X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

শীতবসন্তের বইমেলা, মাঞ্জা-সাজ

দাউদ হায়দার
২৩ মার্চ ২০১৮, ১৩:০৫আপডেট : ৩১ মার্চ ২০১৮, ১৪:০২

দাউদ হায়দার ‘ই-বুক যতই পপুলার হোক, ছাপা-বইয়ের কদর কখনও কমবে না। বরং বৃদ্ধি পাবে। পাচ্ছে। গত তিন বছরের পরিসংখ্যানে এই তথ্য প্রমাণিত।’ লাইপজিগ বইমেলায়, উদ্বোধনী সন্ধ্যায়, ১৫ মার্চে, জার্মান পাব্লিশার্স গিল্ডের চেয়ারম্যান আলেক্সজান্ডার স্কিপিস আরও বললেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য, বিশ্বব্যাপী পুস্তক প্রকাশকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ছাপা বইয়ের ক্রেতাও।’ তার কণ্ঠ গদগদ, কিছুটা আবেগমাখাও। পরিহাসচ্ছলে বলেন, ‘ই-বুকের পাঠক মূলত পোলাপান (ইয়ং জেনারেশন)। ছাপা-বইয়ের আদর, চাহিদা অভিজ্ঞ বয়স্ক (যারা ইয়ং নন) পাঠকের কাছে সর্বদাই তুল্যমূল্য। অতএব, বই ব্যবসা (ছাপা), বইয়ের বাজার, বইয়ের ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’
লন্ডনের বিখ্যাত ফেবার অ্যান্ড ফেবার প্রকাশন সংস্থার পরিচালক জানালেন (বক্তৃতায়), ‘গোটা বই ডাউনলোড করে ই-বুকে ছাড়া হচ্ছে। এই সাংঘাতিক পাইরেসি-রোধে সব দেশকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা ইতোমধ্যেই দ্য হেগের আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছি।’
তিনি কোনও দেশের নাম করেননি কিন্তু চোরচক্রে এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকা পয়লা। মাফিয়া। বলেন।
নাম না করলেও চীন, ব্রাজিলকে বুঝিয়েছেন।
-দুই বছর আগে চীনের এক চক্র মার্কেজের সব বই মূল স্প্যানিশ ও ইংরেজি অনুবাদ ই-বুকে হুবহু পাচার করে। ব্রাজিল আরো এক কাঠি সরেশ। পর্তুগিজ লেখক জোসে সারামাগো (নোবেল বিজয়ী) এবং মারিও ভার্গাস ইয়োসার (নোবেলজয়ী) হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপিও বাদ দেয়নি। ধরা পড়েছে। জরিমানা দিয়েছে বটে, কিন্তু, জরিমানা দিয়েও ১১ মিলিয়ন ডলার কামিয়েছে।
একজন জনপ্রিয় লেখক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত, রয়ালটি থেকে বঞ্চিত, প্রায়ই খবরে প্রকাশিত।
বার্লিনে একজন ঘোরতর-হুমায়ূনভক্ত আছেন। মধ্যবয়স্কা। বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ পড়েননি। দেখা হলে, হুমায়ূনের গল্প-উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দেন। ‘আমার কাছে হুমায়ূনের সব বই আছে।’ জানান।
সত্যি কথা বলেন, ‘তবে ছাপা বই নয়। ছোটবোন ইন্টারনেটে ডাউনলোড করে ই-মেলে পাঠিয়েছে। এখন ই-বুকে আছে।’
ই-বুকের প্রকাশ্য ব্যবসাও যথারীতি, তবে জনপ্রিয়তার ব্লকবাস্টার নয়। এটাই নাকি আশার, লাপজিগ বইমেলায় শোনা গেল।
আমরা জানি, ফ্রাংকফুর্ট বইমেলাকে বলা হয় ‘বইয়ের মক্কা।’ সদর্থেই এই বিশেষণ। বইয়ের মক্কাই বটে। ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় ৬ হাজারের বেশি প্রকাশকের অংশগ্রহণ, পৃথিবীর সব দেশ থেকে।
ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় বইয়ের বেচাকেনা নেই। কেবল বই প্রদর্শনী এবং কপিরাইট বিক্রি।
গত দুই বছরে বাংলাদেশের কয়েকজন প্রকাশকের সম্মিলিত অংশগ্রহণ, এর আগে দুই-একজন। নিয়মিত অংশগ্রহণকারী অঙ্কুর/ চারদিক প্রকাশনের মেসবাহউদ্দীন আহমেদ।
ফ্রাংকফুর্ট বুক ফেয়ারের বয়স বেশি নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চার বছর পরে ১৯৪৯ সাল থেকে। পশ্চিম জার্মানি, পূর্ব জার্মানি ভাগ হয়ে গেছে। পশ্চিম জার্মানি অ্যালায়েড ফোর্সের অধীনে আমেরিকা মাতব্বর। আমেরিকার মার্শল প্ল্যানে পশ্চিম জার্মানি ক্রমশ স্ফীত। ফ্রাংকফুর্টের বাড়বাড়ন্ত, ফ্রাংকফুর্ট বইমেলার আয়োজন। ধনতান্ত্রিক আস্ফালনে বইমেলা, প্রচারণা তুঙ্গে, বিশ্বব্যাপী। অচিরেই ‘বইমালার মক্কায়’পরিণত।
মার খায় লাইপজিগ বইমেলা। লাইপজিগ তথা পূর্ব জার্মানি তখন কমিউনিস্ট ব্লকে, সোভিয়েট রাশিয়ার কবলে। লাইপজিগেই প্রথম বইমেলা ১৬৩২ সালে। শুরুতে ধর্মীয় বই নিয়ে।
লাইপজিগ জার্মানির ৬টি বড় শহরের একটি। ঐতিহাসিক শহর। ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। একদা বাণিজ্যে-শিল্পসংস্কৃতিতে গরীয়ান। কতটা গরীয়ান, ইতিহাসে বিবৃত। নেপোলিয়নও লাইপজিগে দখলে দুইবার মরিয়া। এই লাইপজিগে মহাকবি ইয়োহান ভোলফগাঙ গ্যোয়টে, বাদক ইয়োহান সেবাস্টিয়ান বাথ, রিশার্ড ভাগনার, ফেলিফস মেলডেনসন ঠাঁই গেড়েছেন। আরও কথা, লাইপজিগেই ‘জার্মান বিপ্লবের সূত্রপাত।’ মহামতি কার্ল মার্ক্সও লাইপজিগকে ‘সূতিকাভূমি’ ভেবেছেন। জার্মানির বিপ্লবের ইতিহাসে লাইপজিগ সর্বদাই অগ্রগণ্য। এমনকি ১৯৮৯ সালে দুই জার্মানির একত্রীকরণের বিপ্লবও লাইপজিগ থেকে। থাক এসব।
আমরা লাইপজিগ বইমেলার কথা বলছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত কমিউনিস্ট ব্লকে পূর্ব জার্মানির লাইপজিগেই প্রথম বইমেলার প্রচলন। ‘লাইপজিগ বুখ মেসে’ নামকরণ করে হলেও মূলত ‘বসন্তকালীন বইমেলা’।
বসন্তের আদৌ কোনও বালাই নেই এখন। ১৫ তারিখে (১৫ থেকে ১৮ মার্চ বইমেলা) দুপুর যখন লাইপজিগে পৌঁছুই মাইনাস ৮ ডিগ্রি শীত। গোটা শহর-তল্লাট তুষারে আচ্ছন্ন। যেন শাদা কাফনে আবৃত। শীত-তুষারের মধ্যেই প্রায় হাজারখানেক মানুষ (কিছু কমও হতে পারে) বইমেলার প্রবেশমুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। কারণ গুরুতর। এবারের বইমেলায় ডজনখানেক রাইটিস্ট (দক্ষিণপন্থী) প্রকাশক অংশ নিয়েছে। এসব প্রকাশক উদ্বাস্তু, ইসলাম, বিদেশি বিদ্বেষী। বইও ছেপেছে। মেলা থেকে তাদের বহিষ্কারের দাবি। মেলা কর্তৃপক্ষ অবশ্য ‘গণতান্ত্রিক’ লেবাসে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বহিষ্কার করেনি। মেলায় পূর্ব-পশ্চিম ইউরোপসহ পৃথিবীর ৮৪ দেশের ২ হাজার ৬২৩ প্রকাশক হাজির। দিল্লি থেকে চারটি। মুম্বাইয়ের একটি।
লাইপজিগ বইমেলার (কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির আমল থেকে) ঐতিহ্য পূর্ব ইউরোপকে তুলে ধরা। পূর্ব ইউরোপের সাহিত্যের প্রচার। এ বছর কান্ট্রি থিম রুমানিয়া। পশ্চিমা বিশ্বে তথা পশ্চিম ইউরোপে, দুনিয়ায় রুমানিয়ার সাহিত্য তুমুল পরিচিত নয়। যতটা রাজনীতি পরিচিত। রুমানিয়ার ৯৭ প্রকাশকের স্টল, ১৮৯ জন লেখকের উপস্থিতি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বই থেকে পাঠ। আলোচনায় অংশীদার। এক আলোচনায় শুনলাম, কেউ কেউ মাতৃভাষার বদলে ইংরেজিতে লিখছেন। বাজারও পাচ্ছেন।
লাইপজিগ বইমেলার পুরস্কার বহুল সম্মানিত। ২০১৮ সালে পুরস্কার পেলেন নরওয়ের লেখিকা আসনে জাইয়ারস্টাড (ASNE SEIERSTAD)। পুরস্কার মূল্য ২০ হাজার ইউরো। তার বইয়ের নাম : ‘One of Us. The Story of Anders Breivik and The Massacare in NORWAY.’
চার দিনব্যাপী লাইপজিগ বইমেলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় কী?
-প্রায় হাফ মিলিয়ন দর্শকের ভিড় কেন? বই প্রদর্শনী তো আছেই। গোটা শনিবার কিশোর-কিশোরী-তরুণ-তরুণীর ‘যেমন খুশি সাজো। সঙ্গে ‘মাঞ্জা’-সাজ (জাপানি কমিক মাঞ্জা-সাজ)। বিচিত্র সাজপোশাক। মুখে-শরীরে আঁকিবুঁকি। নানা মুখোশ। জার্মানির বিভিন্ন শহরের স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সমাগম। অংশগ্রহণ। আরও আছে ‘লাইপজিগ লিস্ট’। বইমেলা উপলক্ষে শহরের লাইব্রেরি, পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র, বার, রেস্তোরাঁ, কফি-বার-এ চারদিন দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যায় লেখকের লেখাপাঠ। বিনা টিকিটে প্রবেশ। বাংলাদেশে বইমেলায় এই আয়োজন কী অসম্ভব?
লেখক: কবি ও সাংবাদিক

/ওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ