X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

পুতিন-শি জিনপিংয়ের পুনর্নির্বাচন

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:০০আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:০৪

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ভ্লাদিমির পুতিন পুনরায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন আর শি জিনপিংপুনরায়নির্বাচিত হয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তাতে বিশ্বব্যবস্থা নতুন কোনও ঝুঁকির মুখে পড়লো না। দুইবারের অধিক কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না অনুরূপ বিধি কংগ্রেস রহিত করে দিয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এতে শি’র দীর্ঘদিন প্রেসিডেন্ট থাকার ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেল।
মাও চীনে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ছিলেন। তিনিই চিয়াং কাইশেককে বিতাড়িত করে চীনে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার চিন্তাচেতনার আলোকে চীন বহুদিন চলেছে। চৌ এন লাইরা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে কখনও মাওয়ের চিন্তার সঙ্গে বিরোধ করেননি। কিন্তু দেং জিয়াও পিং মাওয়ের সঙ্গে বহু বিষয়ে দ্বিমত করতেন এবং শেষ পর্যন্ত বিতাড়িতও হয়েছিলেন। তবে প্ররোচনার পরও মাও দেংকে হত্যা করেননি, জীবনে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। মাওয়ের জীবনকাল পর্যন্ত দেং নাকি তাস খেলে জীবন অতিবাহিত করেছেন।
‘বিড়াল কালো কী সাদা তা মুখ্য বিষয় নয়, ইঁদুর ধরে কিনা তাই মুখ্য’- এ উক্তি দেংয়ের। আর এ কথা বলে তিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন। তাকে সংশোধনবাদী বলা হতো। মাও অনমনীয় (rigid) ছিলেন, কিন্তু দেং প্রয়োজনে নমনীয় (flexible) হতে দ্বিধা করার পক্ষে ছিলেন না। তিনি রিজিডিটিকে স্থবিরতার মূল বলে মনে করতেন, সুতরাং সব সময় দেং তা পরিত্যাগের পক্ষে ছিলেন।

মাওয়ের মৃত্যুর পর তিনি যখন ক্ষমতা পেলেন তখন চীনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো প্রতিষ্ঠা করলেন। আর এ অঞ্চলগুলোতে তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য পুঁজিপতিদের আহ্বান জানালেন। আমেরিকার পুঁজিপতিরা শ্রমিকের বেতন বাড়াবার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া সব কারখানা নিয়ে গেলেন চীনে, সস্তা শ্রমের জন্য। শুধু আমেরিকার পুঁজিপতিরা নয়, ইউরোপও এলো। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এলো, এমনকি তাইওয়ানের পুঁজিপতিরাও ভিড় জমালো।

তাইওয়ানের পুঁজিপতিদের অভয় দিয়েছিলেন দেং। আজকে চীনের চোখ ঝলসানো উন্নয়ন দেংয়ের চিন্তার ফসল। হার্ডওয়্যারে চীন উন্নত বিশ্বের শীর্ষস্থানে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের উন্নয়ন অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। গত কংগ্রেস পর্যন্ত মাও ও দেং-ই ছিলেন চীন বিপ্লবের পরে মুখ্য নেতৃত্ব। এবারের কংগ্রেস শি জিনপিংকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ তারই চিন্তাচেতনার ফসল, যা বিশ্বের তিনটি মহাদেশের ৬১টি দেশকে নৌপথে এবং স্থলপথে যুক্ত করবে।

শি গত কংগ্রেসে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড-এর জন্য এক ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দের কথা বলেছেন। এ প্রকল্প তিন মহাদেশের ৬১টি দেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করবে, আবার ওই সব দেশেও চীনসহ প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে সহজভাবে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারবে। শি বলেছেন, কোনও দেশের বন্দর ব্যবস্থার সঙ্গে এ দীর্ঘপথের সংযোগ স্থাপন করতে গিয়ে যদি অতিরিক্ত কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হয় তবে চীন সেখানেও অর্থ জোগান দিতে সম্মত রয়েছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট বিশ্বব্যাংকের আদলে ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবার অনেক দেশের সঙ্গে চীনা নিজস্ব মুদ্রার মাধ্যমে লেনদেনের চুক্তি করছেন। এটা আন্তর্জাতিক বাজারে লেনদেনের একক মুদ্রা ডলারকে প্রতিযোগিতায় ফেলারই কৌশল। শি’র এ কৌশলে ডলারের অবস্থান দুর্বল হবে।

সোভিয়েতের পতনের আগে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই প্রতিযোগী পরাশক্তি ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সোভিয়েতের নেতৃবৃন্দ কখনও চীনের মতো আমেরিকার সঙ্গে আর্থিক প্রতিযাগিতার জন্য ব্রিকস ব্যাংক গঠন বা নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করার কোনও উদ্যোগ কখনও নেয়নি। চীনের শি কিন্তু আমেরিকার মূল শক্তিকে দুর্বল করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার মাঝে ছিল অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। তাতে কে বড় কে ছোট তা নির্ণয় করা ছিল মুশকিল। চীন কিন্তু অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় এখনও বহু পিছিয়ে রয়েছে। এখন বিশাল সেনাবাহিনী থাকলে হয় না। আধুনিক অস্ত্রেরও প্রয়োজন হয়। বিশ্বে এখনও আমেরিকা অন্যতম বৃহত্তর নৌশক্তি। প্রশান্ত মহাসাগরে তার ৬০% শতাংশ নৌশক্তি নিয়োজিত রেখে চীনকে বিরাট হুমকির মুখে রেখেছে।

আমেরিকার নৌবাহিনীর রণতরীর সংখ্যা ৩৮০টি। এরমধ্যে ১০টি হচ্ছে বিমানবাহিনী রণতরী। বিশ্বে আর কারও কাছে এতো রণতরী সজ্জিত নৌবাহিনী নেই। সারা বিশ্বে রয়েছে আমেরিকার স্বয়ংসম্পূর্ণ অসংখ্য নৌঘাঁটি। শি জিনপিংও এখন বিশ্বের সর্বত্র নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। আমেরিকা চীনকে হুমকিতে রাখার ঠিকাদারি দিয়েছিল ভারতকে। গত চার বছর ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার সে উচ্ছ্বাসে ভর করে চলার চেষ্টা করেছেন। সে কারণে ভারত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনেসিয়েটিভে যোগদান করেনি, বরং চীনের পাল্টা পূর্বমুখী নতুন একটা বাণিজ্য পথ খোলার ইনিসিয়েটভ নিয়েছিল।

গত ২২ ও ২৩ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বেইজিং সফরে গিয়েছিলেন। বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত আলাপ-আলোচনায় বুঝা যাচ্ছে, ভারত চীনের সঙ্গে যে প্রতিযোগিতার মুড নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল এখন তা থেকে বিরত হচ্ছে। ভারত চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে সমঝোতার অবস্থানে থাকলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনেকটা নিরাপদ অবস্থানে থাকে।

রাশিয়ায় পুতিন পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০০ সাল থেকে কোনও না কোনও প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। রাশিয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে। শত ত্রুটি বিচ্যুতির পরও তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথ বেয়ে চলার চেষ্টা করছে। পশ্চিমা ধনবাদী গোষ্ঠী চীনকে মনে করেছিল সস্তা শ্রমের বাজার আর রাশিয়াকে মনে করেছিলো কুঁজু হয়ে যাওয়া এক শক্তি। রাশিয়া আর কখনও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু উভয় চিন্তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর বরিস ইয়েলৎসিন মুক্তবাজার সংস্কারের কথা বলে হার্ভাডে শিক্ষিত পন্ডিতদের পরামর্শ শুনে রাশিয়ার পুরো অর্থনীতিটাকে গুটি কয়েক লোকের কব্জায় দিয়ে দিয়েছিল। এদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাইবেরিয়ায় তেল ক্ষেত্রগুলোর মালিক হয়েছিল। পুতিন তাকে জবাবদিহির মধ্যে আনার ২০০৩ সালে উদ্যোগ নিলে সে পশ্চিমা করপোরেট হাউসগুলোর কাছে তেল ক্ষেত্রগুলো বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদের ওপর পুতিন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পুতিনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। রাষ্ট্রের প্রধান নৌঘাঁটি ক্রিমিয়া ইউক্রেনের ভাগে চলে গেলে রাশিয়া খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল। রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে এ নৌঘাঁটি ৪০ বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছিল। যেহেতু ক্রিমিয়ায় অধিকাংশ লোক ছিল রাশিয়ান বংশোদ্ভূত, পুতিন তাদেরকে দিয়ে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করাতে পেরেছিলেন। গণভোটে ক্রিমিয়া স্বাধীন হওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়ার সঙ্গে যোগদান করবে। পুতিন কৌশলী মানুষ। এখন রাশিয়া মেরুদণ্ড সোজা করে পুনরায় বিশ্বনেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা অর্জন করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তার প্রমাণ দিয়েছে।

চীন ও রাশিয়া সহমত পোষণ করে বহু বিষয়ে ঐক্যমতের সঙ্গে চলছে। পশ্চিমা ধনবাদী গোষ্ঠীর চরম বেদনা এখানেই। আমেরিকার একক প্রাধান্য বিশ্বব্যবস্থায় একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন সে অবস্থা আর নেই। বিশ্বব্যবস্থার জন্য এটিই উত্তম।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ