X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

গণতন্ত্র ও লোকাল বাস

আমীন আল রশীদ
২৭ মার্চ ২০১৮, ১২:৩৩আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৮, ১২:৪০

আমীন আল রশীদ বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের উৎসব করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং এখানে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না।
বিশ্বের ১২৯টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি ও সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ নামে জার্মানির ওই প্রতিষ্ঠান তাদের রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মৌলবাদীদের হামলা সংঘটিত হতে দেখা গেছে। সারাদেশে সহিংসতা চালানোর জন্য প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে বিরোধী দল বিএনপিকেও। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘দুই প্রধান নেত্রীর মধ্যকার বিরোধ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়।’
গণতন্ত্র যদি একটি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং আদর্শ হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে দুটি প্রশ্ন করা যায়। ১. সেই নীতির মানদণ্ড কী এবং কারা সেই মানদণ্ড ঠিক করবেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা? ২. পৃথিবীর সব দেশে গণতন্ত্রের মানদণ্ড কি অভিন্ন হবে? অর্থাৎ ব্রিটেন যে ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা করে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ বলে পরিচিত ভারত সেই একইরকম গণতন্ত্রের চর্চা করে কিনা বা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান দেশ বলে দাবিকৃত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেইবা গণতন্ত্রের চেহারাটা কেমন?

১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জার্মানভিত্তিক থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ (bertelsmann stiftung) গত ২২ মার্চ Democracy under Pressure: Polarization and Repression Are Increasing Worldwide শিরোনামের ওই রিপোর্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে লিখেছে: Due to worsened quality of elections, the formerly fifth democracy is classified as an autocracy again. (ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে একসময়ের পঞ্চম বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে আবার একনায়কতন্ত্রই ফিরে এসেছে।)

যে মুহূর্তে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের রাষ্ট্রীয় উৎসব পালন করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশ সম্পর্কে বেরটেলসম্যান স্টিফটুংর এই প্রতিবেদনকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখতে পারেন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ এই রিপোর্টকে চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন। আর বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম দাবি করেছেন, বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করে এই রিপোর্ট করিয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে প্রশ্ন উঠবে, বিশ্বের আরও যেসব দেশের নাম স্বৈরতন্ত্রের তালিকায় এসেছে, সেসব দেশের বিরোধীরাও কি টাকা দিয়ে এই রিপোর্ট করিয়েছে? ফলে একদিকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের যোগ্যতা অর্জন এবং অন্যদিকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকাভুক্ত হওয়ার ঘটনাটি নিতান্তই কাকতালীয় কিনা, তা বুঝতে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগবে। তবে এটা ঠিক যে চরম স্বৈরতান্ত্রিক হওয়ার পরও একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে দারুণ উন্নতি করতে পারে, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ চীন। আবার খুব আদর্শ গণতন্ত্রের চর্চা করলেই একটি দেশ অথনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে, এমনটা নাও হতে পারে। তবে গণতন্ত্র থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হয় এবং অর্থনীতিতে ভারসাম্য বজায় থাকে, একথাও মানতে হবে। 

এই রিপোর্ট প্রকাশের মাস দেড়েক আগেই ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যে বৈশ্বিক ‘গণতন্ত্রের সূচক’ প্রকাশ করে, সেখানে বাংলাদেশের স্কোর গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছেছে বলে জানায়। এ বিষয়ে বিতর্কে না গিয়ে সাদাচোখে দেখেই এটি বলা যায় যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ওই অর্থে খুব সুখকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না। বাস্তবতা হলো, আমরা যে ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সরকার ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক বলে চিন্তা করি, সে রকম কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র আমাদের দেশে কখনও ছিল না। আবার এই মুহূর্তে, অর্থাৎ ২০১৮ সালে এসে যে ধরনের গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি সেটি আগের চেয়ে কতটা খারাপ কিংবা ভালো, তা নিয়েও পরস্পরবিরোধী মত আছে। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থীর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়া এবং একটি বৃহৎ রাজনৈতিক জোটের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চায় একটি বড় আঘাত এসেছে বলে অনেকে মনে করলেও যে পরিস্থিতিতে ওই নির্বাচনটি হয়েছিল, তার কোনো বিকল্প ছিল কিনা, সে প্রশ্নও আছে।

বাংলাদেশ মূলত একটি উঠতি গণতন্ত্রের দেশ। অর্থাৎ এখানে গণতন্ত্র নেই বা একনায়কতন্ত্র চলছে, এ কথা বলার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি আমরা খুব ভালো গণতন্ত্রের চর্চা করছি, এমন দাবি করাও অযৌক্তিক। বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র গাবতলী টু সায়েদাবাদ লোকাল বাসের মতো। সে ধীরে ধীরে চলবে। মাঝে মধ্যে থামবে। যাত্রী তুলবে। সামনের গাড়িকে ধাক্কা দেবে। কিছু অনিয়ম করবে। যাত্রীরা হইচই করবে। কিন্তু সে ঠিকই একসময় গাবতলী থেকে সায়েদাবাদে গিয়ে পৌঁছাবে। আমরা এখনই আমাদের দেশ গণতন্ত্রের পথে ঢাকা-সিলেট বিরতিহীন বাসের মতো চলবে, সেটি প্রত্যাশা করতেই পারি, কিন্তু বিষয়টা এত সহজ নয়। একটি দেশের পূর্ণ গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার পেছনে সেই দেশের জনগণ নিজেরা নিজেদের জীবনে গণতন্ত্রের চর্চা কতটুকু করছে, তাও বড় ভূমিকা রাখে।

১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পরপরই বাংলাদেশকে নিয়ে যে ধরনের আন্তর্জাতিক চক্রান্ত শুরু হয়েছিল এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে ধরনের নেতিবাচক কথাবার্তা বলা হচ্ছিলো, যে দেশে স্বাধীনতার ৪ বছরের মাথায় জাতির জনককে সপরিবারে খুন করা হলো, যে দেশে একটা বড় সময়ই সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল এবং রাজনৈতিক সহিংসতা  অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সেই দুর্যোগপ্রবণ দেশটি ১৭ কোটি মানুষের বিশাল চাপ মাথায় নিয়েও স্বাধীনতার অর্ধশতকের আগেই উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হওয়ার যে যোগ্যতা অর্জন করলো, সেটি একটি বিশাল ঘটনা নিঃসন্দেহে। যদিও এই উদযাপনটি হচ্ছে সরকারের আয়োজনে একতরফা। সংসদের বাইরে থাকা সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি এই সাফল্যকে সাফল্য বলে মানতে নারাজ। অথচ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের এই ঘটনাটি একদিনে বা কোনো একটি সরকারের আমলে হয়নি। বরং নানা প্রতিকূলতা আর অসন্তোষের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি তারই প্রমাণ। এখানে বিএনপি বা বিরোধী পক্ষেরও উচিত ছিল এই উদযাপনে শামিল হওয়া। তারা বলতে পারত, বাংলাদেশের এই সাফল্যের ভাগীদার তারাও। কিন্তু তারা সেটি বলেনি। বলেনি বলেই এই কৃতিত্বটা এককভাবে আওয়ামী লীগের ঘরেই চলে গেছে। বিএনপি কেন এই সাফল্য মানতে চায় না? এর বড় কারণ প্রতিহিংসা এবং ঈর্ষা।

বাংলাদেশকে নিয়ে ঈর্ষা করাই যায়। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া দেশটিতে এখন কেউ না খেয়ে মারা যায় না বরং খাদ্যপণ্য বিদেশে রফতানি করে। সুতরাং কয়েকটি ইনডেক্স বা সূচকের ছাঁচে ফেলে এটি বলে দেয়ার সুযোগ নেই যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই। বরং গণতন্ত্রের যে যাত্রা ১৯৯১ সালে শুরু হয়েছে, সেটি ধীরগতিতে হলেও চলছে। মাঝেমধ্যে ধাক্কা খাচ্ছে এটা ঠিক। ফলে এই ধাক্কাটি যাতে কমিয়ে আনা যায়,গাড়ি চলার পথটি যাতে মসৃণ হয়, খান্দাখন্দ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা যায়, সেটিই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিঃসন্দেহে বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, সুশাসন এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। এটি নিশ্চিত করা গেলে জার্মানির কোন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বললো সেটি আমলে না নিলেও চলবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন; তাতে কিছু যায় আসেনি। বরং তাদের উত্তরসূরিরাই এখন বাংলাদেশকে ‘এশিয়ান ইমার্জিং টাইগার’ বলে মনে করেন।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচের ভেন্যু চূড়ান্ত
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচের ভেন্যু চূড়ান্ত
ফিরলেন ১৭৩ বাংলাদেশি, মিয়ানমারে ফেরত যাবেন ২৮৮ জন
ফিরলেন ১৭৩ বাংলাদেশি, মিয়ানমারে ফেরত যাবেন ২৮৮ জন
দক্ষ বিচার বিভাগ গঠনে বিশ্বমানের জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি প্রয়োজন: আইনমন্ত্রী
দক্ষ বিচার বিভাগ গঠনে বিশ্বমানের জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি প্রয়োজন: আইনমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ