X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনুভূতির অনুভূতিহীন সাংবাদিকতা

তুষার আবদুল্লাহ
২৪ মার্চ ২০১৮, ১৭:১৬আপডেট : ২৪ মার্চ ২০১৮, ১৭:২০

তুষার আবদুল্লাহ শিশুটিকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ভয়ে। যেন সে ভয়ঙ্কর কারো সামনে পড়ে না যায়। সামনে পড়ে গেলেই আক্রান্ত হওয়ার ভয় ছিল। শেষ পর্যন্ত শিশুটি রক্ষা পেয়েছে। তার পরিবার তাকে সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিল শুক্রবার। বলছি পাইলট আবিদ সুলতান ও আফসানা খানম দম্পতির সন্তানের কথা। আবিদ সুলতান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার শোক সইতে পারেননি তার স্ত্রী আফসানা। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হন। ছয়দিন পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ব্যস, তারপরই গণমাধ্যম কর্মীরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতে থাকেন এই দম্পতির একমাত্র সন্তানকে।

শিশু সন্তানের সামনে মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা-বাবা’র পর ,মাকে হারিয়ে তোমার অনুভূতি কী? তারপর প্রশ্নের ফুলঝুরি গিয়ে ঠেকতে পারতো- কী মনে হয় কন্ট্রোল টাওয়ার নাকি তোমার বাবা’র ভুলের জন্য বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটলো? চলে আসতে পারতো বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া সম্পদ বা বীমার টাকা নিয়ে ও কী ভাবছে এমন প্রশ্নও। এমন সব প্রশ্ন শিশুটিকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারতো। এই পূর্বাভাস জেনেই পরিবারটি শিশুটিকে লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল। আমার সহকর্মীরা কিংবা পাঠকেরা ভাবতে পারেন আমি একটু বাড়িয়েই কথাগুলো বললাম। কিন্তু আপনারা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকান- দেখবেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর শিশুপুত্র মেঘকেও বাবা-মায়ের মৃত্যুর কিছু সময়ের মধ্যে গণমাধ্যম কর্মীর প্রশ্নবানের মুখে পড়তে হয়েছিল। আর এখনও বাসি হয়ে যায়নি এমন ঘটনা বললেতো আর্মি স্টেডিয়ামে ২৩টি মরদেহ যখন এনে রাখা হয়। তখন মরদেহ দেখে শোকে মুহ্যমান পরিজন এমনকি সন্তানের মরদেহের সামনে দাঁড়ানো বাবা-মায়ের কাছে আমাদের গণমাধ্যম কর্মীরা জানতে চাইলেন-ছেলেকে কোথায় দাফন করবেন? এই প্রশ্ন শুনে কোনও কোনও বাবা- মা আঁতকে উঠেছিলেন। কারণ তারা তখনও হয়তো মানসিকভাবে তৈরি হতে পারেননি আত্মার অংশটিকে মাটিচাপা দেওয়ার। অথচ গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে কত প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল এটি!

গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার এখন জলভাত বিষয়। টেলিভিশনে যেকোনও দুর্ঘটনা, হত্যা ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি সম্প্রচার শুরু হয়ে যায়। এই সরাসরি সম্প্রচার কালে আমরা দেখছি গণমাধ্যম কর্মীরা নিহতের স্বজনদের সামনে মাইক্রোফোন নিয়ে কেমন করে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। ঘটনার কারণ জানতে আত্মীয়-পরিজন-প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলা, তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন আছে ঠিক। কিন্তু কোন শিশু শোকে জ্ঞানহারা বাবা-মা বা প্রবীণের কাছ থেকে অনুভূতি জানার কসরত কেন? সেই সঙ্গে আছে ‘বিলাপ’-এর দৃশ্য উৎসব উদযাপনের ঢঙে প্রচার। প্রিয়জনের মৃত্যু হলে বিলাপ শোকের একপ্রকার প্রকাশ। সেই ব্যক্তিগত প্রকাশ যখন সকলের তরে সম্প্রচার করে দেওয়া হয়, তখন আমরা গণমাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশন কর্মীরা ভুলে যাই-এই বিলাপ দেখে কোন শিশু, শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ কোনও দর্শক আতঙ্কিত হতে পারেন। বাড়তে পারে অসুস্থতার মাত্রা। টেলিভিশনের স্বস্তা চিন্তা- বিলাপের ছবি এবং শব্দ যোগ করলেই প্রতিবেদনটি দর্শকের কাছে হৃদয়স্পর্শী হবে বা দর্শক খাবে। এই ভাবনা যাদের, তারা সৃজনশীল চিন্তার গণমাধ্যমকর্মী নন মোটেই। বিলাপ ছাড়াও যে হৃদয়স্পর্শী প্রতিবেদন তৈরি করা যায়, সেই কৌশল জানা নেই তাদের।

গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমার নিজেরও মনে হয় আমরা এখনো শোকাবহ পরিবেশ বা ঘটনার রিপোর্ট করা শিখে উঠতে পারিনি। এই ধরনের ঘটনাস্থলে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা শৃঙ্খলাহীনতার সর্বোচ্চটি প্রদর্শন করেন। ছবি ও বক্তব্য ধারণ করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কোলাহল হাতাহাতির ঘটনা থেকে শুরু করে, নিহত বা মৃতের বাড়ির মানুষদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করতে থাকি আমরা। বিষয়টি এমন যে মৃতের পরিজনরা আমাদের কাছে মন্তব্য করতে বাধ্য। ঘরের ভেতরে যেতে দিতে, লাশের ছবি তুলতে দিতে বাধ্য। না দিতে চাইলে চলে জোর জবরদস্তি। বিখ্যাত ব্যক্তি থেকে শুরু করে হত্যা শিকার যে ব্যক্তি, তাদের কারো পরিবারেরই যেন ব্যক্তিগতভাবে শোক পালনের অধিকার নেই। দর্শক-পাঠকরা যেন হা করে, কান পেতে বসে আছেন-এই পরিবারগুলোর অনুভূতি জানার জন্য। অথচ স্বাভাবিকভাবে কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যু হলে কবে, কখন, কোথায় মৃত্যু হলো এই তথ্যটুকুই দর্শকের জানা দরকার। যদি তার সম্পর্কে পরিবার বা অন্য কেউ মন্তব্য করতে রাজি হোন, তাদের বক্তব্য যোগ করা যেতে পারে। হত্যা, দুর্ঘটনার মৃত্যুর বেলাতে দুর্ঘটনার কারণ, হত্যার কারণ, দায়ী বা হত্যাকারী কে এই তথ্যগুলো দর্শক জানতে চায়। এক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য যোগ হলেই হলো। মনে রাখতে হবে নিহতের পরিবার গণমাধ্যম কর্মীর কাছে বক্তব্য দিতে বাধ্য নয়।  তদন্তের প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বক্তব্য নেবে সময় ও সুযোগ করে। আমরা এমনও দেখছি-গণমাধ্যম কর্মীদের দাপাদাপিতে দুর্ঘটনা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলের আলামতও নষ্ট হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের প্রাথমিক তদন্ত কাজও শুরু করতে পারেন না।

গণমাধ্যমে যে তরুণ সহকর্মীরা যোগ হচ্ছে নিয়মিত, এই দায় ঠিক তাদের দেওয়া যাবে না। গণমাধ্যমে প্রাচীন মনকাঠামো ও নিম্নরুচি নিয়ে যারা অবস্থান করছেন দায় তাদের। আধুনিক সাংবাদিকতার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছেন, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ভান করলেও, প্রাচীন মনকাঠামোটি তারা ভেঙে বের হতে পারেননি। তাদের প্রভাব ও একনায়কোচিত নেতৃত্বে বাধ্য হয়ে তরুণরা সেই পথে হেঁটে যেতে বাধ্য হয়। প্রতিবাদ যে একেবারে হয় না তা নয়। প্রতিবাদ তরুণরাই করছেন। সরব হচ্ছেন ধীরে ধীরে। এক সময় তাদের দাবির মুখেই আমরা যারা প্রাচীন মনকাঠামো নিয়ে বসে আছি, তাদের মন ও চিন্তার ভাঙন শুরু হবে। গণমাধ্যমও মুক্ত হবে অনুভূতি’র অনুভূতিহীন সাংবাদিকতা থেকে।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি।

/এফএএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ