X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন: কেন জরুরি?

রেজা সেলিম
১১ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:৫২আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:৫৩

রেজা সেলিম বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদে ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে’ নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা আছে। কিন্তু আমাদের এখনও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্যে নির্দিষ্ট আইন নেই। আইনের চেয়েও জরুরি এ বিষয়ে জনসচেতনতা, সেটিও নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বুঝতে পারছি না কখন কোথায় কেমন করে আমার ব্যক্তিগত তথ্য, যা অন্যের জানা দরকার নেই, চলে যাচ্ছে ভুল পথে আর এর ফলে আমরা বুঝতে পারছি না যে আমরা যেকোনও সময়ে একটি বিপদে পড়তে পারি বা আমার ব্যক্তিগত তথ্যের অপ-প্রয়োগ করে আমাকে কেউ বিপদেও ফেলতে পারে।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই বিষয়ে আইন আছে ও আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত কড়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ইউরোপে, জাপানে ও কোরিয়ায় এরকম আইনের যথাযথ প্রয়োগের ফলে অনেক বড় রকমের ঘটনা ঘটেছে, যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা ও সচেতনতার জন্ম দিয়েছে। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি নিয়ে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, যা ফেসবুকের অর্থনীতি ছাড়াও, নানা দেশের মানুষের মনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ও তথ্য-প্রযুক্তির জগতের জন্যেও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাহীনতার অশনি সঙ্কেতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফেসবুক নিজেও স্বীকার করে নিয়েছে এর ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তার দায় তাদেরই, বিশেষ করে সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা ছড়াতে ফেসবুক ঘিরে যে অপপ্রচার চলেছে তা বন্ধ না করতে পারায় ফেসবুক ক্ষমাও চেয়েছে। ইতোমধ্যে জানা গেছে, ফেসবুকে সংরক্ষিত প্রায় ২০ লক্ষ বাংলাদেশির তথ্যও বেহাত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সবচেয়ে জরুরি হলো আমার-আপনার ব্যক্তিগত তথ্য অযাচিত প্রকাশের ফলে তা কেমন করে আমাদের ক্ষতি করতে পারে আমরা বুঝতে পারছি কিনা। যেমন ধরুন, আপনি ডাক্তারের কাছে গেলেন ও নানা রকম পরীক্ষার পরে ডাক্তার জটিল কোনও অসুখের কথা জানালেন। আপনি কি আপনার এই অসুখ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবেন? কেন দেবেন? আপনি হয়তো চাইছেন সবাই জানুক ও সহমর্মী হোক যে আপনি একটা জটিল অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু সম্ভাব্য ক্ষতি আঁচ করতে পারেননি বলে দেখা গেলো আপনার অফিস আপনাকে আর পছন্দ করছে না, সহকর্মীদের কেউ কেউ আপনাকে এড়িয়ে চলছেন। আপনার মেয়ের বিয়ের সম্ভাব্য শ্বশুরবাড়ি হয়তো জানিয়ে দেবে তারা এই বিয়েতে রাজি নয়, কারণ মেয়ের বাবার যে অসুখ তাতে মেয়েও কোনদিন আক্রান্ত হতে পারে। এসবই কাল্পনিক কিন্তু এমন অনেক ঘটনা আমাদের দেশে ঘটেছে বা ঘটছে। সবচেয়ে বড় কথা, বীমা কোম্পানি এসব তথ্য নিয়ে আপনার প্রতি বিরূপ আচরণ করতে পারে। এখানে নীতির দিক হলো আপনি আপনার অসুখ-বিসুখের কথা ডাক্তার ছাড়া কাউকে জানাবেন না। ডাক্তারও আপনার রোগের কথা আর কাউকে জানাবেন না। কারণ, এটা আপনার অধিকারের বিষয়। আপনার শরীর ঘিরে যত কিছুই ঘটুক তা আপনার সম্পদ, ফেসবুকে জানিয়ে তাতে আপনি কোনও জনসমর্থন আদায় করতে পারবেন না যাতে আপনার শরীরের অসুখের কোনও উপশম হবে।  

যেমন ধরুন, আমরা ন্যাশনাল আইডি কার্ডের জন্যে আমাদের অনেক ব্যক্তিগত তথ্য দিয়েছি। এখন ভোটার তালিকার অপপ্রয়োগ করতে কেউ যদি এনআইডি ডেটাবেজ থেকে তথ্য চুরি করে আপনার মতের বিরুদ্ধে কাজ করে আপনি কি তা মেনে নেবেন? নিশ্চয়ই নয়। আমাদের সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক আছে কিন্তু এই তথ্য-ভাণ্ডার ব্যবহার আইনের দ্বারা সুরক্ষিত হতে হবে, না হলে আমাদের তথ্য নিয়ে যেন কেউ এমন কিছু না করে যা আমার মনের বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে,তা না হলে আমরা কিন্তু তখন আইনের আশ্রয় নিতে পারছি না। এই সুযোগ নিচ্ছে আমাদের দেশের মোবাইল ফোনের কোম্পানিগুলো। আমাদের সব তথ্য এরা নিয়ে নেয় কিন্তু কী কাজে এই তথ্য ব্যবহার করবে তাতে আমার-আপনার সম্মতি নেয় না। যে কারণে আপনি প্রচুর অযাচিত এসএমএস পেয়ে থাকেন, রাত-বিরাতে পেয়ে বিরক্তও হন কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেন না। আপনার মোবাইল ফোন নাম্বার বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে বা খাবার দোকানির কাছে আপনার অনুমতি ছাড়া যাবে কেন? কিছুদিন আগে যে আমরা আঙুলের ছাপ দিলাম সেটা সন্ত্রাস দমনে বেশ কার্যকর হয়েছে কিন্তু আমার-আপানার ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় কতখানি নিরাপদ তা একটি আইন করে আমাদের জানিয়ে দেওয়া দরকার।

যারা নিয়মিত গুগল ব্যবহার করেন তারা জানেন বা না জানলেও জানা দরকার আপনার সকল ব্যক্তিগত তথ্য, কখন কোথায় যাচ্ছেন, কার সাথে কথা বলছেন, আপনার কাছে কার কার নাম্বার আছে সব কিন্তু গুগল আপনার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছে। কেউ যদি তার মোবাইলের ম্যাপে গিয়ে টাইমলাইন দেখেন দেখবেন আপনার দিনের সকল গতিবিধি,এমনকি কত পা হেঁটেছেন সব তথ্য ওই ম্যাপে উল্লেখ করা আছে। প্রশ্ন হলো গুগল এটা ঠিক করছে কিনা। যেহেতু দৃশ্যমান তথ্যগুলো সম্পর্কে আমরা সব জানতে পারছি, আমাদের জানা দরকার অদৃশ্য কোন তথ্য-ভাণ্ডার সে আমার কাছ থেকে সব জেনে নিয়ে তৈরি করে নিচ্ছে কিনা যা কোনও একসময় আমার জন্যে ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন আমি ব্যাংকে কত টাকা আজ জমা করলাম বা উত্তোলন করলাম সে তথ্য মোবাইলে ফোনের কোনও সফটওয়্যার নিচ্ছে কিনা যা অন্যের কাছে প্রকাশ হলে আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। বা আমি এখন কোথায় আছি (অনেকে ফেসবুকে না বুঝেই নিজের লোকেশন জানিয়ে স্ট্যাটাস দেন যার ক্ষতি নিয়ে নানা দেশে প্রতিকারমূলক আইন হয়েছে) তা জেনে আমার ক্ষতি করতে যায় এমন কেউ সে তথ্য ব্যবহার করবে কিনা।  

তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে কোনও তথ্যই আর গোপন রাখার সুযোগ নেই, কিন্তু তার অপপ্রয়োগ যেন আপনার-আমার ক্ষতির কারণ না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আজকাল কোনও কোনও টেলিভিশনে গ্রামের মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের অসুখ বা শারীরিক সমস্যা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে দেখা যায়। এটা বহুজনের জন্যে উপকারী হলেও যিনি তার সমস্যার কথা বলছেন তাকে ক্যামেরার সামনে বিনা অনুমতিতে আনাও ঠিক নয়। এতে তার ব্যক্তিগত সম্মানের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আমি নিশ্চিত শহরের কোনও শিক্ষিত মেয়েদের এভাবে ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসা কখনই সম্ভব হবে না। কিন্তু একজন গ্রামীণ নারীরও তার ব্যক্তিগত তথ্য সমাধানের যেমন অধিকার আছে তেমনই তার মুখ আড়াল করার অধিকারও আছে।  

দেশে বিদেশে নানা রকম তথ্য-প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। একদিকে এই প্রযুক্তির সীমাহীন সম্ভাবনা, অপরদিকে এর ক্ষতিকর দিকগুলো আমাদের বিব্রত করছে। আমাদের দেশের ইন্টারনেট নিরাপত্তা নিয়ে উন্নত দেশগুলো সন্তুষ্ট নয়। ফলে এদিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। বাড়াতে হবে আমাদের জনসচেতনতা, বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের সম্পূরক একটি ‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন’ও আমাদের তৈরি করে নেওয়া দরকার। বিদেশি আইটি কোম্পানিগুলো আমাদের দেশে এসে যেন আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিব্রতকর কোনও পরিস্থিতি তৈরি না করে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এমনকি এই আইনের ফলে প্রতিশ্রুত বা নিবন্ধিত থাকলে আমাদের দেশে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হবে, যাতে তারা আমাদের দেশের তথ্য পাচার করতে না পারে, এমনকি তাদের ব্যবসায় কর আরোপ করাও সহজ হবে, যেটি না থাকায় আমরা ফেসবুক বা গুগলের কাছ থেকে এখন কর নিতে পারছি না।

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প

email: [email protected]     





/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশের উন্নয়ন-সহযোগী হিসেবে দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে ফ্রান্স
বাংলাদেশের উন্নয়ন-সহযোগী হিসেবে দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে ফ্রান্স
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা সরাতে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা সরাতে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ
ওরসে ঝগড়া, সেই শত্রুতায় ছুরিকাঘাতে যুবককে হত্যা
ওরসে ঝগড়া, সেই শত্রুতায় ছুরিকাঘাতে যুবককে হত্যা
ন্যাপ বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত সহায়তার আহ্বান
ন্যাপ বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত সহায়তার আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ