X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আসামে লোক গণনার নামে হচ্ছে কী?

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:১৪আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:১৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ভারতকে নিরঙ্কুশ হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর জন্য আরএসএস ‘ঘর ওয়াপসি’ বা ‘ঘরে ফেরা’ কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল দীর্ঘদিন আগে থেকে। ঘর ওয়াপসি অর্থ হলো যারা হিন্দু ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা পুনরায় ঘরে ফিরে এসো অর্থাৎ হিন্দু হয়ে যাও। তারা কোনও কোনও জায়গায় অনুষ্ঠান করে অনুরূপভাবে কিছু মুসলমান ও খ্রিস্টানকে হিন্দু হতে বাধ্যও করেছে।
ভারতে হিন্দুদের পরেই হলো মুসলমান এবং খ্রিস্টান। তারা প্রায় ৩০ কোটি। নাগাল্যান্ড তো খ্রিস্টান অধ্যুষিত রাজ্য। আরএসএস আর বিজেপির কী দুঃসাহস তারা ত্রিশ কোটি মানুষের ধর্মমত পরিবর্তনের পরিকল্পনা নিয়েছে। কতটুকু সফল হয় জানি না।
শঙ্কারাচার্য্য সপ্তম শতাব্দীতে গৌতমবুদ্ধের অনুসারীদের হিন্দু বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলন এবং ভারতের সর্বত্র ৩৩টি মঠ স্থাপন করে সে কর্ম উদ্যোগ সফল করার জন্য কাজও করেছিলেন। বৌদ্ধকে হিন্দু ধর্মের নবম অবতারও ঘোষণা করেছিলেন। এরপরও নাকি শঙ্কারাচার্য্য মাত্র আড়াই লক্ষ বৌদ্ধকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। বাকিরা আসামের পাহাড়ে পর্বতে, তিব্বতে, চীনে, বার্মায় এবং সিংহলে ও আফগানিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিল।

তখন আফগানরাও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল, পরে মুসলমান হয়েছে। ভারতীয় হিন্দুরা কোনও মহাফেজখানা সংরক্ষণ করেনি। তাই প্রাচীন ভারতের সঠিক তথ্য দেওয়া মুশকিল। দুই মহাকাব্য রামায়ণ এবং মহাভারত ভারতের প্রাচীনকালের তথ্যের উৎস। গত বছর ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করেছেন নরেন্দ্র মোদি। কেএন দিক্ষীত এ কমিটির চেয়ারম্যান। ৪০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এ কমিটিকে। নরেন্দ্র মোদি মনে করেন, রামায়ণ মহাভারত-এর কাহিনি কোনও ‘মিথ’ নয়, সবই ছিল বাস্তব। এই কাহিনি অবলম্বনে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লেখা হবে। তা-ই পড়ানো হবে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

প্রাচীন ভারতে উড়োজাহাজ, রকেট সবাই ছিল। যে রথে করে দেবতারা আকাশ মর্গে ঘুরতেন সেই রথই হচ্ছে আধুনিক যুগের প্লেন। আর যে অগ্নিবাণ ছুড়ে মারতেন তা-ই হচ্ছে আজকের রকেট। জওহর লাল নেহরুকেও এ কথা বুঝানো হয়েছিল। তখন নেহরু বলেছিলেন মধ্যখানে এগুলো বিলুপ্ত হলো কেন?

মোদির মতো এখন ইহুদিরাও এ কথা দাবি করতে পারেন। কারণ, বাদশাহ সোলায়মান আকাশযানে করে আকাশমর্গে বিচরণ করে সাবার রানী বিলকিছের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বাদশাহ সোলায়মান ইহুদি ধারার লোক। বৌদ্ধরাও দাবি করতে পারেন। কারণ, বৌদ্ধের মাতৃকূল এবং পিতৃকূল যখন নিরঞ্জনা নদীর জল বণ্টন নিয়ে যুদ্ধে উদ্ধত হয়েছিল তখন বৌদ্ধ নাকি সারানাথ থেকে আকাশযানে করে এসে নিরঞ্জনা নদীর তীরে অবতরণ করে মগধ আর কপিলাবস্তুর বিরোধ নিষ্পত্তি করেছিলেন।

আসলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে জেতার জন্য হিন্দুত্ববাদ উস্কিয়ে দেওয়ার আরএসএস এবং নরেন্দ্র মোদির এই এক মহাকৌশল। আরএসএস আর নরেন্দ্র মোদি যা নিয়ে খেলছেন তার শেষ পরিণতির ভয়াবহতার মানচিত্র সম্পর্কে সম্ভবত তাদের কোনও ধারণা নেই। ঘর ওয়াপসি কর্মসূচি প্রাচীন ইতিহাস রচনা সব কিছুর হিসাব হচ্ছে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। এ এক মহাভ্রান্তি। তাদের এ মহাপরিকল্পনা এক মহাদুর্যোগ ডেকে আনবে ভারতের জন্য, যা ভারতের অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে, এমনকি ভারতীয় ঐক্যও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

আসামে বিজেপি আর এক কৌশল অবলম্বন করেছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রধান সেনাপতি জেনারেল বিপিন রাওয়াত দিল্লিতে এক সেমিনারে বলেছেন, আসামে মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসাবে পাকিস্তান উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশে মদত দিচ্ছে। আর এ কাজে সহায়তা করছে চীন।

তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে মুসলমান পাঠানোর ফলে আসামে যেখানে ৫টি জেলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, এখন ৯টি জেলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থায় পৌঁছে গেছে।’ ভারতের সেনাপ্রধানের বক্তব্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনারও ষড়যন্ত্রেরই অংশ। আমরা অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশের কোনও বড় রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বিএনপি, জাতীয় পার্টি কেউই বিপিন রাওয়াতের এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি। বিপিন রাওয়াতের বক্তব্যে যেন সত্যতা আছে আমরা তা মেনে নিলাম।

পাকিস্তান বা চীনও জেনারেল রাওয়াতের অনুরূপ মিথ্যা বক্তব্যের কোনও প্রতিবাদ করেনি। অবশ্য তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। ভারত চীনকে একবার অভিযুক্ত করলে প্রয়োজনে সাতবার প্রণাম করবে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব গত ২৩ ও ২৪ মার্চ চীন সফর করে বলে এসেছেন তারা মালদ্বীপে তাদের অবস্থান থেকে সরে যাবে। অর্থাৎ ভারত মালদ্বীপে চীনের উপস্থিতি মেনে নিলো। অথচ মালদ্বীপ হচ্ছে ভারত মহাসাগরের অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জ, যা ভারতের নিকটবর্তী।

চীন পরিকল্পনা করেছে মালদ্বীপে নৌঁঘাটি স্থাপন করবে। আমেরিকা ভারতকে চীন ঠেকানোর যে দায়িত্ব দিয়েছিল এবং ভারত যে দায়িত্ব পালনে সম্মত ছিল, এখন ভারত সে দায়িত্ব থেকে সম্ভবত অব্যাহতি নিয়েছে। যাক, সে এক লম্বা কাহিনি, তা নিয়ে পরবর্তীতে আরেকটা লেখা লিখব।

গত ৩১ মার্চ আসাম সরকার দ্বিতীয় নাগরিক গণনার তালিকা প্রকাশ করেছে। আসাম সরকার এরই মাঝে জানিয়েছে এবার নাগরিকত্ব বঞ্চিত হতে যাচ্ছে ৪৮ লাখ মানুষ। যাদের বেশিরভাগই মুসলমান। আসামের অর্থমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, তালিকায় বাদপড়া মুসলমানদের বাংলাদেশে পাঠানো হবে। তবে হিন্দুদের আসামে থাকতে দেওয়া হবে।

এই ৪৮ লাখ মুসলমান নাকি কোনও প্রমাণপত্র দেখাতে পারেনি। অনাবাদি আসামকে আবাদ করেছে বাঙালি মুসলমানেরা। আবাদ করে পুরুষানুক্রমে তারা আসামে বসবাস করছে। তারা আসামের ভোটার। পূর্বে আসাম সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পূর্বে আসামে বসতি স্থাপন করেছিলো তারা সবাই আসামীয় হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা গিয়েছিল তারা ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে ফেরত এসেছে। হিমান্ত বিশ্ব শর্মা নাগরিক গণনা কমিটির চেয়ারম্যান। সুতরাং আমরা বলবো, তারাই মুসলমানকে তাড়াবার জন্য এ ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে।

১৮৮৭ সালে যখন ব্রিটিশরা আসামকে পৃথক প্রদেশ ঘোষণা করতে ইচ্ছা করলো তখন যে অংকের রাজস্ব আদায় হলে একটা প্রদেশ স্বতন্ত্র প্রদেশ হওয়ার মর্যাদা পায় সে পরিমাণ রাজস্ব আসামে আদায় হতো না। তখন ব্রিটিশ সরকার সিলেট, গোয়ালপাড়া ও কাচাঢ়- বাংলার এ তিন জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে ঘাটতি রাজস্ব উদ্বৃত্ত রাজস্বে পরিণত করেছিল। তখন এ তিন জেলার লক্ষ লক্ষ বাঙালি মুসলমান আসামের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল।

আসাম ছিল চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশ। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন বড়লাট তখন তিনি আসাম ও পূর্ববাংলাকে একত্রিত করে গভর্নর শাসিত পূর্ণাঙ্গ প্রদেশের মর্যাদা দিয়ে পৃথক একটা প্রদেশ গঠন করেছিলেন। তখনও লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে আসামে নিয়েছিল আবাদি এলাকা সৃষ্টির জন্য। তারা এলাকা আবাদও করেছে আর বসতিও গড়ে তুলেছিল।

অবশ্য বাংলাকে পৃথক করা কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ মেনে নেয়নি। তারা এ পৃথকীকরণ রহিত করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। ১৯১১ সালে দিল্লির দরবারে ব্রিটেনের রাজা বাংলার পৃথকীকরণ রহিত করেছিলেন। ৬ বছর একত্রিত থাকার পর পুনরায় আসাম ও পূর্ববাংলা পৃথক হয়ে যায়। বহুবিধ উপলক্ষে বাঙালিরা আসামে বসতি গড়ে তুলেছিল। একশত বছর পরে এসে যদি নাগরিকত্বের দলিল খোঁজা হয় তা কারো কি সাধ্য আছে সরকারকে দেখানোর?

গত নভেম্বর মাসে বাংলা একাডেমিতে লিটারারি  ফ্যাস্টিভাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আয়োজকেরা রোহিঙ্গাদের ওপর একটা আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন একাডেমিতে। আমি ছিলাম সে অনুষ্ঠানটির উদ্বোধনী বক্তা। বক্তা ছিলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য, সাংবাদিক হারুন উর রশীদও ছিলেন। আর অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন শেরিফ আল সায়ার। সেদিন তপোধীর বাবু তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, আসাম থেকেও বাংলাদেশে বহু উদ্বাস্তু পাঠাবার আয়োজন চলছে। এখন দেখি সত্যি সত্যি আসামের বিজেপি সরকার ৪৮ লাখ মুসলমানকে উদ্বাস্তু করে বাংলাদেশে পাঠাবার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে।

মন্ত্রী শর্মার বক্তব্য থেকে তা-ই বুঝা যায়। এই ৪৮ লাখ লোককে নাকি এক স্থানে কনসেন্টট্রেশন ক্যাম্প করে রাখা হবে। সেখানে থেকে পাঠানো হবে। কনসেন্টট্রেশন ক্যাম্পের কথা উঠলে হিটলারের ৬০ লাখ ইহুদি নিধনের কথা মনে পড়ে।

বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান এসেছে থাকছে। আবার যদি ৪৮ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়ে আসাম থেকে বাংলাদেশে আসে তবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এখন বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে আবার মুক্তিযুদ্ধের মতো রাজপথে নামতে হবে। আর বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য মিছিল নিয়ে ঢাকার প্রতিটি বিদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের দেশের সরকারের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করতে হবে। ভারতের এ নির্মম পরিকল্পনা প্রতিরোধে এ কর্মসূচির কোনও বিকল্প নেই।

বিশ্ব জনমত দিয়ে ভারতকে প্রতিহত করতে হবে। সরকারকেও চুপ করে থাকলে হবে না। আট এপ্রিল ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় আসছেন। আশা করি সরকার এ বিষয়টি এড়িয়ে যাবে না। বাংলাদেশের মিডিয়াও সোচ্চার হবে ভারতের এই অন্যায় আচরণে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ