X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একটি কাটা হাত ও অনেক প্রশ্ন

রেজানুর রহমান
০৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:২৩আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৮:৪৬

রেজানুর রহমান ছবিটার দিকে তাকাতে পারছি না। ভয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে। যতবারই ছবিটার দিকে তাকাচ্ছি, ততবারই আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসছে। ছবি এত ভয়ঙ্কর হয়? দু’টি বাসের চাপায় আটকে আছে একটি হাত। একটু আগেও হাতটা এক তরুণের ছিল। এখন সেই হাত আটকে আছে দু’টি বাসের চাপায়। পরিবহন সন্ত্রাসের বলি হয়েছে হাতটি। রক্ত ঝরছে। পথচারীসহ দু’টি বাসের অসহায় যাত্রীরা ভয় আর আতঙ্কে হৈ চৈ করছিলেন। কেউ কেউ হাতবিহীন সেই অসহায় তরুণের ছবি মোবাইল ফোনে ধারণ করছিলেন। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে গগনবিদারি কান্না জুড়ে দেন সেই অসহায় তরুণ। এই সময় দুই একজন পথচারীর দয়া হয়। তারাই তাকে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান। রোগীর শারীরিক চিত্র দেখে ডাক্তার কাটা হাতের খোঁজ করেন। যারা সেই তরুণকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন, তাদেরই একজন দৌড় দেন ঘটনাস্থলের দিকে। সেখানে রাস্তার ওপর রক্তে ভেজা কাটা হাতটা পড়েছিল। সেই কাটা হাত নিয়ে আসা হয় ডাক্তারের কাছে। আশা ছিল হাতের কাটা অংশ বোধকরি জোড়া লাগানো যাবে। কিন্তু হাতটা জোড়া লাগানো যায়নি। ডাক্তার বলেছেন, যেভাবে রক্ত ঝরেছে আর হাতের উভয় অংশ থেঁতলে গেছে তাতে এই হাত জোড়া লাগানো সম্ভব নয়। তার মানে পরিস্থিতি কী দাঁড়ালো? সুস্থ-সবল শরীরে ঘর থেকে বের হয়েছিল রাজীব। পথে নামতেই দেখে একটি হাত নেই! বাসের চাপায় শরীর থেকে ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কী ভয়ঙ্কর চিত্র! ভাবা যায়?

দেশের বহুল প্রচারিত একটি দৈনিক পত্রিকায় ওই হাতটির ছবি ছাপা হয়েছে। ভাঙাচোরা দুই বাসের মাঝখানে আটকে আছে হাতটি। ছবি দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। ক্যাপশন পড়ার পর ভয় আর আতঙ্কে সারা শরীর কেঁপে উঠলো। ছবির নিচে ক্যাপশনে লেখা, ‘দুই বাসের ফাঁকে আটকে পড়েছে কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের ডান হাত।’ বাসের চাপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে হাতটি। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার মোড়ে এই ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বেলা তখন সোয়া একটা। একটি বিআরটিসি বাসে কলেজের দিকে যাচ্ছিল রাজীব। ভিড়ের কারণে রাজীব বিআরটিসি দোতলা বাসটির পেছনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ডান হাতটি বেরিয়েছিল বাসের সামান্য বাইরে। হঠাৎই পেছন থেকে একটি বাস প্রচণ্ড গতিতে বিআরটিসি বাসটিকে ওভারটেক করার জন্য বাঁদিকে ঘেঁষে যেতে থাকে। আর তখনই দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের ডান হাতটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রিয় পাঠক, ভয়ঙ্কর এই চিত্রটি কল্পনা করুণ তো একবার। একটু আগেই শরীরের ছিল হাত। সেই হাত মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো! তাও আবার ডান হাত। যে হাতের শক্তিতেই মূলত মানুষ স্বাভাবিক চলাফেরার সাহস পায়।

রাজীবের ডান হাতের কাটা অংশটি নাকি প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ঘটনাস্থলেই রাস্তার ওপর পড়েছিল। মোবাইল ক্যামেরায় অনেকেই হাতটির ছবি তুলেছেন। আহ! উহু! করেছেন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। কিন্তু অবশেষে হাতের কাটা অংশটি যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ডাক্তার জবাব দেন, এখন আর হাত জোড়া লাগানোর কোনও সুযোগ নেই। প্রিয় পাঠক, ভাগ্যহত তরুণ রাজীবের কথা ভাবুন একবার। তার বাবা-মা নেই। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাজীব সবার বড়। বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের দাসপাড়ায়। রাজীব তিতুমীর কলেজের ছাত্র। টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালাতো। তার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে আয় রোজগারের একটা পথ খুঁজে নেবে, পাশাপাশি অন্য ভাইদের পাশে দাঁড়াবে।

চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে প্রচার মাধ্যমের খবর, রাজীবের শরীরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। সে কারণে হাতটি আর জোড়া লাগানো যাবে না। শমরিতা হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রাজীবের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে রয়েছে। ৪৮ ঘণ্টা তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তার আগে ভালো-মন্দ কিছুই বলা যাবে না।

আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুল প্রার্থনা করি, রাজীব যেন বেঁচে যান। ধারণা করতেই পারি, রাজীব যদি বেঁচে থাকে তাহলে হয়তো তার পাশে অনেকেই দাঁড়াবেন। অনেকে হয়তো এই অসহায় তরুণের দায়িত্বও নিতে চাইবেন। কিন্তু যে পরিবহন সন্ত্রাসের কারণে রাজীবের জীবনের এই করুণ পরিণতি ঘটলো, তা কি বন্ধ হবে? শুধু ঢাকা শহর নয় সারাদেশে চলছে পরিবহন সন্ত্রাস। সড়ক পথে আইন না মানা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, যাত্রী নিতে দুই বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতাসহ নানা অনিয়ম চলছে পরিবহন সেক্টরে। সড়ক পথের আইনের প্রতি অধিকাংশ পরিবহন শ্রমিকের কোনোই শ্রদ্ধা নেই। কয়েকদিন আগে উত্তরা থেকে একটি বাসে মহাখালীর দিকে আসছিলাম। বাসের ভেতর কোনও সিট খালি নেই। ছাদের রড ধরে দাঁড়াতে হবে। কনডাক্টর বিরক্তমুখে বাসের পেছনের দিকে যেতে বললো। অগ্যতা আর কী করা, কোনোমতে পেছনের দিকে গিয়ে রড ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। হঠাৎ দেখি ব্যস্ত রাস্তায় আমাদের বাসটি অন্য একটি বাসকে অন্যায়ভাবে ওভারটেক করার চেষ্টা করছে। বাস দুটিকে মনে হচ্ছিল রেসের ঘোড়া। দুর্বার গতিতে ছুটছে। বাসের যাত্রীরা ভয়ে হৈ চৈ করে উঠলো। বেয়াদব কনডাক্টর হঠাৎ ধমক দিলো সবাইকে–‘এই যে ভাই আজাইরা চিৎকার চেঁচামেচি করতেছেন কেন? যে যেখানে আছেন বইস্যা থাকেন।’

কনডাক্টরের সঙ্গে তর্ক লেগে গেলো কয়েকজন যাত্রী। কিন্তু কনডাক্টরের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পারা গেলো না। একপর্যায়ে বাসের ড্রাইভার কনডাক্টরের সঙ্গে যুক্ত হলো। তাদের মন্তব্য, পথে গাড়ি চালাতে হলে নাকি এভাবেই ওভারটেক করতে হবে। ওভারটেক না করলে নাকি ব্যবসা হবে না।

মাঝে মাঝে ভাবি, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই যে এত সাংস্কৃতিক উন্নয়ন হচ্ছে সেই তুলনায় সড়ক পথের সংস্কৃতি কি বদলেছে? পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শহরের পরিবহন ব্যবস্থা অনেক উন্নত। একথা সত্য, একটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থা দেখেই বুঝে নেওয়া যায় দেশটি কতটা সভ্য! পৃথিবীর অনেক অনুন্নত দেশেও শহরতলির বাসযাত্রায় কনডাক্টরের দায়িত্ব পালন করে না। বাসে ওঠার আগে যাত্রীরা নির্ধারিত বাস কাউন্টার থেকে টিকে সংগ্রহ করে বাসে উঠে নির্ধারিত বুথে টিকেটটা ফেলে দেয়। ওটাই সিস্টেম। আর আমাদের দেশে কনডাক্টরকে দিয়েও বাস চালানো হয়। কিছুদিন আগে একটি মিনিবাসে ফার্মগেট থেকে গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছিলাম। ড্রাইভারের আসনে এক কিশোর বসে আছে। সেই বাসটি চালাচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম–ভাই তোমার কি ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে? পাশ থেকে বয়স্ক কনডাক্টর মেজাজ দেখিয়ে বললো, ভাই গাড়ি চালানোর সময় ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। চুপ করে বসে থাকেন। চুপ করেই বসে ছিলাম। বাংলামোটর মোড় পার হওয়ার পর রাস্তা একটু ফাঁকা পেয়ে হঠাৎ বাসটি যেন উড়াল দেওয়া শুরু করলো। পেছনে আরও দুটি মিনিবাস একই গতিতে রাস্তায় ছুটছে। কে আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। ভয়ে আমরা কয়েকজন যাত্রী প্রতিবাদ করে উঠলাম। কিন্তু কিশোর ড্রাইভার আমাদের কোনও কথাই শুনছে না। বরং সে দুর্বার গতিতে বাস চালাচ্ছে। জানালা দিয়ে দেখলাম রাস্তায় পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় বাসগুলোকে আটকাবে, তা না করে তারা বাসগুলোর দৌড় প্রতিযোগিতা উপভোগ করছিল।  

জানি না বাসচাপায় রাজীবের হাত হারানোর ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত নিষ্ঠুরতম ছবিটার দিকে সবাইকে আর একবার তাকাতে বলি। একটু আগে রাজীবের হাত ছিল। মুহূর্তের মধ্যে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো! এজন্য কে দায়ী? উত্তর একটাই– পরিবহন সন্ত্রাস। এর কি কোনও প্রতিকার নেই? পরিবহন মালিকদের বলি, পরিবহন সংস্কৃতি বদলান। এভাবে সাধারণ মানুষকে অসহায় করবেন না। দোহাই আপনাদের।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ