X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোটা বাতিলে সমাধান নয়, চাই কর্মসংস্থান

প্রভাষ আমিন
১৮ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:৩২আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:৩৪

প্রভাষ আমিন সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে সফল হয়েছে তারুণ্যের আন্দোলন। শুধু সফল নয়, কামান চেয়ে সাবমেরিন পেয়েছে তারা। প্রত্যাশার বেশি সাফল্যে তারা উল্লসিত। আবারও প্রমাণিত হলো, তারুণ্যের শক্তিকে রুখে দেওয়া যায় না। তারুণ্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কোটা বাতিলেই কি মিটে গেলো তারুণ্যের সব সমস্যা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেই আমরা পৌঁছতে পারবো সমাধানের আসল সূত্রে।
তারুণ্যের শক্তি অপ্রতিরোধ্য। যুগে-যুগে, দেশে-দেশে তারুণ্য অনেক মহৎ অর্জন এনে দিয়েছে। অন্যদিকে তাকানোর দরকার নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় তারুণ্যের জয়গান। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র গণঅভ্যুত্থান, ৯২’র মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের আন্দোলন, ২০১৩ সালের গণজাগরণ—জাতির সব মহৎ আন্দোলনেই সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণ সমাজ। সব আন্দোলনেই একটি বৃহৎ লক্ষ্য ছিল, মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। তারুণ্যের এসব অর্জন আমাদের গর্বিত করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে। এই প্রথম তারুণ্যের একটি আন্দোলন ছিল নিছক ব্যক্তিস্বার্থে, নিজের স্বার্থে আরেকজনকে টেনে ধরার আন্দোলন। এই আন্দোলনের অর্জন কেবল নিজের চাকরি, নিজের ভবিষ্যৎ। নিজের স্বার্থে যখন আঘাত লেগেছে, তারুণ্য তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করেছে, পিছিয়ে পড়া-অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা ভাবেনি, নারী-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-প্রতিবন্ধীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেনি। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার যে ধারণা, তা পাশ কাটিয়ে নিছক নিজেদের এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এ আন্দোলন তাই আমার বিবেচনায় কনুই মারার আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে নৈতিকভাবে আমি একমত না হলেও তাদের প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভূতি ছিল এবং আছে। পড়াশোনা শেষ করে যোগ্যতা অনুযায়ী একটা ভালো চাকরি না পেলে সবাইই হতাশ হবে, ক্ষুব্ধ হবে। আর কিছু লোক ভুলভাল বুঝিয়ে তরুণদের মাঠে নামিয়েছে। বুঝিয়েছে, তোমার ভাগ্য আটকে আছে কোটায়। তবে আমি যৌক্তিক মনে করি আর না করি; তাদের আন্দোলন করার পূর্ণ অধিকার আছে। আমি এখনও বিশ্বাস করি, এ আন্দোলনকে সাফল্য পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পুরো দায় বা কৃতিত্ব পুলিশের। পুলিশ আন্দোলনকারীদের গায়ের জোরে তুলে দিতে গিয়েই আন্দোলনকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে।

একটা সভ্য, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে বৈষম্য দূর করতেই কোটা ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু সেই ব্যবস্থাকেই বৈষম্য সৃষ্টির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে আন্দোলনে নামে তরুণ সমাজ। এ আন্দোলনের অর্জন কী? কোটা পদ্ধতি বাতিল হয়েছে। কিন্তু তাতে কি চাকরির সংখ্যা একটাও বাড়বে? কোটা থাকার সময় যত জন চাকরি পেতেন, না থাকলেও তো ততজনই পাবেন। আগে মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরি, নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধীরা অগ্রাধিকার পেতেন। এখন পাবেন না, এই তো। কোটা বাতিল হলেও বেকারের সংখ্যায় তো কোনও হেরফের হচ্ছে না। তাই এ আন্দোলনের অর্জন সাময়িক। পড়াশোনা শেষ করেও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি না পেয়ে হতাশ, বঞ্চিত তারুণ্যের সংখ্যা কিন্তু অপরিবর্তিতই থাকবে।

সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে এখন বেকার যুবকের সংখ্যা ২৬ লাখ। এরমধ্যে শিক্ষিত বেকার প্রায় অর্ধেক। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাস বেকারের সংখ্যা আড়াই লাখ। প্রতিবছর এই সংখ্যা বাড়ে, যুক্ত হয় নতুন নতুন বেকার। সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ও অন্য সুযোগ-সুবিধা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। তাতে সরকারি চাকরির প্রতিও তারুণ্যের আগ্রহ বেড়েছে। তাই এখন বিসিএস’এ আবেদন দুই লাখ ছাড়িয়ে যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত চাকরি জোটে হাজার দুয়েকের মতো। এই দুই হাজার পদের জন্যই এত মারামারি, কাটাকাটি, আন্দোলন। কিন্তু ২৬ লাখ বেকারের পাশে ২ হাজার পদ বিন্দুর মতো। তপ্ত কড়াইয়ে ছ্যাঁৎ করেই মিলিয়ে যায়। পিএসসির বাইরে আরও কিছু সরকারি নিয়োগ হয়। বেসরকারি খাতেও কিছু কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু ২৬ লাখ বেকারের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির সক্ষমতা নেই আমাদের। তাই কোটা নিয়ে মাতামাতি না করে, আমাদের ভাবতে হবে বিকল্প কর্মসংস্থান নিয়ে।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বাজেটের আকার বাড়ছে। দেখে-শুনে আমরা বেশ বগল বাজাচ্ছি, আত্মপ্রসাদের ঢেঁকুর তুলছি। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা একে বলছেন ‘জবলেস গ্রোথ’। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু তার সুফল কতটা পাচ্ছে সাধারণ মানুষ? ধনীরা আরও ধনী, গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে। ব্যাংক-শেয়ারবাজার লুটেপুটে কিছু লোকের প্রবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে। কারও কারও সম্পদের এই বেপরোয়া বৃদ্ধিতে মাথাপিছু গড় আয় বাড়ছে বটে। কিন্তু সেই গড়, গরিবের কাছে নিছক পরিসংখ্যান। তাদের পকেট গড়ের মাঠই থেকে যাচ্ছে। বিনিয়োগ না বাড়লে, শিল্প না বাড়লে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে উন্নয়নের সুফল সবার ঘরে পৌঁছাবে না। এখনকার একমুখী উন্নয়ন বৈষম্য আরও বাড়াবে।

জনসংখ্যা বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যা থেকে তো আমরা রাতারাতি পরিত্রাণ পাবো না। এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, জনসংখ্যাকে সম্পদে বদলে দেওয়া। ২৬ লাখ যুবক কাজ চাইছে, এটা কিন্তু বড় একটা শক্তিও। এখন এই যুবশক্তিকে কাজের বাজার সৃষ্টি করে দিতে হবে। ২৬ লাখ বেকারকেই যে চাকরি দেওয়া সম্ভব, তা নয়। তবে খুঁজতে হবে বিকল্প কাজের সুযোগ। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ২০২১ সালের মধ্যে আইটি খাতে এক লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে বলে জানিয়েছেন। এভাবেই খুঁজে নিতে হবে পথ। পড়াশোনা করে ঘরে বসে থাকলে তো আপনার কোনও চাকরিই হবে না। যে যুবক দক্ষ, উদ্যোগী, উদ্যমী, পরিশ্রমী সে কিন্তু একটা না একটা উপায় খুঁজে নেবেই। অনেকেই এখন আর চাকরির জন্য বসে থাকে না। নিজেরাই ছোটখাটো উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যায়। কেউ আউটসোর্সিং, কেউ ই-কমার্স, কেউ খামার–কিছু না কিছু পথ বের করে নেয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই উদ্যোক্তাদের পাশে থাকা। নীতি সহায়তা পেলে এই উদ্যোগগুলোতেই সৃষ্টি হতে পারে কর্মসংস্থান।

বাংলাদেশে যখন ২৬ লাখ বেকার কাজের জন্য ঘুরছে। তখন সরকারি হিসেবেই বাংলাদেশে ৮৫ হাজার বিদেশি কাজ করেন। তারা প্রতিবছর সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা তাদের নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে বেসরকারি হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশির সংখ্যা আরও অনেক বেশি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই)-এর প্রেসিডেন্ট ফারুক সোবহান বলেছেন, বাংলাদেশের শিল্প খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যেসব ভারতীয় নাগরিক কাজ করেন, তারা বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যান। কী ভয়ঙ্কর চিত্র! আনুষ্ঠানিক হিসাবটাই যদি ধরি, যে ৮৫ হাজার বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করেন, তারা সবাই কি অপরিহার্য? এই পদগুলোতে কি বাংলাদেশিরা কাজ করতে পারতেন না? যারা বিদেশিদের কাজ দিচ্ছেন, তারা বলছেন, দেশের মানুষের দক্ষতার ঘাটতির কারণেই তারা বিদেশিদের নিয়োগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে সাফল্য ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তাহলে নিজের দেশে নয় কেন? দাবি জানাচ্ছি, যে ৮৫ হাজার বিদেশি কাজ করছে, তাদের প্রত্যেকের কাজের খুঁজে দেখা। সেখানে কাজ করার মতো বাংলাদেশি আছে কিনা, তা খুঁজে বের করা। না থাকলে, ঘাটতিটা খুঁজে বের করা এবং তা পূরণের ব্যবস্থা করা। আর যারা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই পর্যটক হিসেবে এসে দিনের পর দিন কাজ করছেন এবং আমাদের মূল্যবান বৈদেশিক মূদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের খুঁজে বের করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া। তাতে কিন্তু উদ্যোক্তাদেরও লাভ। কারণ একজন বাংলাদেশির চেয়ে একজন বিদেশিকে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেতন দিতে হয়।

তবে আমার ধারণা নিছক বাংলাদেশিদের দক্ষতার ঘাটতির কারণেই বিপুলসংখ্যক বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করেন, এটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। বিদেশি বিশেষ করে সাদা চামড়ার মানুষ দেখলেই আমরা এক ধরনের আস্থা পাই। বাংলাদেশ এখন যে গতিতে এগুচ্ছে, তাতে সময় এসেছে এই মানসিকতা বদলেরও।

আমাদের এখন দক্ষ জনশক্তি তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সনদসর্বস্ব শিক্ষার বদলে কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। খুঁজতে হবে বিকল্প কর্মসংস্থান। নইলে ২৬ লাখ বেকার যুবক হতাশ হবে, ক্ষুব্ধ হবে, ফুঁসবে ও কোনও না কোনও দাবি নিয়ে রাজপথে সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ