X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা ও তরুণ সমাজের দায়িত্ব

স্বদেশ রায়
০৬ মার্চ ২০১৮, ১৪:৫২আপডেট : ০৬ মার্চ ২০১৮, ১৪:৫৪

স্বদেশ রায় ড. জাফর ইকবালকে যেভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে– এ ধরনের হামলার চরিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশে কম-বেশি সবাই পরিচিত। এই হত্যাকারীদের উৎপত্তিস্থল, তাদের বেড়ে ওঠা, তাদের মনোজাগতিক এ পরিবর্তন সমাজে কারা আনছে তাও দেশবাসীর জানা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে যেসব সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে বাংলাদেশে একসময়ে জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন নামে ১২১টি মতো জঙ্গি সংগঠন তৈরি করেছিলো। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের সহায়তায় এখানে  পাকিস্তানের জঈশে মোহাম্মদ, আলকায়েদা প্রভৃতি জঙ্গি সংগঠনের শাখা খোলা হয়েছিলো। এই সংখ্যাটি বেশি বেড়েছিলো যে সময়ে, জামায়াত-বিএনপি ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি ক্ষমতায় ছিল তখন।
এই সকল জঙ্গি সংগঠন মূলত জামায়াতে ইসলামীর আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন। এদের মাধ্যমে তারা ১৯৭১ সালে যে কাজটি করেছিল সেই একই কাজ নিয়মিত করে চলছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দেওয়া। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী যখনই বিএনপির সঙ্গে প্রকাশ্যে তাদের জোটটি গড়ে তুলতে পেরেছে তখন তারা এ কাজে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে প্রকাশ্যে জোট গড়ার ভেতর দিয়ে জামায়াত মূলত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭১ সালের পরে যে ঘৃণ্য অবস্থানে ছিল সেখান থেকে এক ডিগ্রি হলেও ওপরে উঠতে পেরেছে। বুঝে বা না বুঝে, বা নানান স্বার্থে একসময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এমন অনেকে এখন বিএনপি করেন। তারা এখন আর জামায়াতকে ঘৃণা করেন না। এরা যদি সমাজের বা রাষ্ট্রের ২ ভাগ লোকও হন- তাহলেও তো দুইভাগ ভদ্রলোক এখন জামায়াতে ইসলামীকে ভালো বলছে। এবং পক্ষান্তরে তারা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সমর্থন করছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর যে কোনও অপকর্মের সমর্থন করছে বাংলাদেশের অন্যতম একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীর অপকর্ম সমর্থন করার অর্থই দাঁড়াচ্ছে জঙ্গি কাজকে সমর্থন করা। এ সমর্থনের ভেতর দিয়ে বিএনপি নিজেও জঙ্গি দলে পরিণত হয়েছে। তারেক রহমান যখন বলেছেন, শিবির ও ছাত্রদল একই মায়ের সন্তান, তখন তাদের সেই মা খালেদা জিয়াই। বাস্তবে সে মা তখন জঙ্গির মা। তখন কেউ যদি রাজপথে স্লোগান দেয় ‘জঙ্গির মা খালেদা’ তা নিয়ে আপত্তির কোনও সুযোগ নেই। তিনি যে জঙ্গির মা তা দেখা গেছে, যে সময়ে গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয়বাংলা’কে বুকে ধারণ করে রাজপথে অবস্থান নিয়েছিলো তখনও- ওই সময়ে তিনি তাদের বিপথগামী, নাস্তিক প্রভৃতি অভিধায় চিহ্নিত করেছিলেন। শুধু এখানেই শেষ নয়, সমস্ত যুদ্ধাপরাধীকে রক্ষায় (যারা অধিকাংশ জামায়াত নেতা) বেগম জিয়া দেশ ধ্বংসের সব ধরনের কর্মসূচি নিয়েছেন। এমনকি জেলে যাওয়ার আগে তার দলের যে ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় সেখানেও পাকিস্তানপুষ্ট জঙ্গি এবং ৭১’র যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্যে শোক প্রস্তাব নেওয়া হয়। এছাড়া গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিজীবী ইঞ্জিনিয়ার রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হলে বেগম জিয়া ‘টুঁ’ শব্দটি করেননি। বরং তার দলীয় সমর্থক পত্রিকা আমার দেশের ভূমিকা, হেফাজতের মাধ্যমে ঢাকায় মানুষ হত্যায় প্রকাশ্য সমর্থন করা, এমনি সব ঘটনা প্রবাহ বলে দেয়, বিএনপি এখন এদেশে জঙ্গির আশ্রয়দাতা বটবৃক্ষ।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে চৌদ্দ দলীয় জোট এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় তারা জামায়াত-বিএনপি ও জঙ্গির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তারা এক কৌশলী খেলা খেলছে। বিএনপির ডাকে যে হেফাজত মাঠে নেমেছিলো, যারা ঢাকাতে ধ্বংসলীলা চালানো ছাড়াও এক ভয়াবহ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিলো, তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ এক ধরনের আপস করেছে। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখার জন্যে ও পাশাপাশি জঙ্গিদের মূল শক্তি বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে লড়াই করার লক্ষ্যেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এই কৌশল নিয়েছে বলে বোঝা যায়। হেফাজত যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে শতভাগ আছে তা  আওয়ামী লীগ হয়তো বিশ্বাস করতে পারে, তবে বাস্তবতা তা বলে না। যেমন বেগম জিয়া জেলে যাওয়ার পরে মাহমুদুর রহমানের বাসায় ও অন্য একটি বাসায় হেফাজতের কয়েকজন নেতার সঙ্গে মাহমুদুর রহমান ও অন্য কয়েকজন বিএনপি-জামায়াত নেতার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। মাহমুদুর রহমান দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজত ও জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি সাড়া পাচ্ছেন এমন সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে।  কারণ, তাদের ওপর তার একটা প্রভাব আছে। তবে এরপরেও আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে যেভাবে চলছে তার থেকে খুব বেশি সরে আসতে পারবে বলে বাস্তবতা বলে না।

আওয়ামী লীগ সরে আসতে পারলো কী পারলো না সেটা এখন বড় কথা নয়। কারণ, আওয়ামী লীগ পাওয়ার গেমের রাজনীতি থেকে সরে এসে কমিউনিস্ট পার্টি হলে দেশেরও কোনও লাভ হবে না। আর সেই কমিউনিস্ট পার্টি মার্কা আওয়ামী লীগ মৌলবাদকেও ঠেকাতে পারবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ প্রশাসন দিয়ে মৌলবাদকে ঠেকাচ্ছে, জঙ্গি হত্যা করছে, জঙ্গি ধরে সাজা দিচ্ছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ আর খুব বেশি কিছু দিতে পারবে না এ মুহূর্তে। কারণ, দেশের সামাজিক বাস্তবতায় পাওয়ার গেমের এই ধরনের বড় রাজনৈতিক দলের এ সীমাবদ্ধতা এখন একটি রূঢ় বাস্তবতা। এমনকি এই সীমাবদ্ধতা পাওয়ার গেমের রাজনীতির চিরকালীন নিয়তি। যেমন ব্রিটিশ আমলে কংগ্রেস স্বরাজ চাইতো। স্বাধীনতা চাইতো না। আবার পাকিস্তান আমলে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে। অন্যদিকে ব্রিটিশ আমলে কংগ্রেস সারা ভারতের তরুণদের একটা ছায়া দিয়েছিলো, তাদের জন্যে একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো যে তারা স্বাধীনতার কথা বলুক। আর তরুণরা স্বাধীনতার কথা বলেছিলো বলেই কংগ্রেস স্বাধীনতা আনতে পেরেছিলো। ঠিক তেমনি পাকিস্তান আমলে ছাত্রলীগের জন্যে আওয়ামী লীগ ওই পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো যে তারা স্বাধীনতার কথা বলুক। আর সেই স্বাধীনতার কথাই শেষ অবধি আওয়ামী লীগসহ জাতির কথা হয়। রক্ত সাগর পেরিয়ে হলেও স্বাধীনতা আসে। 

বর্তমান মুহূর্তটিও তেমনি। ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা বস্তুত মুক্তবুদ্ধির ওপর হামলার একটা ধারাবাহিকতা। এখানে আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে কতটুকু করবে তা সকলেই বুঝতে পারছে। আওয়ামী লীগ হত্যাকারীদের ধরবে এবং তাদের বিচার করবে। এর বেশি আওয়ামী লীগ খুব বেশিদূর যেতে পারবে বলে মনে হয় না। তাদের পাওয়ার গেমের রাজনীতি এর বেশি তাদের যেতে দেবে না। আর যে নিশ্চয়তা আওয়ামী লীগ দিতে পারবে তা হলো তারা ক্ষমতায় থাকলে গণহত্যা হবে না। ১৯৭১-এর মতো বুদ্ধিজীবী হত্যা হবে না। বুদ্ধিজীবীদের ওপর হামলা হলে তার বিচার হবে। হত্যাকারীকে ধরার চেষ্টা দেখা যাবে। অন্যদিকে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এলে গণহত্যা হবে। বুদ্ধিজীবী হত্যা হবে। সে লিস্টও তারা তৈরি করে রেখেছে। যেসব তরুণ আজ  জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টার পরে রাস্তায় নেমেছে তারা প্রায় কেউ বাঁচতে পারবে না। কারণ, এবার জামায়াত-বিএনপি ৭১-এর থেকে বড় আকারেই গণহত্যার কাজটি করবে। কারণ, তারা এখন দেখতে পারছে ৭১ ও ৭৫-এর হত্যাকাণ্ড চালানোর পরেও তারা বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানাতে পারেনি। তাই আবার ক্ষমতায় এলে এ ভুল আর তারা করবে না। সে প্রস্তুতিও তারা নিচ্ছে।

এ সময়ে আওয়ামী লীগ যে নিশ্চয়তা বা যে পরিবেশটুকু তরুণ সমাজকে দিয়েছে তার শতভাগ কাজে লাগানো উচিত তরুণদের। তাদের এখন কাজ নয় শুধু বিচার চাওয়া। তাদের এখন কাজ হবে দলে দলে সারাদেশে বেরিয়ে পড়া। তরুণদের নেতৃত্বে দেশজুড়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এখন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সবখানে যেতে হবে তাদের। তাদের সমবয়সী বা ছোট ভাইবোনদের বোঝাতে হবে তারা যেন আধুনিক রাষ্ট্র ও আধুনিক জীবনের দিকে এগিয়ে আসে। ঠিক তেমনিভাবে চারণের বেশে প্রতিটি গ্রামে গ্রামে তাদের যেতে হবে। প্রতিটি বাবা মাকে বুঝাতে হবে তাদের সন্তান কেন আধুনিক পথে থাকবে। আর এভাবে তরুণদেরকেই তৈরি করতে হবে তাদের বসবাসযোগ্য আধুনিক বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে- এটা তাদের জন্যে অত্যন্ত সুসময়। কারণ, তারা দলবেঁধে এ কাজে নেমে পড়লে আওয়ামী লীগ বাধা দেবে না বরং সহায়তা করবে। আর জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এলে এই তরুণদের ১৯৭১-এর মতো গণহত্যার শিকার হতে হবে। তাদের সামনাসামনি হত্যা করা হবে, জাফর ইকবালের মতো পেছন দিক দিয়ে হত্যাচেষ্টা করে সময় নষ্ট করবে না তারা। তাই কবি হেলাল হাফিজ যেমন ৬৯-এ বলেছিলেন, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়। ঠিক তেমনি আবারও তরুণদের সামনে, নতুন প্রজন্মের সামনে সেই ডাক এসেছে, এখন তরুণ যে- আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে নেমে পড়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়। কেউ যেন কারও জন্যে অপেক্ষা না করে। পথে নামলেই পথ চলা হয়। আর পথে এগুলেই সংখ্যা বাড়তে থাকে, সারি দীর্ঘ হয়। দীর্ঘ সারি একসময় পথের শেষে বিজয়ের মালা নিয়ে আসে। সে বিজয়ের মালা হলো আর কোনও জাফর ইকবালের ওপর হামলা হবে না এমন বাংলাদেশ সৃষ্টি করা। আধুনিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করা। যেখানে যে যার মতো মুক্তমনে চিন্তা করবে। কেউ কারও চিন্তাকে চাপাতি দিয়ে বাধা দেবে না।

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ