X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি বিপর্যয় এড়াবে কী করে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২২ মার্চ ২০১৮, ১৫:১৬আপডেট : ২২ মার্চ ২০১৮, ১৫:১৮

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হলে নির্বাচন হওয়া শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা। সুতরাং দশম সংসদের মেয়াদ এ বছর শেষ। একাদশ সংসদের নির্বাচন আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে হবে। বছরটা ঝামেলায় ভরা, তাই অনেকে সন্দেহ করছেন নির্বাচনটা শেষ পর্যন্ত হবে কিনা? হলেও বিএনপি নির্বাচনে আসবে কিনা? খালেদা জিয়া কি নির্বাচনের আগে মুক্তি পাবেন? শেষ পর্যন্ত বিএনপি কি বর্তমান ছন্নছাড়া অবস্থান ঘুচিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?
অবশ্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। শুধু বড় দলের মাঝে বিএনপি এখনও প্রকাশ্যে প্রচারণায় নামেনি। জামাতের তো নিবন্ধনই নেই। বিএনপি নির্বাচনে গেলে হয়তো তাদের ঘাড়ে উঠবে। বিএনপি অবশ্য বলেছে তারাও তিনশ’ আসনের জন্য তিনশ’ প্রার্থী চূড়ান্ত করে রেখেছে। কিন্তু বিএনপির জন্য বড় মুশকিল হচ্ছে তাদের দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট-এর দুর্নীতি মামলায় ৫ বছর জেল হয়েছে। বর্তমানে তিনি নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো জেলখানায় কারারুদ্ধ আছেন।
দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি তারেক রহমানের এক মামলায় সাড়ে সাত বছর আর এতিমখানার মামলায় দশ বছর জেল হয়েছে। তিনিও দেশে নেই। বর্তমানে ব্রিটেনে অবস্থান করছেন আর যুক্তরাজ্য সরকার তাকে নাকি রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। উভয়ের বিরুদ্ধে আরও  অসংখ্য মামলা রয়েছে। মামলাগুলোর মাঝে গ্রেনেড হামলা মামলা হচ্ছে খুবই স্পর্শকাতর। আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে এ মামলার রায় হবে। এ মামলায় ৫২ জন আসামির মাঝে তারেক রহমানও রয়েছে।

এই মামলার আসামিদের মাঝে অপর মামলায় তিনজনের ফাঁসি হয়েছে। ঘটনার সময়কালের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফরজ্জামান বাবর, গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিমও আসামি। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় ট্রায়েল কোর্টে এ তিনজনের ফাঁসির হুকুম হয়েছে। গ্রেনেড হত্যা মামলায়ও অনেকের ফাঁসি হবে অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। তারেক জিয়াও বাদ যাবে বলে মনে হয় না। কারণ, তার হাওয়া ভবনেই সব ষড়যন্ত্র হয়েছে।

সেদিনের অপারেশন সফল হলে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকে প্রাণ হারাতেন। এখানেও আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। তখন বিএনপি ক্ষমতায়, তারাই জজ মিয়াকে প্রধান আসামি করে এ মামলায় চার্জশিট দিয়েছিলেন। বিচারপতি জয়নালকে দিয়ে এক তদন্ত কমিশনও গঠন করেছিলেন আর তিনি রিপোর্টে বলেছিলেন পাশের দেশের লোকজনেরাই এ হামলার জন্য দায়ী। মিথ্যা একটি ইতিহাস রচনা করা হয়েছিল।

কারাবন্দি বেগম জিয়ার জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছিল। হাইকোর্ট তাকে ৪ মাসের জন্য জামিনও দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার পক্ষ ও দুদক সুপ্রিম কোর্টে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল। শুনানির পর ৮ মে পর্যন্ত জামিন স্থগিত করে দিয়েছেন। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে আরো গ্রেফতারি পরোয়ারা রয়েছে, সহজে জামিন হবে বলে মনে হচ্ছে না। খন্দকার মোশতাকের কাপ-পিরিচ চুরির মামলার রায়ে তিন বছর জেল হওয়ার পর জামিন হয়নি। আবার এরশাদের জনতা ভবনের মামলায় ৫ বছর জেল হয়, তখন ৩ বছর জেল খাটার পর তার জামিন হয়েছিল। এখনও মনে হচ্ছে না সহজে বেগম জিয়ার জামিন হবে।

রাজনীতিতে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে যেকোনও সংগঠন বিপর্যয় এড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। পরিবারকেন্দ্রিক দল। এ পরিবারের যারা নেতৃত্ব দেবেন তারা কেউই দৃশ্যে নেই। সুতরাং বলতে হয় বিএনপি কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। অনুরূপ পরিস্থিতিতে বিএনপি কোনও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিনা জানি না। তবে কোনও বাড়ম্বরে না জড়িয়ে বিএনপির উচিত নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া, যোগদান করা। বেগম জিয়া বা তারেক জিয়ার অনুপস্থিতিতে নির্বাচন করা কঠিন হবে না। এ পথ ছাড়া অন্য কোনও পথে তাদের উত্তরণের কোনও সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য তাদের কোনও বিদেশি শক্তি অন্যকোনও আশ্বাস দিয়েছে কিনা জানি না। তবে এমন কোনও আলামত আপাতত দৃশ্যমান নয়।

২০১৪ সালে তাদের পক্ষ অবলম্বন করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত দিল্লি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কোনও প্রত্যক্ষ ফল তো পাওয়া যায়নি। বিএনপি নেতাকর্মীদের কথায় আচরণে বুঝা যাচ্ছে তারা কৃত্রিম উত্তেজনায় রয়েছে। কৃত্রিম উত্তেজনার দোষ এই যে তা ফুরিয়ে গেলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। খুলনার জনসভায় মহাসচিবের বক্তৃতা বাস্তবতা ছাড়া কৃত্রিম উত্তেজনায় ভরা। বিএনপিকে এখন কৌশলী হতে হবে। ধৈর্য্যহীন হলে চলবে না। আগামী দিনের রাজনীতিতে বিএনপির জন্য কোনও সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। যারা দীর্ঘ ক্লান্তিকর পথ পাড়ি দিতে রাজি তারাই এখন বিএনপি করবে।

আমার কথা অনেকের পছন্দ হবে না। তবে এটিই সত্য। গত পঞ্চাশ বছর রাজনীতির উত্থান-পতনে এমনটাই দেখেছি। বিএনপির জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ১৫/১৬ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। বহু অধর্ম তারা করেছে। জনসভায় গ্রেনেড মেরে মানুষ হত্যা করার সংস্কৃতি তারাই এনেছে। মোশতাককে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় বঙ্গভবনের কাপ-পিরিচ চুরির অপরাধে তিন বছর জেল তারাই দিয়েছিল। চাইলে মোশতাকের নানা অপরাধের বিচার করতে পারতেন তারা, কিন্তু একজন রাষ্ট্রপতিকে ফালতু চুরির মামলা দিয়ে অপমান করা উচিত ছিল না। জিয়া পরিবারের দুর্দিন এমনি এমনি আসেনি।

যাক, পড়ে যাওয়া দুধ নিয়ে অনুশোচনা করা বিএনপির এখন ঠিক হবে না। এখন তারা যদি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে চায় তবে নির্বাচনে আসাই তাদের জন্য উত্তম হবে। কারণ, তাদেরও রয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন।

আওয়ামী লীগ প্রাচীন দল, তারা নির্বাচন করবে। জাতীয় পার্টিও নির্বাচন করবে। কিছু ইসলামিক দলও নির্বাচন করবে। সুতরাং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তেমন কোনও প্রশ্নের অবতারণা হবে বলে মনে হয় না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সাইলেন্ট। আগের মতো রাজনীতি নিয়ে বাড়াবাড়িতে যেতে তারা রাজি নয়। যে কারণে কোনও দল উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। বিএনপিও যে  কোনও উল্লেখযোগ্য আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারবে তাও নয়। দেশের মানুষের সামগ্রিকভাবে রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহই রাজনীতিকে উত্তাপহীন করে ফেলেছে। অনুরূপ অবস্থায় বিএনপির পক্ষে দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করে কোনও গণজোয়ার সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।

আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপির কাঁচা হাত। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সফলতা পেয়েছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল বলে। আন্দোলনের কৌশলে আওয়ামী লীগের পারদর্শিতা আছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যখন আরম্ভ হয় তখন আওয়ামী লীগের অফিসের ওপর দিয়ে কাকপক্ষী উড়ে যায়নি। জেলা পর্যায়ের নেতারাও ছিল কারারুদ্ধ। এরপরও আওয়ামী লীগের কর্মীরা দেশকে ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল এবং সরকারকে বাধ্য করেছিল ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে।

এখন সেই প্রেক্ষাপটও নেই, জনসাধারণের মাঝে সেই উত্তেজনাও নেই। বিএনপি সেরকম ত্যাগী কর্মীর দল নয়। সুতরাং বিএনপির পক্ষে সে গণজাগরণ সৃষ্টি করাও সম্ভব হবে না। কোনও গণঅভ্যুত্থানও তারা আশা করতে পারে না। “মা” ডেকে “বাবা” ডেকে মানুষকে আর আকৃষ্ট করাও যাবে না। “মাদার অব ডেমোক্রেসি”র অলংকার দিয়ে সাজাবার চেষ্টা করেও আর লাভ হবে না। দীর্ঘ ১০ বছরের সফলতাহীন অবস্থান বিএনপিকে অকার্যকর করে ফেলেছে।

যেহেতু তারা গ্রেনেড মেরে মানুষ হত্যা করতে অভ্যস্ত, পেট্রোলবোমা যাত্রীবাহী বাসে ছুড়ে মেরে মানুষ হত্যা করে উল্লাস করে, তাদের গতিবিধি ও নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজরদারি ছাড়া হতে পারে না। এখানে গণতান্ত্রিক অধিকারের আওয়াজ তুলেও লাভ নেই। গণতান্ত্রিক অধিকারের অর্থ পেট্রোলবোমা মেরে নির্বিচারে মানুষ হত্যা নয়।

বিএনপির জন্ম হয়েছিল সেনা ছাউনিতে। জেনারেল শিশু অক্লান্ত পরিশ্রম করে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিবিদদের একত্রিত করে এ দলের জন্ম দেয়। জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত প্রো-পাকিস্তানিরা বিএনপির সঙ্গেই আছে। বেগম জিয়া নেতৃত্বে আসার পর দীর্ঘদিন বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে দলের গণভিত্তিও সৃষ্টি হয়েছিল। তাই দলটি দশ বছর ক্ষমতায়ও ছিল কিন্তু তারেক জিয়ার অতি নাটকীয়তা এখন দলটাকে এ করুণ পরিণতির মুখোমুখি করেছে। আপাতত আমরা যে পরিস্থিতি দেখছি তাতে মনে হয় না যে দলটির শাসনতান্ত্রিক রাজনীতি ছাড়া বিকল্প পথে হাঁটার কোনও সুযোগ আছে। সুতরাং কোনও বাড়ম্বর ছাড়াই তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় তারা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ