X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিপাশার লাল টিপ আর ফয়সালের নীরবে হারানো

আহসান কবির
১৬ মার্চ ২০১৮, ১৬:০৬আপডেট : ১৬ মার্চ ২০১৮, ১৬:১৩

আহসান কবির যতদূরে গেলে আর ফিরে আসা যায় না
তারচেয়ে বহুদূরে মেলে দিয়ে পাখা!
সুখপাখি যায়, দূর অজানায়
তার কাছে হায় সব সুখ জমা রাখা!
ইউএস-বাংলার বিমানে থাকা ৫০ জন সুখপাখি কোথায় যেন উড়ে গেছে! এই পঞ্চাশের ছাব্বিশ সুখপাখি এই বাংলার!
আমার কাছে এই পঞ্চাশ সুখপাখির একজন আহমেদ ফয়সাল। কারো কাছে এই একজন বিমানের পাইলট আবিদ সুলতান। কারো কাছে ফার্স্ট অফিসার পৃথুলা রশীদ। কারো কাছে রিমু ভাই কিংবা তার নিষ্পাপ বাচ্চাটা! কারো কাছে এই সুখপাখি নবদম্পতি মিনহাজ বিন নাসির ও আখিঁমনি। জানি না এরা সবাই রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতাটা কখনো শুনেছিল কিনা! জানি না বিধাতা পাষাণ কেন/চারিদিকে তার বাঁধন কেন?

আনন্দের বাঁধনে মোড়া অথচ শেষযাত্রার উড়ন্ত টিকেট কিনেছিল ছাব্বিশ সুখপাখি! নেপাল ঘুরে বেড়ানোর আগন্তুক পাখি হয়ে চোখ রেখেছিল বিমানের জানালায়। পাখির চোখে বাংলাদেশটাকে দেখতে দেখতে তারা মানচিত্রের আকাশ অতিক্রম করেছিল। কেউ ছবি বা সেলফি তুলে প্রকাশ করেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আনন্দ উচ্ছ্বাসটা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল বন্ধুদের মাঝে। ছবির আনন্দ উচ্ছ্বাসটা কান্নার মাতম হয়ে বাজছে এখন, আরো কতদিন বাজবে জানি না। যে মা অনেক কষ্ট করে তার একমাত্র ছেলে রাকিবুল হাসানকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছিলেন, মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে যে ছেলেটা এরপর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছিল, স্ত্রী ইমরানা কবির হাসি (বুয়েটের শিক্ষক)-কে নিয়ে সেও উড়াল দিয়েছিল আনন্দ আকাশে, মাকে ছেড়ে সেই ছেলেটাও শেষমেষ চলে গেছে না ফেরার দেশে। হাসি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, আর নিঃস্ব হয়ে যাওয়া সেই মায়ের স্বজনরা এখন সাহস হারিয়ে ফেলেছেন, মাকে জানাতেও পারছেন না যে তার ছেলেটা  মারা গেছে! টেলিভিশনের ডিশ সংযোগ কেটে ফেলা হয়েছে, যেন মা তার ছেলের মৃত্যু সংবাদ জানতে না পারেন! জানি না কতদিন মায়ের কাছ থেকে এভাবে লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে!

সবকিছু লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। মিনহাজের মা ইলার কাছেও সংবাদটা লুকিয়ে রাখা যায়নি।  বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার নাসির উদ্দীন সারওয়ারের ছেলে মিনহাজ নাসির ও আখিঁমনির বিয়ে হয়েছিল এই বছরের (২০১৮) তিন মার্চ। হানিমুনে যাওয়ার আগে বিমানবন্দর থেকে তারা ছবি আপ করেছিল ফেসবুকে। এই দুইজন এখন ছবির মানুষ,  জানি না সুখপাখি হয়ে উড়তে উড়তে কোন আকাশের তারায় তাদের আশ্রয় হয়েছে। আলোকচিত্রী এফ এইচ প্রিয়ক তার প্রিয়তম মেয়ে তামারা প্রিয়দর্শিনীকে বের করে আনতে পারেননি আগুনের গনগনে খনি হয়ে যাওয়া বিমান থেকে। হয়তো আগুনের লেলিহান শিখা তাদের কয়লা বানিয়ে ছেড়েছে। তামারা প্রিয়দর্শিনীর মা আলমুন নাহার অ্যানি এখনও সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন, ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালে ঠাঁই হয়েছে তার। হায়, কখনো-সখনো মৃত্যু আর উড়োজাহাজ উড়ে যায় সমান্তরাল!

সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিক্যালের ১৩ জন নেপালি ছাত্রছাত্রী ছিল ইউএস বাংলার বিমানে। এর ভেতর ১১ জনই চলে গেছে না ফেরার দেশে। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল তারা বাংলাদেশে, চিকিৎসক হয়ে স্বপ্ন পূরণের আনন্দ নিয়ে ফিরছিল নিজ দেশে। মা-বাবার কোনও কান্নাতেই আর ফিরবে না তারা। ফিরবে না সরকারি চাকরিজীবী উম্মে সালমা কিংবা নাজিয়া। শিশু সামিরা জানবে না কতটা দুঃখ নিয়ে তার মা সুখপাখি হয়ে উড়ে গেছে! কোনও আয়োজনেই আর ফিরবে না রিমু, বিপাশা কিংবা তাদের সন্তান অনিরুদ্ধ। রিমু একসময়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, পরে কাজ করতেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। বিপাশা কাজ করতেন সুশাসনের জন্য নাগরিক, সুজন-এ। বিপাশা নেই কিন্তু তিনি যেখানে কাজ করতেন, সেখানটায় তার কম্পিউটারের কোনায় এখনও রয়ে গেছে তার কপাল আলো করে থাকা লাল টিপ। টিপ ছাড়া বিপাশাকে কল্পনাই করা যেত না। এখন থেকে যত মেয়ে লাল টিপ পরবে হয়তো লাল টিপের দীর্ঘশ্বাসে বিপাশার কথাই মনে পড়বে অনেকের।

মনে পড়বে পৃথুলা রশীদকে, যে কিনা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে নিয়েছিল বিমান চালনার পেশাকে! হয়তো তার মেয়েটার লালন পালন নিয়ে নানী আর দাদীর ভেতর দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। পৃথুলা রশীদকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করেছে পুরুষ নামধারী এই দেশের কিছু কুৎসিৎ মানুষ। এইসব কুৎসিৎ মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবেও।  হয়তো তাদের সংখ্যাটা বাড়বে আর সেই সমাজেই বেড়ে উঠবে তার মেয়েটা। বড় হয়ে মেয়েটা কী ভাববে এই সমাজের কেউ কেউ তার মাকে মরণকালেও একটু সহানুভূতি দেখায়নি!

রানার গ্রুপের কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান রিমন সাত দিনের কাজ শেষে ফিরেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে।  নেপাল যাওয়ার কথা শুনে তার সঙ্গে অভিমান করেন তার স্ত্রী। নেপালের নম্বর দিতে চেয়েছিলেন রিমন। অভিমান করে নম্বর নেননি তার স্ত্রী ঝর্ণা। পাসপোর্টটা ভুল করে নেননি রিমন যাত্রার শুরুতে। পাসপোর্টটা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন ঝর্ণাই। আজীবন ঝর্ণার কী এটাই মনে হবে যে পাসপোর্টটাই রিমনকে টেনে নিয়ে গেলো দূর আকাশের গাঁয়?

কেউ কী বলতে পারেন দূর আকাশের কোন নীরব গাঁয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে আহমেদ ফয়সালকে? শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় এসেছিল ছেলেটা সাংবাদিকতা করতে। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতা নিয়ে লেখাপড়া শেষ করে এসেছিল বৈশাখী টেলিভিশনে। অসম্ভব বিনয়ী ও সুদর্শন এই ছেলেটা ক্যামেরার পেছনেই কাজ করতো। একদিন তাকে নিয়ে আসা হলো ক্যামেরার সামনে, রিপোর্টিংয়ের নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল। একমাত্র শর্তে হাসিমুখে রাঙ্গিয়ে নিত সব অ্যাসাইনমেন্ট।  শর্তটা হচ্ছে দুই তিন মাস পর পর তাকে তিন চারদিনের জন্য হারিয়ে যেতে দিতে হবে! কোথায় যাচ্ছিস জিজ্ঞাসা করলেই ফয়সালের ছিল রেডিমেড উত্তর- হারিয়ে যাওয়ার একমাত্র শর্তই হচ্ছে কোথায় যাচ্ছি সেটা কাউকে না বলা! ইবনে বতুতারা কাউকে বলে না সে কোথায় ঘুরতে যাবে!

কাউকে কিছু না বলেই যাচ্ছিল সে নেপাল। হারিয়ে যাওয়ার আগে শেষ স্মৃতিটা রেখে গিয়েছিল বৈশাখীতেই। ৭১ সালের কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর আজও যারা বেঁচে আছেন তাদের কয়েকজনকে খুঁজে বের করেছিল সে। যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হাতে বুলেটবিদ্ধ হয়েছিলেন, ফয়সাল তার হাত ছুঁয়ে যেন বলতে গিয়েছিল– রক্ত দিয়ে কিনেছি স্বাধীনতা, কারো দয়ায় পাওয়া নয়! যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা পায়ে বুলেটবিদ্ধ হওয়ার কারণে বাকিটা জীবন কাটিয়েছেন হুইলচেয়ারে, ফয়সাল যেন তাকে বলতে গিয়েছিল-মানুষ কখনো সখনো টিকটিকি হলে ভালো হতো। লেজ চলে গেলে টিকটিকির লেজ গজায়। আপনাদের জন্য যদি নতুন পা পাওয়া যেত! অথবা কোনও জাদুকর যদি কোনও মন্ত্রবলে আপনাদের (আহত মুক্তিযোদ্ধাদের) ভালো করে দিতে পারতো তাহলে আপনারা আবারও দেশ গড়ার নতুন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন!

রিপোর্ট শেষ করে জমা দিয়ে ফয়সাল হাসিমুখে তার শর্ত পূরণের কথা বলে। বৈশাখী টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ তাকে পাঁচদিনের ছুটি দেয়। ফয়সাল তার রিপোর্ট আর পরিচিত হাসিটা সবার হৃদয়ে জমা রেখে কাউকে না বলেই রওনা দেয় নেপাল।  ইউএস বাংলার বিমান দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যায় প্রথম খবর হয়ে আসে ফয়সাল। জানা যায় নিহত যাত্রীর তালিকায় প্রথম নামটাই নাকি ফয়সালের! বৈশাখীর কারোরই সেটা বিশ্বাস করতে মন চায় না। তারপর পাসপোর্ট নম্বরেও মিল পাওয়া যায়। চোখের জল মুছে বৈশাখীর সবাই বলে বিশ্বাস হচ্ছে না! কেউ কেউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজনের ছবি দেখিয়ে বলে-ফয়সাল বেঁচে আছে। এই যে ছবি! বৈশাখী থেকে প্রধান প্রতিবেদক মিঠুন মোস্তাফিজকে নেপালে পাঠানো হয়। মিঠুন যোগাযোগ করে ইউএস বাংলার সাথে, বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে। ঘুরে দেখে নেপালের তিনটা হাসপাতাল, যেখানে চিকিৎসাধীন আছেন বেঁচে যাওয়া বিমান যাত্রীরা।  যে ছবিটা দেখে অনেকের ধারণা হয়েছিল বেঁচে আছে ফয়সাল, সেই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে ভুল ভাঙে মিঠুনের। সেই মানুষটা ফয়সাল না, ইয়াকুব আলি!

মিঠুনের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে। সে মর্গে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার মনে হয় এই ছাব্বিশ জনের ভেতর কোনও একজন হয়তো ফয়সাল। মিঠুনের মনে হয় ফয়সালকে যদি একনজর দেখা যেত, কপালটা স্পর্শ করা যেত। যদি দেখা যেত শেষযাত্রার সময়েও তার মুখের চিরচেনা হাসিটা লেগে আছে কিনা! ছব্বিশ জনের কারো মুখ কাউকেই দেখতে দেওয়া হয় না। হয়ত দেখানো সম্ভব নয়। হয়ত কাউকে চেনার উপায় নেই। পরিচয় শনাক্ত করার জন্য হয়তো ডিএনএ টেস্ট ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। মিঠুন জানিয়ে দেয় সবকিছু।

১৩ মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যায় বৈশাখী টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয় আহমেদ ফয়সাল আর নেই, কাউকে না বলে সুখপাখি হয়ে উড়ে গেছে না ফেরার দেশে! পরদিন বৈশাখীতে প্রচারিত হয় ফয়সালের করে যাওয়া কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রিপোর্টগুলো। একটি রিপোর্টে দেখা যায়, একটি স্কুলের পতাকা উত্তোলনের সময়ে ছাত্ররা যখন স্যালুট দিচ্ছে, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে তখন ফয়সাল বলছে তার শেষ কথাগুলো!

লাল টিপের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বিপাশার মতো, কাউকে না বলে ফয়সালের মতো যারা চলে গেছে না ফেরার দেশে, তাদের শেষ কথাগুলো রয়ে যাবে স্বজনদের হৃদয়ে। বেদনার বংশধর হয়ে তাদের স্মরণে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোই হোক আমাদের ভালোবাসা।

লেখক: রম্যলেখক

 

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ