X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ধেয়ে আসছে পানি সংকট, প্রস্তুতি কতটুকু?

মো. জাকির হোসেন
০১ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:১২আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:১৫

মো. জাকির হোসেন পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। পানির সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক গভীর। শুধু জীবন কেন, মানব সভ্যতাও গড়ে উঠেছে এই পানিকে ঘিরেই। পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর-বন্দর গড়ে উঠেছে নদী বা সমুদ্রকে কেন্দ্র করেই। ইতিহাস খুঁড়ে জানা যায়, এমনকি অতীতে কোনও কূপের আশপাশে গড়ে উঠেছিল বাজার কিংবা নগর। পানির সঙ্গে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জড়িত। তাই পানি জীবনের অস্তিত্ব তৈরির পাশাপাশি গড়ে তুলেছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও। নদীমাতৃক আমাদের এই দেশের সংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরিই হয়েছে পানিকে ঘিরে। পৃথিবীর চারভাগের তিনভাগ পানি। পানি জীবন ধারণের এক মৌলিক চাহিদা। কৃষিকাজ, শিল্প, জ্বালানিসহ মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে পানির ব্যবহারের ওপর। অথচ মিষ্টি জলের উৎস ক্রমশ ক্ষীয়মাণ। পৃথিবীর যত পানি তার প্রায় ৯৭.৫ শতাংশ পানের বা চাষের অযোগ্য সমুদ্রের লোনা পানি। মিষ্টি পানির মোট পরিমাণ আড়াই শতাংশের মতো। এই আড়াইভাগ পানির দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি পানি বরফ হয়ে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে। বাকি পানির তিন-চতুর্থাংশ ভূ-গর্ভস্থ পানি। মাত্র ০.৩ ভাগ পানি থাকে নদ-নদী, খাল-বিল পুকুর, নালা, জলাশয় ইত্যাদিতে। অতএব ,পৃথিবীর মোট পানির শতকরা একভাগেরও কম পানি পানযোগ্য। পৃথিবীতে পানির এত প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করেও ক্রমেই পানি আমাদের জন্য একটি দুর্লভ ও ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত হচ্ছে। মরক্কোতে সাহারা মরুভূমির কাছে অবস্থিত ১৩টি গ্রামে প্রায় ৪০০ মানুষের বাস। সেখানকার বাসিন্দাদের পানির জন্যে এত দূরে যেতে হয় যে প্রতিদিন এই কাজে গড়ে অন্তত তিনঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। সাধারণত নারীরাই এই কাজটি করে থাকেন। এখানে কুয়াশাকে কাজে লাগিয়ে গ্রামবাসীর জন্য পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাহাড়ের উঁচুতে স্থাপিত বিশেষ জালে কুয়াশা আটকে পানি হয়ে ঝরবে। পানি ধরার জন্য থাকবে বড় বড় পাত্র। এরপর পাইপের মাধ্যমে তা পাহাড়ের নিচে অবস্থিত গ্রামগুলোতে সরবরাহ করা হবে। ঘন কুয়াশার সময় এক বর্গমিটার জাল থেকে দিনে প্রায় ২২ লিটার পানি পাওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। যে প্রযুক্তিতে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহ করা হবে তার নাম ‘ক্লাউডফিশার’।
একদিকে পৃথিবীতে মিষ্টি জলের উৎস কমে আসছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বেড়ে চলেছে। আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেক বা দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ তীব্র পানি সংকটের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০১৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে পানি সংকটকে বৈশ্বিক হুমকির তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শরণার্থী সংকট ও সাইবার আক্রমণের ওপরে স্থান দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ২০১৮ সালের বিশ্ব পানি উন্নয়ন প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্যবহার, সংরক্ষণ ও পরিকল্পনায় পরিবর্তন না এলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫৭০ কোটি মানুষ পানি সংকটে পড়তে পারে। বর্তমানে বিশ্বের ৩৬০ কোটি মানুষ বছরে কমপক্ষে এক মাস পানির অভাবে থাকে। এই পরিমাণ মানুষ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। বর্তমানে আমাদের পৃথিবীতে সাত বিলিয়ন মানুষের বাস। আরও দুই বিলিয়ন মানুষ এই বিশাল জনস্রোতে যোগ দেবে ২০৫০ সাল নাগাদ। আর এভাবে চলতে থাকলে ৩২ বছরের মাথায় ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরও প্রায় ২০০ কোটি বেড়ে যাবে। পানিসম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির চক্রাবর্ত সুস্পষ্ট। কেউ কেউ বলছেন, বিশ্বের পানি সংকটের সমাধান করতে না পারলে পানি নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ বাধাও বিচিত্র নয়। ২০১২ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, কয়েক বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় পানি সংক চরম আকারে পৌঁছাবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে পানিযুদ্ধের আশঙ্কা না থাকলেও আগামী ২০২২ সালের পর পানির ব্যবহার নিয়ে এই যুদ্ধ হতে পারে। উজানের দেশগুলো ভাটি অঞ্চলের দেশগুলোকে পানি-বঞ্চিত করার কারণে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বুদাপেস্ট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ইকোনমিকসের অধ্যাপক লাজলো সোমলিয়ডি জানান, সরবরাহ নেই শুধু সেটাই একা সমস্যার সৃষ্টি করছে না। বিশ্বের কোনও কোনও অঞ্চলে পানির স্বল্পতা বিরাটাকার ধারণ করেছে। তিনি উদাহরণ হিসেবে উত্তর আফ্রিকা, ইসরায়েল ও জর্ডানের কথা বলেন। ইউনিসেফ বলছে, নদীমাতৃক দেশ বলে খ্যাত বাংলাদেশে জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করছে। শুধু তা-ই নয়, আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকিতে আছে প্রায় ৩ কোটি মানুষ। সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। ভূ-গর্ভস্তর থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে পানি ক্রমেই নিচে নেমে যাওয়ায় সারাদেশে ভূগর্ভস্তরের লবণ পানি সংমিশ্রণের আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠছে। ভূগর্ভ দিয়েই দক্ষিণের লবণ পানি ধীরগতিতে দেশের মূল ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। বাপা’র এক গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা শহরের পানির স্তর এখন সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে ১৭০ ফুট নিচে নেমে গেছে। রাজশাহীতেও পানির স্তর ১৮ থেকে ২৯ ফুট নিচে চলে গেছে। ফলে সাগরের লোনা পানি দক্ষিণাঞ্চল পার হয়ে এখন ঢাকা মহানগরীসহ দেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের দিকে আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মিঠা পানিভিত্তিক ইকোলজি পরিবর্তিত হয়ে লবণ পানি হয়ে যেতে পারে। ফলে বর্তমানের গাছপালা বিলীন হয়ে যাবে ও চিরচেনা শস্য বিন্যাস হারিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
গত ১৮-২৩ মার্চ ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়ায় ৬ দিনব্যাপী অষ্টম পানি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। এখানে বৈশ্বিক পানি সংকটের পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলের পানি সংকট ও তা মোকাবিলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জাপান ওয়াটার ফোরামের ব্যবস্থাপক সাই ইশিহারা পানি সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, বাংলাদেশে পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় অনেক এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে দেশটির উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। কারণ, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি বাড়ছে। তাই বাংলাদেশকে প্রকৃতিনির্ভর পানি সংকট সমাধানের দিকেই যেতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে (ডিসেম্বর-এপ্রিল) ব্যবহারের জন্য নদীর পানি ধরে রাখতে হবে। নেপালের পানি বিশেষজ্ঞ মহামায়া থাপা তার উপস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ার পানি সংকট অংশে বাংলাদেশের কথা তুলে ধরে বলেছেন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদী রয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে এবং শুষ্ক মৌসুমে এসব নদীর পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এসব নদীর পানির প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদীর পানি এভাবে কমে যেতে থাকলে দেশটিতে পানি সংকট দেখা দিতে পারে। এরই মধ্যে দেশটির অনেক নদী পানির অভাবে মরে গেছে। পানির রিচার্জ (পুনর্ভরণ) কমে যাচ্ছে। তাই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুভাষ সাঁতরা মনে করেন, খরা মৌসুমে ৪২ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশকে দিতে ভারত চুক্তিবদ্ধ, যদি ফারাক্কা ব্যারাজে ৭৫ হাজার কিউসেক পানি থাকে। কার্যত ফারাক্কা বাঁধে সেই পরিমাণ পানি থাকছে না। অন্যদিকে, শুষ্ক মৌসুমে ওই পরিমাণ পানি বাংলাদেশ না পেলে সেখানে লবণাক্ত পানির পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা জোরদার হচ্ছে। তিনি মনে করেন, উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ না বাড়লে নোনা জলে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা ধ্বংসের মুখে পড়বে।
সুপেয় পানির অন্যতম উৎস হচ্ছে নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা, জলাশয় ইত্যাদি। নদীর সঙ্গে আমাদের শত্রুতায় ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদ-নদী। ভারতের সঙ্গে ৫৪টি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ৩টি নদীসহ আমাদের মোট ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর পাশাপাশি বাংলাদেশের জলসীমায় উৎপত্তি ও সমাপ্ত হালদা ও সাংগু নদী রয়েছে। এসব নদীর সঙ্গে সংযোগকারী শাখা-প্রশাখাসহ বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে একসময় প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান ছিল। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, এসব নদীর মধ্যে উত্তরাঞ্চলে ৬৭টি, পশ্চিমাঞ্চলে ১২টি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৩২টিসহ প্রায় ১২৮টি নদ-নদী বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৭টি নদী সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেছে। আরেক পরিসংখ্যান বলছে, একাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। নদ-নদীগুলো ছিল প্রশস্ত, গভীর ও পানিতে টইটুম্বর। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-বাপা’র দেওয়া তথ্যমতে, দেশে (শীতকালে ও গ্রীষ্মকালে পানি থাকে) এমন নদীর সংখ্যা ২৩০টি এবং সরকারি হিসাবে (শুধু গ্রীষ্মকালে পানি থাকে) এমন নদীর সংখ্যা ৩২০টি। অথচ দুঃখের বিষয়, এই নদীগুলোর মধ্যে বর্তমানে ১৭টি নদী তার চরিত্র সম্পূর্ণ হারিয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরও ২৫টি নদী দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ’ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে ধ্বংস হয়ে গেছে ৫২০টি নদী। এসব নদীর সঙ্গে সংযোগকারী খাল-বিল, নালা-ডোবা, জলাশয় বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রধান বড় বড় নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, তিস্তা, খোয়াই, মনু, ফেনি, বুড়িগঙ্গা, সুরমা, কুশিয়ারা, কালনি, শীতলক্ষ্যা, বালুসহ অসংখ্য নদীর বুকে ধূ-ধূ বালুচর ও ময়লা আবর্জনার পাহাড়। নব্বইয়ের দশকে যেখানে ৮০ শতাংশ সেচের উৎস ছিল নদ-নদী, বর্তমানে কমে গিয়ে ২০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ ছিল। সেই পথ কমে গিয়ে এখন প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার পথ রয়েছে। এরমধ্যে শীত মৌসুমে মাত্র ৩ হাজার ৮শ কিলোমিটার নৌপথ সচল থাকে। যেটুকু নদ-নদী অবশিষ্ট আছে তাও দখল, দূষণের কবলে পড়ে চাষ ও পানের পানি সরবরাহে অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক, ২০১৬-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের নদীর পানি সবচেয়ে দূষিত। এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। আর নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা অববাহিকার পানি। গৃহস্থালি পানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক পানি নিরাপত্তা, নগরের পানি নিরাপত্তা, পরিবেশগত পানি নিরাপত্তা ও পানি সংক্রান্ত দুর্যোগ সহিষ্ণুতা এই পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে জাতীয় পানি নিরাপত্তা ইনডেক্স তৈরি করা হয়েছে। এই মানদণ্ডে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান (৪৬তম), ভারত (৪৫তম), বাংলাদেশ (৪৪তম)। নদী ও পরিবেশ গবেষকরা মনে করেন, অবৈধভাবে নদী দখল, দেশের সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের বিপজ্জনক ও কঠিন বর্জ্য, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, পলি মাটি, পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক, মল-মূত্রসহ সকল প্রকার আবর্জনা ফেলে নদী ভরাট ও দূষণ করা হচ্ছে। গবেষকদের মতে, প্রকৃতি নয়, মানবসৃষ্ট দূষণের কবলে পড়ে গত তিন যুগে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার নদীপথ ও সুপেয় পানির উৎস বিলীন হয়েছে। নদীতে পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। রাজধানী ঢাকার চার পাশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু এই চারটি নদী দূষণ ও নির্মম দখলের শিকার হয়ে এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ধেয়ে আসা পানি সংকট নিরসনে রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের প্রতিটি মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৪ লিটার পানি পান করে। তবে আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করি তার বেশিরভাগ অংশই খাদ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন, পশুপালন এবং কৃষি খামারের কাজ মিলিয়ে প্রতি এক কেজি গরুর মাংস উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ১৫ হাজার লিটার পানি, অপরদিকে এক কেজি গম উৎপাদনে খরচ হয় ১ হাজার ৫০০ লিটার পানি। বর্তমানে খাদ্যের যে অপচয় করা হয় তাও রোধ করতে হবে ব্যাপক হারে। এই মুহূর্তে বিশ্বে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপন্ন হয় তার ৩০ শতাংশই অপচয় হচ্ছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন জরুরি। পানি সংকট মোকাবিলার অন্যতম প্রতিকার হলো পানি সংরক্ষণ। পানি সংরক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পানি ও খাদ্যের অপচয় বন্ধ করা ও চাষাবাদে যেখানে ৮০% পানি ব্যবহার করা হয়, সেখানে পানি পরিচালন ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর দক্ষ করে তোলা। অর্থাৎ কী ধরনের শস্য ফলানো হবে, কোন অঞ্চলে ফলানো হবে, কী ধরনের সেচ পদ্ধতি বেছে নিতে হবে, ব্যবহৃত পানির পুনঃশোধন করে তা চাষের কাজে লাগানো এবং জোর দিতে হবে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার। জাপান ওয়াটার ফোরামের ব্যবস্থাপক সাই ইশিহারা কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা ও বরিশালে সুপেয় পানির সংকট সমাধানের উপায় নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, এসব এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার এবং পরিশোধনের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে সংকটের সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি সদ্য সমাপ্ত পানি সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে দু-একটি জায়গায় বৃষ্টির পানি ধরে ব্যবহার করা হলেও এ নিয়ে সচেতনতা নেই। সরকারের পক্ষ থেকেও বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ আগামী দিনে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মাধ্যমেই সুপেয় পানির সংকট সমাধান করতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিকে। নদীতে রাবার ড্যাম ও ব্যারাজের মাধ্যমেও পানি ব্যবহার করা যেতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। বিশেষ করে সেচকাজে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশ্ব 'পানি দিবস' উপলক্ষে ২৭ মার্চ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, পানিসম্পদ খাতে গত পাঁচ বছরে তাঁর সরকার ১৫০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানিনীতি ও ২০১৩ সালে বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পানি সংকট মোকাবেলায় নদীর নাব্য বাড়ানোর জন্য ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি বর্ষাকালে যে বিশাল জলরাশি আসে সেটা কীভাবে ধরে রাখা যায় সেই পরিকল্পনা প্রণয়নের ওপর জোর দেন। 
আঞ্চলিক সমাধানের মধ্যে রয়েছে অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারে ন্যায্যতা, পানি সংরক্ষণে জলাধার নির্মাণ ও পানি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ। বাংলাদেশের নদ-নদী বাঁচাতে হলে উজানের দেশকে অববাহিকার দেশ বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা দিতেই হবে। গবেষকরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ অঞ্চলের পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়ার সঙ্গে ভারতের পানি প্রত্যাহারের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক অভিন্ন নদী রয়েছে, যার পানিবণ্টন নিয়েও রয়েছে সমস্যা। গঙ্গার পানিবণ্টনে চুক্তি হলেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি অর্ধযুগ ধরে আটকে আছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে। মমতার দাবি, বাংলাদেশকে পানি দিলে তার রাজ্য পানি সংকটে পড়বে। আর যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাজ্যের অমতের কারণে কিছু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় সরকার। কাবেরি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কর্নাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যের বিবাদ নিষ্পত্তিতে অতি সম্প্রতি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের দেয়া রায় তিস্তা সমস্যার জট খুলে দিয়েছে। এই রায়ে বলা হয়েছে, একাধিক রাজ্যের ওপর প্রবহমান কোনো নদীর ওপর কোনো রাজ্যের একক মালিকানার দাবি খাটবে না। রায়ে আদালত বলেছেন, “নদী হবে জাতীয় সম্পদ। অন্য কোনো রাজ্যকে বঞ্চিত করে কোনো নদীর ওপর কোনো রাজ্য বিশেষ অধিকার দাবি করতে পারে না”। একই নীতি তিস্তার ওপর প্রয়োগ করা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি আইনগতভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
পানি সংকট মানে প্রাণের সংকট। সভ্যতা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সংকট। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খরা, মরূকরণ এবং পানির অপরিকল্পিত ব্যবহারে কোটি কোটি মানুষ হুমকির মুখে রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য পানি-সংক্রান্ত 'সবুজ নীতি' গ্রহণের পাশাপাশি সংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ