X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং রাজনীতি

বিভুরঞ্জন সরকার
১৯ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:১০আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:২২

বিভুরঞ্জন সরকার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে গত ২৮ মার্চ থেকে এক ধরনের ধূম্রজাল তৈরি করা হচ্ছে। ওইদিন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা দেওয়ার তারিখ ছিল। তিনি যেহেতু এখন কারাবন্দি সেহেতু তাকে আদালতে হাজির করার দায়িত্ব ছিল কারা কর্তৃপক্ষের। কিন্তু প্রথমে বলা হয়েছিল ‘অনিবার্য কারণে’ তাকে আদালতে উপস্থিত করা যায়নি। পরে জানানো হয় তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। ব্যস, শুরু হয়ে যায় খালেদা জিয়ার অসুস্থতা বা শারীরিক অবস্থা নিয়ে ‘রাজনীতি’। বাংলাদেশ যে রাজনীতিরই দেশ। বিএনপি দাবি করে কারাগারে থেকেই তাদের নেত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কাজেই তাকে মুক্তি দিয়ে বাইরে তার পছন্দের ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।
অন্যদিকে সরকার পক্ষ বলতে থাকে, কারাবিধি অনুযায়ী সব ধরনের চিকিৎসা সেবাই তাকে দেওয়া হচ্ছে। তিনি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে চান বলেও জানানো হয়। তবে কারাবিধি এটা অনুমোদন করে না বলে সরকার একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে। বোর্ডের সদস্যরা জেলে গিয়ে বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে জানান, তিনি আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। জেলে গিয়ে তার সমস্যা একটু বেড়েছে। তবে তার অসুস্থতা গুরুতর কিছু নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আকস্মিকভাবে বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) যদি সত্যিই অসুস্থ হয়ে থাকেন, তার অসুস্থতার ধরন অনুযায়ী সুচিকিৎসার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশেই যদি তার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দেশেই তার চিকিৎসা করা হবে। আর যদি মেডিক্যাল বোর্ড মনে করে তাকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার, প্রয়োজনে সেই ব্যবস্থাও করা হবে।

এরপর গুজব রটে ‘চিকিৎসা’র জন্য খালেদা জিয়া বিদেশ চলে যাচ্ছেন। ঠিক এই সময় বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী বিদেশ থেকে দুই কন্যাকে নিয়ে দেশে এসে কারাগারে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করেন। এতে এই গুজবও ছড়িয়ে পড়ে যে বেগম জিয়ার পরিবার বা নিকট আত্মীয়রা চাইছেন যেকোনও উপায়ে তাকে জেলের বাইরে আনা এবং আপাতত বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করা।

কিন্তু বাস্তবে বেগম জিয়ার বাইরে যাওয়ার মতো কিছু দৃশ্যমান হয় না। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে বেগম জিয়ার রক্ত পরীক্ষা ও একটি এক্সরে করানো হয়। এই পরীক্ষার রিপোর্টও তেমন খারাপ নয়। বেগম জিয়া আর্থাইটিসের রোগী। আগে থেকেই তার হাঁটুসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা। জেলে গিয়ে ওইসব ব্যথা একটু বেড়েছে। এক্সরে রিপোর্ট অনুযায়ী কোমর ও ঘাড়ে কিছু  ‘সমস্যা’ আছে। কিন্তু বিএনপি দাবি করতে থাকে যে বেগম জিয়ার রোগ যথেষ্ট গুরুতর। সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তার অসুস্থতাকে খাটো করে দেখছে। বেগম জিয়াকে ভয়াবহ অসুস্থ প্রমাণ করে তাকে কারাগার থেকে বের করার একটা লক্ষ্য বিএনপির আছে। কিন্তু সরকার যে বেগম জিয়াকে খুব সহজে জেলের বাইরে দেখতে চায় না,সেটাও বুঝতে কারো কষ্ট হচ্ছে না। সরকার সেজন্যই আগাগোড়া বিএনপির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

বেগম জিয়ার অসুস্থতা এখন সরকার এবং বিএনপি–উভয় পক্ষের জন্যই রাজনীতির হিসাবনিকাশের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলে বেগম জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ছেন– এই প্রচার তার প্রতি সহানুভূতি বাড়াবে বলে মনে করেই সম্ভবত  বিএনপি নেতারা বেগম জিয়ার অসুস্থতার কথা বেশি করে প্রচার করছেন। গত ১৬ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কারাগারে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতির কথা বলে তাকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে সুচিকিৎসার দাবি জানিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি নিজেই নাকি তার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন।

রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন,খালেদা জিয়াকে কারাগারে নির্জন পরিত্যক্ত ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে রাখয় হয়েছে। তাকে দেওয়া বিছানা-বালিশ অর্থোপেডিকের একজন রোগীর জন্য অনুপযোগী। রিজভীর আরো অভিযোগ, কারা কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টি উপেক্ষা করছে,  অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার তাদের নেত্রীকে ‘এক অবনতিশীল স্বাস্থ্যঝুঁকির’ মধ্যে ফেলে রাখার জন্যই কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে।

রিজভীর অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এসব বলে সরকারকে ‘অমানবিক’ ‘নিষ্ঠুর’ প্রমাণ করে খালেদা জিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে চায় বিএনপি। মানুষ সহানুভূতিশীল হলে খালেদা-মুক্তি আন্দোলন জোরদার হতে পারে বলে হয়তো বিএনপি মনে করছে। তবে বিএনপি এই কৌশলে খুব লাভবান হতে পারবে না দুই কারণে। প্রথমত, খালেদা জিয়া সত্যি সত্যি ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি’র মধ্যে পড়লে সরকারের কোনও লাভ নেই। কাজেই তাকে ঝুঁকিমুক্ত রেখে সরকার কার্যত নিজেকেই ‘ঝুঁকিমুক্ত’ রাখতে চাইবে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য দেশে বড় ধরনের গণআন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কম। বেগম জিয়াকে আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই জেলের বাইরে আসতে হবে। উচ্চ আদালত তাকে জামিন না দিলে আন্দোলন করে বিএনপি যে তাকে মুক্ত করতে পারবে না– সেটা ইতোমধ্যে বোঝা গেছে। তাকে জেলে নেওয়ার পর দুই মাসের বেশি সময় চলে গেছে কিন্তু বিএনপি এই সময়ে নিজেদের সংহত শক্তির পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

বেগম জিয়াকে জেলে নিলে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা নিয়ে সরকারের মধ্যে হয়তো কিছু সংশয় ছিল। এখন আর তা আছে বলে মনে হয় না। সরকার বিএনপির শক্তি-সামর্থ্য বুঝে নিয়েছে। তবে বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য ইস্যুতে বিএনপিকে কোনও বাড়তি সুবিধা নিতে দেবে না সরকার।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, খালেদা জিয়াকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ও মর্যাদা সহকারে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তার চিকিৎসা ও শারীরিক অবস্থা নিয়ে কোনও ধরনের মিথ্যাচার না করার জন্য বিএনপি নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, একজন রাজনীতিবিদ এবং বয়স্ক নারী। তার চিকিৎসার ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সচেতন আছি। অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মর্যাদার সঙ্গে তার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকদের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন এবং তিনি ভালো আছেন। বিএনপি ‘অহেতুক' বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করে বলেও আওয়ামী লীগের এই সিনিয়র নেতা মন্তব্য করেন।

অবশ্য খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে সরকার রাজনীতি করবে না – সে কথাও বলা যায় না। আমাদের দেশের রাজনীতিতে একবার গুজব হিসেবে কিছু সামনে এলে পরে তাই বাস্তবে ঘটতে দেখা যায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি একবার যখন শোনা গেছে তখন এটি ঘটলেও ঘটতে পারে। তার শারীরিক অবস্থার আকস্মিক ‘অবনতি’ হতে পারে। তখন ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য অনুযায়ী সরকার তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারেন। তবে এমনি এমনি তো আর বেগম জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি হবে না! সেজন্যও সবার চোখের আড়ালে কিছু ঘটনা ঘটতে হবে। শোনা যাচ্ছে,বেগম জিয়া যদি নিজে বিদেশে চিকিৎসা নিতে রাজি থাকেন, সহসা দেশে ফেরার গরজ না দেখান, আগামী নির্বাচন নিয়ে যদি একটি ‘সমঝোতা’য় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়, তাহলে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়েও নাটকীয়তা হতে পারে। বাংলাদেশ যেহেতু অতি রাজনীতির দেশ তাই এখানে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে রাজনীতি হলে তাতে বিস্মিত হওয়ার তো কিছু থাকতে পারে না। আর রাজনীতিবিদের রাজনীতি ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার নজির আমাদের রাজনীতিতে আছে। মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক অসুখের কথা একসময় বহুল আলোচিত বিষয় ছিল।

রাজনীতি যেহেতু একটি কৌশলের খেলায় পরিণত হয়েছে তাই কোন পক্ষ কখন কোন কৌশলের আশ্রয় নেবে তা আগে থেকে বলা মুশকিল। টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতায় এখন পর্যন্ত বিএনপি খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ