X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

সাবধান, ধর্ষক আপনার পাশেই ঘুরছে

রাশেদা রওনক খান
৩০ মার্চ ২০১৮, ১২:৪৯আপডেট : ৩১ মার্চ ২০১৮, ১৩:৫৬

রাশেদা রওনক খান বাংলাদেশে এখন ধর্ষণের ঘটনা নিত্যদিনের মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামে ১ বছর ১০ মাস বয়সী বাচ্চাও যখন ধর্ষণের শিকার হয়, বিউটিরা বিচার চাইতে গিয়ে বারবার ধর্ষণের শিকার হয় এবং তাদের মৃত্যু ঘটে, তাতেও আমাদের বিবেক জেগে উঠে না,আমরা বিমর্ষ হই না, উত্তেজিত হই না। কিন্তু আমরা সাকিব-তামিম-মাশরাফি একদিন ভালো না খেললে তাদের কাছে পেলে মাথা ফাটিয়ে দেয়ার মতো রাগ আমাদের পেয়ে বসে, অথচ সেটা কেবল একটা খেলাই, এর বেশি কিছু নয়!
খেলা, বিনোদন, রাজনীতি-সকল ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা চোখে পড়ার মতো হলেও ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে আমরা যেন খুব উদাসীন! এই মুহূর্তে কর্পোরেট দুনিয়ার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মান দল নিয়ে চলছে মাতামাতি, সারা বছর ব্যস্ত থাকি হলিউড-বলিউড-স্টারপ্লাস-স্টারজলসা নিয়ে কিংবা আমাদের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চর্চা আছে কি নেই, তা নিয়ে। কিন্তু এই সমাজে একটা মেয়ের জীবনে চলার পথে গণতান্ত্রিক অধিকার কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে কথা বলি না, পাছে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য আমাদের কমে যায়! ঘরে-বাইরে পুরুষ তার নিজের আধিপত্য রক্ষায় খুব কৌশলী বটে! ফলে নারীর প্রতি যেকোনও পর্যায়ের অমানবিক কোনো ঘটনা ঘটুক না কেন, কিছু মানুষ বাদে বাকিদের যেন ঘটনাগুলো স্পর্শ করে না, ব্যথিতও করেই না, উত্তেজিত হওয়া বা আন্দোলন করা তো দূরের কথা।

আমরা আমাদের সমস্ত মূল্যবোধ-চেতনা-ভাবনাসমূহ পুঁজিবাদের কাছে সঁপে দিয়েছি নির্বিকারে। তাই আমরা সহজেই মেনে নিই এক বছরের বাচ্চাকে ধর্ষণের খবরটি, একটুও যেন আন্দোলিত হই না! তাই বলে আমাদের যে আবেগ নেই তা কিন্তু নয়, বরং অনেক আবেগ আমাদের এবং আপ্লুতও হই, যখন কেউ বলে, পোশাকের সাথে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই! হায়রে ধর্ম, হায়রে সমাজ চেতনা, হায়রে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি! এই তিনের গুণে আমরা ডুর্খেইম-এর 'সামষ্টিক সংহতি' র মতো করে 'কালেকটিভ আইডেনটিটি' বা 'সামষ্টিক পরিচিতি' র রাজনীতি করি। যদিও এর মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানীরা 'সামাজিক অন্দোলন'-এর কথা বলেছেন, আর আমি বলবো, এই 'সামষ্টিক সংহতি' দিয়ে সামাজিক আন্দোলনকে নীরব রাখা যায়, যা এই ক্ষেত্রে ঘটছে! উদাহরণ হিসেবে একটা ঘটনা বলি, আমরা খুব নীরবে পত্রিকায় (একটি সহযোগী দৈনিক, ৫ এপ্রিল) পড়ে যাই যে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার দারুল তালিম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও কাচারীপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মুফতি মতিউর (৫০) তার মাদ্রাসার এক ছাত্রকে ধর্ষণ করার খবর, কিন্তু এই নিয়ে আন্দোলন তো দূরের কথা, দুটা বাক্য ব্যয় করি না পাছে ধর্মের অমর্যাদা হয়ে যায়! এ ধরনের নীরবতাকে আমি বলি, 'ধর্মের জন্য সামষ্টিক নীরবতা', তাতে লিঙ্গীয় সমতার বিষয়টি ঢাকা পড়ে গেলেই মঙ্গল।

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র-এর বিভিন্ন মতাদর্শ কীভাবে দিনে দিনে নারীকে ভোগ্যপণ্য করে তুললো, নারীকে অবহেলিত ও নিপীড়িত হতে বৈধতা দেয়, সেই আলোচনা বহুবার করেছি। রাষ্ট্র তার নানা সমস্যা সমাধানের জন্য বলপ্রয়োগ বা প্রচণ্ডতাকে কীভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকে, সেই বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছি বহু। সামাজিক প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের অভাব রেপসহ সব ধরনের অপরাধের জন্য দায়ী, তাও বারবার উচ্চারিত বাক্য! নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রাষ্ট্র ব্যর্থ, সমাজ ব্যর্থ, তাই এখন একমাত্র ভরসা পরিবার! তাই ফিরছি পরিবারের কাছেই, বিশেষ করে মায়ের কাছে, যিনি আমৃত্যু চেষ্টা করেন তার কলিজার ধন সন্তানকে, আগলে রাখেন সকল অপশক্তি হতে !

আজ তাই একটু ভিন্ন দিকে আলোচনা করতে চাই, তা হলো আমাদের মায়েদের সচেতনতা বৃদ্ধি বিষয়ে।

এক বছর দশ মাস বয়সী শিশুটির মায়ের কথাগুলো পড়েই মনে হলো, আমাদের মায়েরা এখনো কেন এতটা সরল মনে সবাইকে বিশ্বাস করেন? কেন এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তবুও সচেতন হচ্ছেন না? এ ধরনের সচেতনতার অভাব যে কেবল গ্রামের মায়েদের থাকে তা কিন্তু নয়, সেটা সমাজের সর্বোচ্চ ধনী পরিবারের মায়ের ক্ষেত্রেও না থাকতে পারে। তাই কন্যাশিশু নিপীড়ন-ধর্ষণ সবক্ষেত্রেই (শ্রেণি-ধর্ম-স্থান-কাল-পাত্রভেদে) দেখতে পাই।

এক বছর ১০ মাস বয়সী শিশুটির মা মামলার বাদী পারভিন আক্তার বলেন, “গত ৭ ফেব্রুয়ারি আমার স্বামীকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরে ঘরে প্রবেশের পূর্বে আসামি মো. শাকিব আমার কোল থেকে আদর করার কথা বলে শিশুকে নিয়ে যায়। প্রায় আধঘণ্টা পর্যন্ত শিশুকে খুঁজে না পাওয়ায় আমরা খুঁজতে বের হই। পরে বাড়ির পাশের খালপাড়ে কালভার্টের উত্তর পাশে শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পাই। সেখানে গিয়ে দেখি শাকিব শিশুর মুখ চেপে ধরেছে এবং তার যোনি ও পায়ুপথ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তখন আমি ‘আমার বাচ্চাকে কি করেছিস’ জিজ্ঞেস করলে অপর দুই আসামিও উপস্থিত হয়ে শিশুর চিকিৎসা না করা ও আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ার হুমকি দেয়। কাউকে বললে আমার স্বামীকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। পরে আমরা শিশুকে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করে ১১ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি যাই।” (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)।

লক্ষ করি, মা যেখানে শিশুটিকে ধর্ষক শাকিবের হাতে নিরাপদ ভাবছেন, সেখানেই কত বড় বিপদ লুকিয়ে আছে! অনেকেই আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলতে পারেন কেন আমি কেবল মায়ের কথা বলছি। আমি মায়েদের বিষয়টি এ কারণে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, শিশু কিংবা কিশোরীরা বাবার চেয়ে মায়ের কাছে বেশি থাকেন।

মায়েদের জন্য বলতে চাই, আপনার আশপাশেই ধর্ষক ঘুরাফেরা করছে। শুনতে খারাপ শুনালেও এটাই সত্যি, মা! ধর্ষক যে কে বা কারা, তা আমাদের বুঝে উঠতে সময় লাগবে। কারণ, এখনো একজন কি কি কারণে ধর্ষক হয়ে উঠে, তা নিয়ে নিরন্তর নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে চলছেন। সেখানে আপনার-আমার বুঝা একটু কঠিনই হবে, এটা খুব স্বাভাবিক। আসুন তাহলে দেখি এযাবৎ ধর্ষণের কি কি কারণ পাওয়া গেল, যার কারণে আমাদের আশপাশের ঘনিষ্ঠ মানুষজনই হয়ে উঠেছে ধর্ষক।

১। আপনার আশপাশে আপনার আত্মীয় বা প্রতিবেশীদের মাঝেই এমন কিছু মানুষ আছে, যারা অপরাধী মানসিকতার!তারা খুব সহজে, বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকার কারণে নির্দ্বিধায় আপনার ছোট্ট শিশুকে ধর্ষণসহ যেকোনও অপরাধ করতে পারে এবং করে থাকে তার সব বা কিছুই হয়তো আপনি জানেন না! মনে রাখতে হবে, আপনার সন্তান আপনার কাছে শিশু বা কিশোরী হলেও তার কাছে কেবলই ভোগ্যপণ্য, কেবল একটি থলথলে মাংসপিণ্ড, যাকে ভোগেই শান্তি!

২। আপনার বোনের ছেলে কিংবা চাচাতো ভাই বা মামা-চাচা যেই হোক, তিনি পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ব্যক্তি হতে পারেন, যা আপনার কল্পনাতেও নেই। তাদের মাঝে অনেকেই মেয়েদের সঙ্গে জবরদস্তিমূলক যৌন সম্ভোগে মেয়েদের কীভাবে ভোগ করতে হয়, এবং এসব জবরদস্তিমূলক যৌন সম্ভোগে মেয়েদের প্রতিবাদ থাকে না, এ ধরনের পর্নোচিত্র দেখে কেউ কেউ নিজেই এই ধরনের কাজে উৎসাহিত বোধ করে। তখন আপনার শিশুকন্যাটিকে বেছে নেয় আপনার সরলতার সুযোগ নিয়ে।

৩। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষরা বিয়ের আগে সেক্স করতে পারে না সমাজের বিধিনিষেধের কারণে। পতিতালয় থাকলেও যেতে পারছে না নানা ট্যাবুর কারণে , হয়তো সেখানে যাওয়ার মানসিকতা, সুযোগ, সামর্থ্য সবার থাকে না। কিন্তু শরীরের চাহিদাটা থেকে যায় খুব ভালোভাবেই। ফলে তারা সুযোগ খোঁজে নিকট কোনো আত্মীয়, যার বা যাদের বাসায় তাদের অবাধ যাতায়াত বা মেলামেশার সুযোগ থাকে। তারা আপনার একটু অনুপস্থিতে যেকোনও সময় আপনার মেয়ে এমনকি শিশুকে একা পেলে রেপ করে, যা এখন আমরা প্রকটভাবে দেখতে পাচ্ছি।

৪। আপনার আশপাশে এমন অনেক মানুষ আছে যারা ভেতরে ভেতরে এক ধরনের একাকিত্ব বোধ কিংবা অক্ষমতাবোধের মধ্য দিয়ে রাতদিন কাটায়, হয়তো আপনি সেটা দেখতে পাচ্ছেন না। একজন ব্যক্তির ব্যক্তিজীবনের অনেক রাগ, অপমানজনক অনুভূতি, দাম্পত্য জীবনে অসুখী হওয়ার হতাশা, নিজস্ব ব্যর্থতা বা কষ্ট, অপ্রাপ্তি এসব কিছু থাকতে পারে, যা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির ভেতরে ধর্ষণের মনোবৃত্তি তৈরিতে সহায়ক, আর তার সাথে দৈনন্দিন জীবনের চলাফেরায় আপনার অসচেতনতা তাকে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করে রেপ করতে।

৫। আপনার আত্মীয়স্বজনের মাঝেই সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী লোকজন থাকতে পারে, যার কাছে আপনি খুব সহজেই বিশ্বাস করে বাচ্চা দিয়ে যাচ্ছেন। যে কাজটি এই ১ বছর ১০ মাস বয়সী বাচ্চাটির মা পারভিন আক্তার করেছেন। আপনার কাছে মনে হতে পারে, ও তো শিশু, একদম দুধ খায়, এত ছোট শিশু, ওকে কি করবে? আপনি হয়তো জানেনই না, যার কাছে শিশুটিকে দিয়েছেন, তার মধ্যে কাম প্রবৃত্তি বা অন্যকে নির্যাতন করে যৌনসুখ লাভের মানসিকতা আছে, যা তাকে শিশুর যোনিপথকে রক্তাক্ত করতেই আনন্দ দেয়। এতেই বিকৃত পশুটি যৌনসুখ লাভ করে।

৬। আপনার কোনো পুরুষ নিকট আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশী খুব বেশি ঘন ঘন আপনার বাচ্চাটির কাছে আসার প্রবণতা দেখলে সাবধান হতে হবে। এই ধরনের লোকেরা ধারাবাহিকভাবে একটি শিশুকে আপনার অগোচরে নানাভাবে শারীরিক নিপীড়ন করে। ধারাবাহিক রেপ এভাবেই বেশি হয়। এক্ষেত্রে একটু নিরাপদ দূরত্বে থেকে লক্ষ করুন আপনার শিশুর দেহে তার স্পর্শ কতটা নিরাপদ।

৭। খুব সাবধান থাকতে হবে মাদকাসক্ত কোনো আত্মীয় বা পরিচিতজনের কাছ থেকে। আপনি হয়তো জানেনও না যে আপনার আত্মীয় মাদকসক্ত, সেক্ষেত্রে অনেক বড় বিপদ হতে পারে। বিশেষ করে, ইয়াবা সেবক আজকাল তরুণদের ভেতরে এতটাই প্রবল এবং স্বাভাবিক যে আপনি টেরই পাবেন না সেই লোকটি ইয়াবা সেবন করে। তাই সবসময় লক্ষ রাখুন আপনার শিশু বা কন্যার সাথে মেলামেশা করে এমন কেউ মাদকাসক্ত কিনা। মনে রাখবেন, মাদকাসক্তি মানুষের স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ লোপ করে। তাই মাদকাসক্ত যদি আপন মামা-চাচাও হয়,এমনকি বাবা হলেও তাদের থেকে সন্তানকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন। গত ২৮ মার্চ আমরা দেখলাম, রশিদপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম তার পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিশুকন্যাকে ৭/৮ দিন নিজ ঘরে ধর্ষণ করে এবং এতে একপর্যায়ে শিশুটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে (সময় নিউজ টিভি, ২৮ মার্চ)। আমরা জানি না রবিউল ইসলাম মাদকাসক্ত কিনা, কিন্তু মাদকাসক্ত পারিবারিক পরিসরে ধর্ষণের একটি কারণ।

৮। ধর্ষকদের মনে মেয়েদের প্রতি তীব্র অশ্রদ্ধা, ক্রোধ, আক্রমণাত্মক মনোভাব ও প্রতিহিংসা পরায়ণতা (যার কারণ হতে পারে অতীতে কোনো মেয়ে দ্বারা প্রতারিত, অপমানিত, প্রত্যাখ্যান হওয়া অথবা তার জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা) থাকলে তারা কোনো মেয়ে সুবিধামতো পেলেই রেপ করে বা করতে চেষ্টা করে ।

অতএব, এই ধরনের কোনো ব্যক্তি আপনার চারপাশে থাকলে তাদের থেকে মেয়েকে সাবধানে রাখতে হবে।

৯। সমাজে কিংবা পরিবারে এমন অনেকেই আছে যারা কোনো মেয়ে প্রেমে বা বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে রাজি না হলে মেয়েটির 'না' বলাকে সহ্য করতে না পেরে রেপ করে। তাই মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে, এমন ছেলে সম্পর্কে মেয়ের সাথে খোলামেলা আলাপ করুন। মেয়ের চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করুন। হয়তো আপনার চোখে সেই ছেলেটি 'ভালো ছেলে', কিন্তু আপনার মেয়ে ছেলেটির এই রূপটি দেখে ফেলেছে, তাই সহ্য করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে মেয়েটিকে সরে আসতে সাহায্য করুন।

১০। কখনো কখনো বন্ধুবান্ধবরা ফ্যান্টাসি হিসেবে একসঙ্গে হয়ে বা খুব পরিকল্পিতভাবে সাজানো পরিবেশে এনে কোনও মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য রেপ করে, যেমনটি ঘটেছিলো আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলের ক্ষেত্রে। অতএব, মেয়ের বন্ধু-বান্ধব কারা, সেটি খুব সচেতনতার সাথে লক্ষ রাখতে হবে। বিশেষ করে, কোনও অনুষ্ঠানে যাচ্ছে কিংবা দূরে কোথাও যাবে শুনলেই একটু খবর নিতে হবে বা সাথে যেতে হবে, অন্তত পৌঁছে দেয়া জরুরি। তাতে যারা পরিকল্পনা ফাঁদে, তারা একটু হলেও ভয়ে থাকে যে অভিভাবক জানেন কার সাথে কোথায় মেয়েটি আছে। স্পাইং বা কড়া শাসন করা যাবে না এক্ষেত্রে, খুব কৌশলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মেয়ের সাথে চলাফেরা করে সকল বন্ধুবান্ধবদের আদ্যোপান্ত জানতে হবে।

১১। হুজুরদের (এমনকি হাফেজদের) দ্বারাও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের রেপড হওয়ার ঘটনা প্রায়ই আমরা পত্রিকার পাতায় দেখতে পাচ্ছি। এই প্রবণতা আগেও ছিল, কিন্তু গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে এখন সব প্রকাশ পাচ্ছে। মাদ্রাসা বা এতিমখানার কোমলমতি অসহায় শিশুগুলোর ওপর বর্বর নির্যাতন করলেও হুজুরদের বিরুদ্ধে সহজে কেউ মুখ খোলে না বলে তারা এসব জঘন্য অপরাধ করতেই থাকে। তাছাড়া আমাদের সমাজের বাবা-মায়েরা এতটাই সহজ-সরল ও ধর্মভীরু, হুজুর দ্বারা রেপড বা নিপীড়িত হলেও ধর্মের দোহাইয়ের কাছে তারা নীরব থাকে। এটাকে ' ধর্ম-এর স্বার্থে 'সামষ্টিক নীরবতা' পালন বলা যেতে পারে কিংবা এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ' সামাজিক চাপ'-এর মুখে নীরব থাকার প্রবণতা খুব লক্ষণীয়।

১২। আজকাল মাদ্রাসায় হুজুরদের (সবাই নয়, যারা নিপীড়ক-ধর্ষক মনোবৃত্তির) দ্বারা শিশু (ছেলে/মেয়ে নির্বিশেষে) নিপীড়নের ঘটনা ক্রমশই বেড়ে চলছে। সেদিন দেখলাম, দিনাজপুরে কাহারোলে সাড়ে ৪ বছরের মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টায় নশিপুর গম গবেষণা কেন্দ্রের মসজিদের পেশ ইমাম মো. সাখাওয়াত হোসেনকে (৪২) গ্রেফতার করেছে থানা পুলিশ (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ আগস্ট, ২০১৭)। কিন্তু আমাদের বাবা-মায়েরা তারপরও সরল বিশ্বাসে এসব নিপীড়কের হাতে শিশু তুলে দিয়ে আসেন বেহেশত লাভের আশায়। মনে রাখতে হবে, তাদের দাম্পত্য জীবনের যৌন অতৃপ্তি কখনো কখনো আপনার শিশুর রেপের কারণ হতে পারে। হুজুর হলেই যে তার যৌন আকাঙ্খা থাকবেনা, তা নয়। তাছাড়া মাদ্রাসা বা এতিমখানার বদ্ধ আবাসিক পরিবেশ, অনেকদিন পরিবার থেকে দূরে থাকা, অভিভাবকদের অসহায়ত্ব ও হুজুরদের প্রতি তীব্র আনুগত্য কোনো কোনো পিশাচ হুজুরদের সাহস বাড়ায়, যা তাদের এই ধরনের অপকর্ম করতে সাহসী করে তুলে। মানুষ মাত্রই যেকোনও অনুশাসন ভাঙতে চায় সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে। এক্ষেত্রেও দীর্ঘসময় ধরে ধর্মীয় অনুশাসন মানতে মানতে ক্লান্ত কেউ কেউ অনুশাসন ভাঙার ইচ্ছা থেকেই শিশুদের ধর্ষণ বা মোলেস্টেশন করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বিভিন্ন মুসলিম দেশের, বিশেষ করে সৌদি আরবের মানুষদের জীবনপ্রণালি অনুকরণ করি এবং আমরা সবাই জানি যে তারা বহুগামী এবং যৌন জীবনে বেশ অসংযমী, যা আমাদের হুজুরদের কাউকে কাউকে বেশ প্রভাবিত করছে। মনে রাখতে হবে, আমরা বাংলাদেশের মানুষ, সৌদি আরব নয় এটা।

১৩। বাড়িতে ছেলে বা পুরুষ হাউজ এইড বা দারোয়ান বা ড্রাইভার থাকলে, তাদের সাথে সন্তানদের (ছেলে/মেয়ে শিশু) বা কিশোর-কিশোরীদের আচরণ খেয়াল রাখতে হবে। শাজনীন হত্যাকাণ্ডের কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে, যে কিনা বাড়ির কাজের ছেলে দ্বারা রেপড হয়েছিল এবং তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

১৪। ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রেও মায়েদের সাবধানতা জরুরি। ছেলেদের আমরা সহজেই মাদ্রাসায় কিংবা ঘরে পুরুষ হুজুর রেখে কোরআন শেখাই। খুবই ভালো উদ্যোগ, কিন্তু মনে রাখতে হবে আপনার অসচেতনতা আপনার ছেলেকে চিরদিনের জন্য নিস্পৃহ করে তুলতে পারে। ধর্মীয় বাধার কারণে হুজুররা সহজে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে না, পতিতালয়ে যেতে পারে না, প্রকাশ্যে প্রেম করতে পারে না। ফলে তাদের অবদমিত যৌন চাহিদার কারণে কখনো কখনো তারা হাতের কাছে পেয়ে যাওয়া ছেলেদের রেপ করে। এটা পুরুষ গৃহশিক্ষকের বেলায়ও প্রযোজ্য।

১৫। অতিরিক্ত শাসন করে ছেলেমেয়েকে আমরা অনেক সময়ই খুব ভয়ে ভয়ে নিরীহ সুবোধ বালক-বালিকা হিসেবে তৈরি করতে পছন্দ করি। অসহায় শিশুগুলোর ওপর জুলুম করা কিন্তু সহজ। কারণ, এরা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক দিক থেকে দুর্বল। তাই ভয় দেখিয়ে বা জোর করে এদের রেপ করা যায়। তাই সন্তানকে ছেলে কিংবা মেয়ে, আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে গড়ে গড়ে তুলতে হবে। এবং সারা দিনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে শোনার মতো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যার জন্য বাবা-মায়ের যাতে সন্তানের জন্য একটু বেশি সময় প্রয়োজন, যার অভাব আজকার দিনে সবচেয়ে বেশি!

১৬। ঘরে যদি স্পেশাল চাইল্ড থাকে, তাকে অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে। এক্ষেত্রে কাজটি খুব কঠিন মায়েদের জন্য। কারণ, মায়েরা এমনিতেই এক ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক পীড়নের মাঝে থাকেন এই সন্তানের জন্য। তাছাড়া অন্য ছেলেমেয়েদের দিকে মনোযোগ বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। ফলে দুদিক সামলাতে সামলাতে মা হাঁপিয়ে ওঠেন। এই ফাঁকে সুযোগসন্ধানী আত্মীয় বা প্রতিবেশী বিকৃত পুরুষ আপনার স্পেশাল চাইল্ড-এর ওপর নিপীড়ন, এমনকি ধর্ষণ করতে পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যত কষ্টই হোক। ধর্ষকেরা অনেক সময় এই ধরনের শিশুদের নিপীড়ন করে যৌনসুখ পাওয়ার চেষ্টা করেন। কেননা, ক্ষমতাশীল ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোনো দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় রেপের মাধ্যমে।

নারী নিপীড়ন-ধর্ষণ প্রতিরোধে রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য, কিন্তু রাষ্ট্রের আইনি প্রক্রিয়া এত জটিল ও বিলম্বিত যে এসব থেকে মুক্তি আমাদের সহজে মিলবে না। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না,আমাদের দিক থেকে অর্থাৎ পরিবারের দিক হতে যেসব সচেতনতা এসব নিপীড়ন রোধে সাহায্য করতে পারে সেগুলোর দিকে এখন আমাদের বাড়তি নজর দিতে হবে। এবং সেটা শুরু হবে মায়ের কাছ থেকেই ,যার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি তার সন্তান, এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও। নিরাপদে থাকুক আমাদের সন্তানেরা।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/টিআর/ওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ