X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নশীল গণতন্ত্র চাই

প্রভাষ আমিন
২৯ মার্চ ২০১৮, ১৬:০৮আপডেট : ২৯ মার্চ ২০১৮, ১৬:১১

প্রভাষ আমিন গত সপ্তাহে বাংলা ট্রিবিউনে ‘বাংলাদেশের প্রমোশন: বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের উপহার’ শিরোনামের লেখা শেষ করেছিলোম ‘থ্রি চিয়ার্স ফর বাংলাদেশ’ বলে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে যাত্রা শুরুর প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য যে তিনটি সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়; মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা; তার সবক’টিতেই বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে থেকেই উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা শুরু করেছে। বাংলাদেশের এই বড় অর্জনের ঘোষণাটি এসেছে ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। ঠিক তার এক সপ্তাহ পর আরেকটি ছোট খবর সেই অর্জনকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে। জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বার্টেলসম্যান স্টিফটাংয়ের একটি জরিপ প্রতিবেদন নিয়ে এখন তোলপাড় বাংলাদেশের রাজনীতিতে।

এবারই প্রথম নয়, প্রায়ই আমরা বিভিন্ন খ্যাত-অখ্যাত বিদেশি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে হইচই করি। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধামত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন ব্যবহার করে। জার্মান প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এটা ঠিক, বিদেশি কোনও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে নিয়ে ইতিবাচক কিছু লিখলে আমাদের মন ভালো হয়ে যায়, নেতিবাচক কিছু লিখলে মন খারাপ হয়। তবে নেতিবাচক কিছু লিখলে মন খারাপের সঙ্গে ক্ষোভও হয়। বিদেশি কিছু নিয়ে হইচই করা আমাদের পুরনো হীনম্মন্যতা। বিদেশি কূটনীতিকরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যতটা নাক গলায়, বিশ্বের অন্য কোনও দেশেই সম্ভবত এতটা হয় না। তারা এই নাক গলানোর সুযোগ পায় আমাদের কারণেই। সম্ভবত আমাদের রাজনীতিবিদদের নিজেদের সামর্থ্যের ওপর আস্থা কম। তাই তারা বিদেশিদের কাছে ধরনা দেন। নিজেরা ঝগড়াঝাটি যাই করি, অন্য কেউ নাক গলাতে এলেই মন খারাপ হয়। কেউ কেউ বলতে পারেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতার কথা ঘোষণা করায় আপনারা এত উদযাপন করলেন, আর এখন যখন বার্টেলসম্যান স্টিফটাং বাংলাদেশকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশ বলছে; তখন নানা ত্যানা পেঁচানো শুরু করেছেন। অভিযোগ মাথা পেতে নিয়েও বলছি, জাতিসংঘ আর বার্টেলসম্যান স্টিফটাং এক নয়। বার্টেলসম্যান স্টিফটাং-এর বিশ্বাসযোগ্যতা পরীক্ষিত নয়। তবে আমি তাদের প্রতিবেদন অস্বীকার করছি না। বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্রের মান কমে যাওয়ার প্রবণতা সত্যি। বাংলাদেশকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় ফেলাকেও আমি অস্বীকার করছি না। আসলে প্রশ্নটা স্বীকার-অস্বীকারের নয়। আমি আসলে জার্মান প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন নিয়ে প্রথমে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কোনও কোনও অনলাইনে শিরোনাম ছিল, বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ৫ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের একটি। এই শিরোনামটি আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তবে বিস্তারিত পড়ে জানলাম, ব্যাপারটি ঠিক এমন নয়। বার্টেলসম্যান স্টিফটাংয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে মোট ১৩টি দেশে গণতন্ত্রের মান নেমে গেছে। তবে এই ১৩টি দেশের মধ্যে ৫টি দেশ গণতন্ত্রের ন্যূনতম বৈশিষ্ট্যও ধারণ করে না। তাই এই ৫টি দেশকে গণতান্ত্রিক থেকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় নতুন অন্তর্ভুক্ত এই ৫টি দেশের একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশসহ মোট ৫৮টি দেশ আছে এই তালিকায়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত বিশ্বের ১২৯টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ৭১টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

জার্মান প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সরকারি দলের নেতারা। তারা বলছেন, গবেষণা প্রতিবেদনটি তথ্যভিত্তিক নয় এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কেউ কেউ বলছেন, হিটলারের দেশ জার্মানির কাছ থেকে তারা গণতন্ত্র শিখতে চান না। জার্মান প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। প্রতিবেদনটির গবেষণা নিয়ে পাল্টা গবেষণা হতে পারে। কিন্তু আমি প্রতিবেদনটি অবিশ্বাস করিনি। সরকারি দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গেও আমি একমত নই। হিটলার জার্মান বটে, তবে এখনকার জার্মানি তার আদর্শে চলে না। বরং এখনকার জার্মানি গোটা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে। তবে জার্মান বলেই যে বার্টেলসম্যান স্টিফটাং মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হবে এসন কোনও কথা নেই। বাংলাদেশের সব গবেষণা প্রতিষ্ঠানই তো আর সিপিডি মানের নয়। একটা বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশ বলেছে, এটা অবশ্যই লজ্জার। কিন্তু আমার লজ্জায় তো আর বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক হয়ে যাবে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ছিল না, গণতন্ত্রের মানসম্মত ছিল না; এটা তো অস্বীকার করার জো নেই। যে নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায়, সে নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ হলেও নৈতিকতার মান উৎরাতে পারে না। সেই নির্বাচনের ধারাবাহিক প্রভাবেই গণতান্ত্রিক সূচকে বাংলাদেশের অবনমন ঘটেছে। তাই জার্মান প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সেই নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে কমেছে গণতান্ত্রিক স্পেস। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ করার অধিকার সরকারের ইচ্ছাধীন হয়েছে। স্বৈরাচার এরশাদ তার অবৈধ ক্ষমতা দখলের দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি পায়। আর পরপর তিনবার আবেদন করেও চেয়ারপারসনকে কারাগারে নেওয়ার প্রতিবাদে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা অন্য কোথাও সমাবেশ করার অনুমতি পায় না অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপি। বিরোধী দলের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন, একের পর এক গুম, খুন; দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে অস্বস্তিকর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতাও নিরঙ্কুশ নয়। প্রশ্ন আছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়েও। বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে এস কে সিনহার নজিরবিহীন বিদায় অস্বস্তি তৈরি করেছে বিচারাঙ্গনে। তাই জার্মান প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে না দিয়ে সরকারি দলের নেতাদের উচিত নিজেদের দেশের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর দিকে নজর দেওয়া। আপনি যখন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারবেন, তালিকা এমনিতেই বদলে যাবে। শুধু কথায় যেমন আপনি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল হতে পারবেন না, তেমনি শুধু কথায় আর প্রতিবাদে স্বৈরতন্ত্রের তকমার লজ্জাও এড়াতে পারবেন না।

গণতন্ত্রের মান কমেছে এটা যেমন সত্যি, উন্নয়নের মান বেড়েছে এটাও তেমন সত্যি। গত ৯ বছরে দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বিশ্বের সবাই এক সুরে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করছেন। কারো কারো কাছে বাংলাদেশ রোল মডেল, উন্নয়নের বিস্ময়। জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, সামাজিক সূচকে অভাবনীয় অর্জন আছে। তেমনি বৈষম্য বেড়েছে প্রকটভাবে। গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে বটে। তবে গরিব আরো গরিব হয়েছে। ধনী আরো ধনী হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা, আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বড় প্রমাণ। আবার শেয়ারবাজার, ব্যাংক খাতে লুটপাট; সুশাসনের অভাবকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই শেষ কথা নয়। অর্থ দিয়ে সবসময় সবকিছু মাপা যায় না। কোয়ানটিটি বিবেচনায় উন্নয়ন অনেক হয়েছে। এখন সময় এসেছে কোয়ালিটি বিবেচনার। মানুষের জীবনমান উন্নয়নের। সবার আগে চাই দু’বেলা দু’মুঠো ভাত। সেটা নিশ্চিত হলেই কিন্তু তরকারির মান নিয়ে প্রশ্ন আসবে, চাহিদা বাড়বে। তেমনি উন্নয়ন নিশ্চিত হলেই আমি মানের প্রশ্নটি তুলবো। খালি পেট ভরা থাকলেই মানুষ সুখী হয় না। তাহলে পৃথিবীর সব ধনী মানুষ সুখী হতো, সব গরিব অসুখী হতো। কিন্তু পৃথিবীর সব ধনী যেমন সুখী নয়, তেমনি সব গরিবও অসুখী নয়। প্রাণীরা খেতে পেলেই সন্তুষ্ট। কিন্তু মানুষের আরো অনেক কিছু চাই। পেট খালি থাকলে তার খাবার চাই। কিন্তু পেটে খাবার পড়লেই তার চাহিদা বাড়তে থাকে। তার চাই গণতন্ত্র, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অধিকার। তার চাই মত প্রকাশের অধিকার, সভা-সমাবেশ করার অধিকার। তার চাই ন্যায় বিচার, আইনের আশ্রয় ও সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার।

তাই উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করায় আমরা যেমন উদযাপন করবো, তেমনি স্বৈরতন্ত্রের তকমায় লজ্জিতও হবো। এখন আমাদের এই লজ্জা ঘোচানোর উদ্যোগ নিতে হবে আমাদেরই। সবচেয়ে ভালো উপায় হলো আলোচনার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু নির্বাচন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে-সঙ্গে যখন গণতন্ত্রও উন্নয়নশীল হবে, তখনই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে সত্যিকারের মর্যাদার আসনে আসীন হতে পারবে। উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের ভারসাম্যটা জরুরি।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির আহ্বান ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির আহ্বান ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
ইসরায়েল থেকে বিমান আসা ও কেএনএফ নিয়ে যা বললো বিএনপি
স্থায়ী কমিটির প্রেস বিজ্ঞপ্তিইসরায়েল থেকে বিমান আসা ও কেএনএফ নিয়ে যা বললো বিএনপি
‘বিএনপি বিরোধিতা করলেও তাদের অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে’
‘বিএনপি বিরোধিতা করলেও তাদের অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে’
পেনাল্টি নিয়ে বিবাদ, চেলসি কোচ যা বললেন
পেনাল্টি নিয়ে বিবাদ, চেলসি কোচ যা বললেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ