জাতীয় পার্টির সব সংসদ সদস্যকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে নেওয়ারও আহ্বান জানান রওশন এরশাদ।

বিরোধী নেতার এই বক্তব্যের পরে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবে সবশেষ বক্তা হিসেবে আলোচনায় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি সংসদে অত্যন্ত গঠনমূলক আলোচনা করছে, গঠনমূলক সমালোচনা করছে’। তিনি বলেন, ‘একটা সময় এদেশে আমি দেখেছি পার্লামেন্টে বিরোধী দলে যারা ছিল, বিশেষ করে বিএনপি যখন ছিল; তখন এই পার্লামেন্টে যে সমস্ত অশালীন কথা বলা হতো, তা ভাষায় উচ্চারণ করা যায় না। যে আচার আচরণ করতো, কোনও গঠনমূলক আলোচনা করতো না। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে বর্তমানে আমাদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এখানে গঠনমূলক দায়িত্ব পালন করছে।’

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে জাতীয় পার্টি একইসঙ্গে মন্ত্রিসভায় এবং বিরোধী দলের আসনে বসায় নানা মহলেই সমালোচনা শুরু হয়। এমনকি দলের সিনিয়র সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েই বলেছিলেন, দেশের মানুষ তাদের সত্যিকারের বিরোধী দল মনে করে না। তাই তিনি মনে করেন, জাতীয় পার্টির সদস্যদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়া উচিত হয়নি।

২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল দশম জাতীয় সংসদে প্রথম বিলটি পাস হতে সময় লাগে মাত্র তিন মিনিট। বহুল আলোচিত এই বিল পাসের সময়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যদের কোনও ভূমিকা ছিলো না। তারা ‘হ্যাঁ-না’  কোনও পক্ষেই ভূমিকা রাখেননি। বিলের ওপর আলোচনার সুযোগ থাকলেও তারা সেই সুযোগ নেননি। স্বতন্ত্র সদস্য ডা. রুস্তুম আলী ফরাজী বিলটির ওপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব জমা দিলেও তিনি সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে এই প্রস্তাবও উত্থাপিত হয়নি। অর্থাৎ কোনও ধরনের আলোচনা ছাড়াই বিলটি পাস হয়।

বিচারপতিদের অপসারণ সম্পর্কিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ (সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল যেটি অবৈধ ঘোষণা করার জেরে প্রথমে ছুটিতে এবং পরে অবসরে যেতে হয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে) বিল পাসের প্রক্রিয়ায়ও বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা ছিল সংশয়পূর্ণ। নিয়ম অনুযায়ী তারা বিলটি জনমত যাচাই এবং কয়েকটি জায়গায় সংশোধনী দিলেও, যথারীতি সেগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। আবার এই বিলের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ অন্য সংসদ সদস্যরা বলেছেন, তারা এই বিলটির পক্ষে। কারণ, তারা মনে করেন বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপরেই ন্যস্ত থাকা উচিত।

গত চার বছরে সংসদে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে­­–

১. এই সময়ের মধ্যে তারা সরকারের অংশ হিসেবেই কাজ করছে।

২. প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হলেও দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের কথাবার্তা বরাবরই বিরোধী নেতাসুলভ।

৩. জাতীয় পার্টির একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার সমালোচনা যে কেবল রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাই করেছেন, তা-ই নয়; বরং মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা নিয়ে জাতীয় পার্টির ভেতরেই প্রকাশ্য দ্বিমত ছিল।

৪. জাতীয় পার্টির একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার সমালোচনা সংসদের ভেতরেও করেছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ এবং সবশেষ খোদ বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ।

৫. একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার সমালোচনা করে তোপের মুখে পড়েছিলেন জাতীয় পার্টির  কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছিল।

৬. দলের ভেতরে এরশাদ ও রওশন এরশাদ­­­–এ দুটি ভাগে দল ভাগ হয়ে যায়। যদিও সংবাদ সম্মেলনে রওশন দাবি করেন, এরশাদের সঙ্গে তার কোনও বিরোধ নেই।

৭. এরশাদের নির্দেশ মেনে জাতীয় পার্টির যেসব সদস্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেননি, তারা নির্বাচনের পরে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হন।

৮. জাতীয় পার্টির তিনজনকে মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী করা হলেও জাতীয় সংসদের কোনও স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ। অবশেষে ৯ মাসের মাথায় একটি কমিটির সভাপতির পদ দেওয়া হয় তাকে।

৯. দশম সংসদের প্রথম বছরে অনুষ্ঠিত সংসদের চারটি অধিবেশনে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি দুবার ওয়াকআউট করেছে। প্রথম তারা ওয়াকআউট করে ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়লেও সরকার রাজস্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে­­­–এমন অভিযোগে জাতীয় পার্টি ১০ মিনিটের জন্য ওয়াকআউট করে। এর ঠিক আট মাসের মাথায় ওই বছরের ২৩ নভেম্বর তারা দ্বিতীয় দফায় ওয়াকআউট করে স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় বিমানের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দীনকে অপসারণের দাবিতে। দেখা যাচ্ছে, দুটি ওয়াকআউটের তারিখই কাকতালীয়ভাবে ২৩। 

১০. বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদের ভেতরে সমসাময়িক কিছু ইস্যুতে, বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের  সমালোচনা করেছে। যদিও সেই সমালোচনার ধরন দেখে অনেকেরই মনে হয়েছে, এটা লোক দেখানো।

একইসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকা নিয়ে শুরু থেকেই জাতীয় পার্টির সমালোচনা আসে নানা মহল থেকে। তবে দলের পক্ষ থেকেও এর জবাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, দলের সিনিয়র নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুসহ দলের অন্য শীর্ষ নেতারা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব সাফাই গেয়েছেন বা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু সবশেষ বিরোধী নেতা রওশন এরশাদ যে আত্মগ্লানীর উচ্চারণ করেছেন, সেটি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। যদি এই আত্মসমালোচনাটি তিনি আসলেই বিশ্বাস করেন, তাহলে বলতে হবে এটি তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের শেষ বছর তথা নির্বাচনের বছরে এসে এরকম একটি উক্তি তিনি ভোটারদের মন জয় করতে বলেছেন নাকি সত্যিই এতদিন পরে তার দল দুই নৌকায় পা দেওয়ার অনুশোচনা করছে, তা বলা মুশকিল।

সবশেষ ২ মার্চ রংপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এইচ এম এরশাদও বলেছেন, মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির তিন মন্ত্রী এবং তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদ থেকে কিছুদিনের মধ্যেই পদত্যাগ করবেন। যদিও এই ঘোষণা তিনি আরও একাধিকবার দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির কাউকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া ঠিক হয়নি––বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের এই বক্তব্য সঠিক বলেও মন্তব্য করেন। তাই নির্বাচনের বছরে এসে মন্ত্রিসভা থেকে যদি জাতীয় পার্টির তিনজন সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ থেকে এরশাদ পদত্যাগও করেন, তারপরও এই প্রশ্নটি ভোটার এবং সাধারণ মানুষের মনে থাকবে যে, এরকম উপলব্ধির জন্য তাদের চার বছর সময় কেন লাগলো?

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বৃষ্টির প্রার্থনায় বিভিন্ন জেলায় নামাজ আদায়
বৃষ্টির প্রার্থনায় বিভিন্ন জেলায় নামাজ আদায়
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ওয়ান্ডারার্স 
রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ওয়ান্ডারার্স 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ