X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

খালেদা জিয়া কতদিন জেলে থাকবেন?

আমীন আল রশীদ
২০ মার্চ ২০১৮, ১৪:২৭আপডেট : ২০ মার্চ ২০১৮, ১৪:২৮

আমীন আল রশীদ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় প্রায় দেড় মাস ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকা এবং হাইকোর্টে জামিন পাওয়ার পরও আপিল বিভাগে সেটি ৪ সপ্তাহের জন্য আটকে যাওয়া রাজনীতিতে নানা সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে। সেইসঙ্গে একটি ‘কম শক্তিশালী’ মামলায় মাত্র ৫ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা শুধু এই সময়ে নয়, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে অবশ্যপাঠ্য অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে।
পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার দিনেই (৮ ফেব্রুয়ারি) এই আদালতের অদূরে সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয় বেগম জিয়াকে। এর ঠিক আগের দিন তিনি সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন,তাতে এটা আন্দাজ করা গিয়েছিল যে, আদালত যে তাকে সাজা দেবেন,তা তিনি জানতেন অথবা সেই তথ্য তার কাছে ছিল। যে কারণে তিনি বলেছেন,তিনি যেকোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছেন।
এই মামলার মেরিট কী,এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলা নাকি আসলেই তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক––তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত আছে। বিএনপি এটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবেই দেখে এবং সবশেষ ১৯ মার্চ আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করে আদেশ দেওয়ার পরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন,তারা আদালতের কাছ থেকে এরকমটি প্রত্যাশা করেননি। অর্থাৎ তাদের প্রত্যাশা ছিল হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আপিল বিভাগ বহাল রাখবেন। সাধারণত এসব মামলায় হাইকোর্ট কাউকে জামিন দিলে আপিল বিভাগে সেটি স্থগিত হয় না। কিন্তু তারপরও আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। বিশেষ করে কোনও মামলার আসামি যখন একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

খালেদা জিয়াকে যেদিন কারাগারে নেওয়া হয়,তারপর থেকেই তার জামিন নিয়ে যে নাটকীয়তার সূত্রপাত হয়,সেটি আরও পরিষ্কার হয় ১৯ মার্চ যেদিন আপিল বিভাগ তার জামিনটি ৮ মে পর্য‌ন্ত স্থগিত করে বলেছেন যে, ওইদিন এ বিষয়ে শুনানি হবে। অর্থাৎ আইনত ৮ মে’র আগে তিনি মুক্তি পাচ্ছেন না।

খালেদা জিয়া যে দ্রুত মুক্তি পাচ্ছেন না তার ইঙ্গিত অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল হাইকোর্ট যেদিন (১২ মার্চ) তাকে ৪ মাসের জামিন দিয়েছিলেন। কেননা ওইদিনই একটি নাশকতার মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন কুমিল্লার আদালত। এরপর আরও নাটকীয়তা তৈরি হয় ১৯ মার্চ। এদিন আপিল বিভাগ প্রথমে আদেশ দিয়েছিলেন যে, খালেদা জিয়ার জামিন ২২ মে পর্যন্ত স্থগিত এবং টেলিভিশনগুলো এ বিষয়ে ব্রেকিং সংবাদও প্রচার করে। কিন্তু খানিক বাদেই আদালত সাংবাদিকদের ভেতরে ডেকে পাঠান এবং জানান যে, আদেশটি সংশোধন করা হয়েছে এবং নতুন আদেশ অনুযায়ী খালেদা জিয়ার জামিন ৮ মে পর্য‌ন্ত স্থগিত থাকবে। বিচারিক ইতিহাসে এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না।

এসব ঘটনায় যে প্রশ্নটি মূলত সামনে আসছে তা হলো, খালেদা জিয়া আসলে কতদিন জেলে থাকবেন? তার মামলাটি দ্রুত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালত এবং আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়ে তিনি কি ৫ বছরই জেলে থাকবেন নাকি উচ্চ আদালত তার সাজা স্থগিত রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেবেন? এ বিষয়ে আগাম মন্তব্য করার সুযোগ নেই। তবে এটা ঠিক যে, খালেদা জিয়ার জেলে থাকা না থাকার বিষয়টি আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনে একটা বড় ইস্যু হবে।

আরেকটি প্রশ্ন শোনা যায় যে, বেগম জিয়া কারাগারে থাকলে কার লাভ, কার ক্ষতি? তিনি জেলে থাকলে এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না পেলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এর সুবিধা পাবে। কেননা, নির্বাচনের মাঠে খালেদা জিয়ার থাকা আর না থাকার পার্থক্য অনেক। আবার তিনি জেলে থাকবেন এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন, এমনটি হলে বল চলে যাবে বিএনপির কোর্টে। কারণ তখন মানুষের বাড়তি সহানুভূতি পাবেন খালেদা জিয়া ও তার দল।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার একদিন জেলে থাকা মানে বিএনপির ১০ লাখ ভোট বাড়া।’ আসলেই কি তাই? ভোটে যারা সরাসরি নৌকা-ধানের শীষের পক্ষ নন বরং মধ্যবর্তী এবং দোদুল্যমান, সেই ভোটারদের একটা সাধারণ সহানুভূতি যে এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার পক্ষে আছে এবং ভোট এগিয়ে আসার সাথে সাথে এই সহানুভূতি আরও বাড়বে, রাজনীতির সরল অংকটা সেরকমই। কেননা, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হলেও এবং তারা সত্যিই কোনও খুনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশই মনে করে, এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলা। ফলে রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার মতো হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেকোনও মামলাই একটি রাজনৈতিক চরিত্র পায় এবং দলের নেতাকর্মীরা এটি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের নেতার বিরুদ্ধে দায়ের করা এই মামলাটি প্রতিহিংসার। ফলে তারা যখন কারাগারে থাকেন, তখন মানুষের সহানুভূতি তাদের পক্ষে যায়। সুতরাং খালেদা জিয়া যতদিন জেলে থাকবেন, বিএনপির ভোট তত বাড়বে––মওদুদ আহমদের এই বক্তব্য একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। যদি তাই হয়, তাহলে কি বিএনপির নেতারাও চান যে, বেগম জিয়া জেলেই থাকুন?

খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমান যদি অরফানেজ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হন, তাহলে বিএনপি কি এবারও ভোট বর্জন করবে? গুঞ্জন রয়েছে, খালেদা-তারেককে ছাড়াই বিএনপি নির্বাচনে যাবে। যদি তাই হয় তাহলে সেটি দেশের রাজনীতিতে একটা নতুন মেরুকরণের জন্ম দেবে। কেননা, বিএনপি যদি ওই নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন বিএনপির তরফে একজন নতুন মুখ হবেন বিরোধী নেতা। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান যদি নির্বাচনে অযোগ্য হন, তখন বিএনপি কি এই দুজনের উত্তরসূরি হিসেবে তারেকপত্নী ডা. জোবায়দাকে সামনে নিয়ে আসবে? নাকি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচনে যাবে? বাংলাদেশের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে এই সম্ভাবনা অবশ্য ক্ষীণ।

এসব সমীকরণে আগামী নির্বাচনের প্রাক্কালে খালেদা জিয়ার জেলে থাকা এবং না থাকা, নির্বাচনে যোগ্য হওয়া এবং না হওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আবার তার মুক্তির দাবিতে বিএনপি যে কোনও কঠোর কর্মসূচি দেবে না, তা এরইমধ্যে তারা জানিয়েছে এবং খালেদা জিয়া নিজেও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে দলের তরফে জানানো হয়েছে। যদিও নির্বাচনের বছরে এসে ক্ষমতাসীনরা চাইবে বিএনপি রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও করুক এবং তাদের জনসমর্থন কমুক। কিন্তু বিএনপি সেই ধৈর্যের পরীক্ষায় কতটা উত্তীর্ণ হতে পারবে,তারওপরে অনেক কিছুই নির্ভর করবে।

এটা ঠিক, দীর্ঘ সময় ক্ষমতা ও সংসদের বাইরে থাকায় বিএনপির তৃণমূলে দারুণ অসন্তোষ রয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপি যদি আরও  একবার নির্বাচন বর্জন করে ক্ষমতা ও সংসদের বাইরেই থাকে, তাহলে মাঠে তাদের কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে বিএনপির সামনে যে বিশাল সংকট এবং খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত হলে যে সেই সংকট ঘনীভূত হবে, তা সহজেই আন্দাজ করা যাচ্ছে।

রাজনীতিতে যেহেতু শেষ কথা বলে কিছু নেই,তাই খালেদা জিয়া কতদিন জেলে থাকবেন, তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কী পারবেন না, যদি না পারেন তাহলে তাকে ছাড়াই বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না,গেলে তখন দেশের রাজনীতিতে আসলেই নতুন কোনও মেরুকরণ তথা পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে একটা নতুন কিছু ঘটবে কি না­­––সেসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের আপাতত অপেক্ষাই করতে হবে। তবে ঘটনা যা-ই ঘটুক, দেশের রাজনীতি সংঘাতপূর্ণ না হোক, দেশের মানুষ ভালো থাকুক; উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যে যোগ্যতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি রাজনীতির বিষবাষ্পে দূষিত না হোক, এটিই প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ