X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

পূর্ণিমার নয়, দায় আমাদের

প্রভাষ আমিন
০৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:০৭আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:০৯

প্রভাষ আমিন ধর্ষণের মতো একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা। গত সপ্তাহে এক লেখায় আমিও পূর্ণিমার তীব্র সমালোচনা করেছি। পূর্ণিমার বক্তব্য প্রত্যাহার এবং ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছি। তবে বাংলাট্রিবিউনে পূর্ণিমা,মিশা সওদাগর এবং আলোচিত অনুষ্ঠানের প্রযোজক সোহেল রানা বিদ্যুতের সাক্ষাৎকার পড়ে পূর্ণিমার প্রতি আমার ক্ষোভটুকু চলে গেছে। বুঝতে পারছি, দায় আসলে পূর্ণিমার নয়, আমাদের,মানে গণমাধ্যম কর্মীদের।
প্রথমে আসি মিশা সওদাগরের সাক্ষাৎকারে। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিশা সওদাগর দাবি করেছেন, ধর্ষণ নিয়ে প্রশ্নগুলো পাণ্ডুলিপিতেই ছিল। তিনি বলেছেন, ‘অনুষ্ঠান তো এডিট হয়ে তারপর প্রচার হয়েছে। আমাদের অনেক কথাই কেটে ফেলা হয় রেকর্ডেড অনুষ্ঠানে। তাদের (অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষ) উচিত ছিল আরও সাবধান হওয়া।’ একদম ঠিক বলেছেন তিনি। সিনেমার ধর্ষণকারী যেমন ধর্ষক নন, তেমনি ধর্ষণ নিয়ে প্রশ্নকারীও খারাপ নন। সিনেমায় ভিলেনের চরিত্রে অভিনয়কারী মানুষটির প্রতি যদি আমাদের ব্যক্তিগত রাগ না থাকে, তাহলে পূর্ণিমার ওপর থাকবে কেন? তিনি তো পাণ্ডুলিপি ফলো করে প্রশ্ন করেছেন। আরটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘এবং পূর্ণিমা’য়ও তো পূর্ণিমা একজন অভিনেত্রীই। পরিচালক বা অনুষ্ঠান প্রযোজক যে পাণ্ডুলিপি দেন, সিনেমায় বা টিভি অনুষ্ঠানে অভিনেত্রীদের তো সেটাই ফলো করতে হয়।

এখন জানা যাচ্ছে, অনুষ্ঠানটি দেড় মাস আগে রেকর্ড করা হয়েছে। তার মানে আরো আগে এটির পরিকল্পনা হয়েছে, পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছে। এরপর শুটিং হয়েছে, এডিট হয়েছে, নিশ্চয়ই প্রচারের আগে কেউ না কেউ দেখেছেন। কিন্তু তাদের কারো কানেই অস্বস্তিটা লাগলো না, এটাই বিস্ময়কর। শিল্পীর যেমন সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে, দায় আছে গণমাধ্যমেরও। গণমাধ্যম তো শুধু বিনোদন দেবে না, মানুষের মানস গঠনে ভূমিকা রাখবে। এখানে আরটিভির দায়বদ্ধতায় ঘাটতি ছিল। তবে আরটিভিকে ধন্যবাদ। অনুষ্ঠানটির প্রযোজক সোহেল রানা বিদ্যুৎ বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল। ভুলটা আমাদেরই। অনুষ্ঠানটির প্রযোজক হিসেবে এর দায় সরাসরি আমি নিচ্ছি। পূর্ণিমা আগেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এবার আমি নিজেও সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’ দায় এড়ানো বা অস্বীকার করা আমাদের পুরনো প্রবণতা। সোহেল রানা বিদ্যুৎ সে পথে হাঁটেননি। পূর্ণিমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে বাঁচতে চাননি। এই সৎসাহসের জন্য অবশ্যই তিনি ধন্যবাদ পাবেন।

পূর্ণিমাও বাংলা ট্রিবিউনে সাক্ষাৎকার দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ভুল মানুষ করতেই পারে। সেই ভুল বুঝে, ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশে কোনও গ্লানি নেই। বরং ভুল স্বীকার মানুষকে আরো মহৎ করে। কিন্তু পূর্ণিমা,মিশা সওদাগর ও সোহেল রানা বিদ্যুতের সাক্ষাৎকার পড়ে আমার মনে হয়নি ভুলটি তারা বুঝতে পেরেছেন। প্রবল সমালোচনার মুখে তারা দুঃখ প্রকাশ করেছেন বটে, কিন্তু একটি জনপ্রিয় টিভিতে ধর্ষণের মতো একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা যাবে না কেন, সেটা এখনও তারা ধরতে পারেননি। আর বোঝেননি বলেই পাণ্ডুলিপি, শুটিং, সম্পাদনা কোনো পর্যায়েই অসঙ্গতিটা তাদের চোখে পড়েনি। সেই গল্পের মতো। বার্তা সম্পাদক ডেকে তরুণ সহ-সম্পাদককে বললেন, বানান বা শব্দার্থ নিয়ে সন্দেহ হলে ডিকশনারি দেখে নিও। সেই তরুণ উত্তর দিয়েছিলেন,আমার তো সন্দেহই হয় না।

সোহেল রানা বিদ্যুৎ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এই বিষয়টি এভাবে ভাইরাল হবে কিংবা সমালোচিত হবে এটা আমাদের মাথাতেই আসেনি অন-এয়ারের আগে। আমাদের ধারণা ছিল,এটা দুজন চলচ্চিত্রের মানুষের মধ্যে কথার প্রেক্ষিতে কথা চলে আসার মতো। চলচ্চিত্রে ধর্ষণ দৃশ্য থাকতে পারলে সেটা নিয়ে তারকা টকশোতে কথা বলতে ক্ষতি কী?’

মিশা সওদাগরও অসঙ্গতিটা ধরতে পারছেন না। তিনি বলছেন, ‘এটা কোনও বিষয়ই না। এটা নিয়ে বিতর্কই হতে পারে না। একটা মানুষ প্রশ্ন করলে তো কত প্রশ্নই করে। সে (পূর্ণিমা) একটা প্রশ্ন করেছে, বেচারি। সেটা তো পাণ্ডুলিপিতেই ছিল। আমরা চলচ্চিত্রে যে ধর্ষণের দৃশ্য করি, সেটাও তো পাণ্ডুলিপির দাবিতেই করি। ইচ্ছা করে তো আর করি না।’

ইদানীং বাংলাদেশে ধর্ষণ বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। লম্বা পরিসংখ্যানের দরকার নেই। ধর্ষণের ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য খালি একটা তথ্যই যথেষ্ট- গত তিন মাসে দেশে ১৭৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি,আমাদের সবার যখন উচিত ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, তখন একটি দায়িত্বশীল গণমাধ্যমে একজন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকার ধর্ষণ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা সমাজে ভুল বার্তা দেবে। পূর্ণিমা যখন মিশা সওদাগরকে প্রশ্ন করেন, সিনেমায় কয়টা ধর্ষণ করেছেন, কাকে ধর্ষণ করে ভালো লেগেছে, কেন লেগেছে, আরো ধর্ষণ করতে চান কিনা? উত্তর শুনে যখন পূর্ণিমা হাসিতে লুটোপুটি খান; তখন পুরো বিষয়টিই অশালীন লাগে।

এই অশালীন লাগার বিষয়টিই ধরতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউই। পূর্ণিমা দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তবে ধরনটা খুব অনিচ্ছুক মনে হয়েছে। তিনি বলছেন, তার বক্তব্যে কারো মনে আঘাত লাগলে তিনি দুঃখিত। তার মানে আঘাত না লাগলে অসুবিধা নেই। অসুবিধা যে নেই সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। পূর্ণিমা বলছেন, ‘আমি কমপক্ষে ৫০টি ছবিতে এই সিন করেছি। এসব তো চিত্রনাট্যের দাবিতে একটি দৃশ্য মাত্র। সিনেমায় তো খুনোখুনিও হয়, ভালোবাসাও। আমরা তো সেই সিনেমারই মানুষ। অথচ মজার ছলে এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে সেটা অপরাধ! এটা তো আমি ভাবতেই পারিনি।’ পূর্ণিমা উল্টো প্রশ্ন করছেন, সিনেমার ধর্ষণ দৃশ্য নিয়ে টিভিতে কথা বলা যদি অপরাধ হয় তাহলে তাকে কেন ৫০টি সিনেমায় এই সিন করতে হয়েছে? তখন কেন এসব সিন নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করেনি? পূর্ণিমা আরো বলছেন, ‘আমরা ফিল্মে এসব সিন করি বলেই কি বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে? তা তো নয়। সিনেমায় তো রেপ সিন করার পর সেটার বিচার হয়, ভিলেন মার খায়,শাস্তি হয়। সিনেমার রেপ সিন তো মানুষকে কখনও প্রভাবিত করেনি। আরও সচেতন করে। আর সেটা নিয়ে একটি ফিল্মের টকশোতে কথা বলতে গেলে অপরাধ!’

এখানেই আমার অস্বস্তি,আপত্তি। চাপের মুখে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বটে। কিন্তু ভুলটা কেউ ধরতে পারছেন না। তবে আশার কথা অনুষ্ঠানের প্রযোজক সোহেল রানা বিদ্যুৎ বলেছেন, ‘এই ভুলটা আমাদের অনেক বড় শিক্ষা দিয়েছে। আর এমন ভুল করতে চাই না।’ তারা যদি মন থেকে ভুলটা অনুধাবন করেন, গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলটা মাথায় রাখেন, ভবিষ্যতে আরো সতর্ক থাকেন; তাহলেই মঙ্গল।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ