X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

পরাশক্তির মাঝে বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা ও সিরিয়া সমস্যা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৯ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:৫৩আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:৫৪

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী সিরিয়া গৌতায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে এ অজুহাত তুলে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তিন দেশ সর্বমোট ১০৩টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। রাশিয়া বলেছে ৭১টা ক্ষেপণাস্ত্র সিরিয়ার বিমানবাহিনী আকাশে ধ্বংস করে দিয়েছে। সিরিয়ায় রুশ ঘাঁটিতে যেন বোমা না পড়ে আর কোনও রুশ সেনা যেন মারা না যায় অনুরূপ নিকাশ করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।
রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রধান পূর্বে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে কোনও রুশ স্থাপনা বা সৈন্যের ক্ষয়ক্ষতি হলে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্রের উৎসমূল চুরমার করে দেবে। এ যাত্রায় পৃথিবী এক ভয়াবহ পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পেলো।
ভ্লাদিমির পুতিন বহুদিন থেকে বলে আসছিলেন, পারমাণবিক অস্ত্রের খেলা আরম্ভ হলে বিজয় দেখে যেতে কেউ বেঁচে থাকবে না। উভয় পরাশক্তি এ সত্যটাকে মেনে চলার চেষ্টা করে। এজন্যই বিশ্ববাসী আশ্বস্ত থাকে যে সহজে উভয় পরাশক্তির মাঝে কোনও যুদ্ধ হবে না। গত শনিবার ১৪ এপ্রিলের হামলা দীর্ঘায়িতও হবে না, ব্যাপক কোনও যুদ্ধের সূচনাও করবে না–এ বিষয়টা নিয়ে অনেক বিশ্লেষক নিশ্চিত ছিলেন। পুতিন কঠিন মানুষ, তার প্রতিশোধ গ্রহণের কৌশল কী হবে তা নিয়েই বিশ্লেষকেরা এখন শঙ্কায় রয়েছেন।

বৃহৎ শক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক লীলাখেলায় মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়ায় নরকের অবস্থা বিরাজ করছে। ২০১১ সালের কুচক্র হিলারির প্ররোচনায় আরব বসন্ত আরম্ভ হলে ১৫ মার্চ সিরিয়ায় বিরোধী পক্ষ বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ করেছিল। তিউনেশিয়ার বেন আলী, মিশরের হোসনি মোবারক, লিবিয়ার গাদ্দাফির পতন হলেও সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতন হয়নি। তিনি এখনও টিকে আছেন।

টিকে থাকলেও গত ৭ বছরের গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় ৪ লাখ ৮২ হাজার লোক নিহত হয়েছে। ৭৬ লাখ লোক সিরিয়ার অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত হয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে, ৫৬ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়ে আশপাশের রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছে। ১০ লাখ ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে আর আয়নাল কুর্দির মৃত্যুদৃশ্য দেখে জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মেরকেল এ লোকগুলোকে জার্মানিতে আশ্রয় দিয়েছেন। মানবতার চূড়ান্ত পতন ঘটেছে সিরিয়ায়।

সিরিয়ায় এখন মোটামুটি চার পক্ষের মাঝে যুদ্ধে চলছে। তারা হচ্ছে (১) বাশার আল আসাদের সরকারের সঙ্গে রয়েছে রাশিয়া, ইরান এবং হিজবুল্লাহ, (২) সিরিয়ার ন্যাশনাল কোয়ালিশন। এ কোয়ালিশনের সদস্য সংগঠন হচ্ছে (ক) ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (খ) আহারার আল-শামস্ (গ) ইসলামিক ফ্রট (ঘ) জইশ আল ইসলাম (ঙ) তাহারির আল শামস্ (চ) আল-নুসরা ফ্রন্ট। এ কোয়ালিশনের সঙ্গে আমেরিকা রয়েছে, (৩) ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন অব নর্দান সিরিয়া, এটা হচ্ছে কুর্দিদের রাষ্ট্র কাঠামোর নাম। সিরিয়ার কুর্দিরা বেশিরভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। তাদের সামরিক শাখার নাম ওয়াইপিজি পিপলস্ ডিফেন্স ইউনিট। এদের অস্ত্র সরবরাহ করে আমেরিকা, (৪) ইসলামিক স্টেট ও আল কায়দা, এদের অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে।

এবার দেখা যাক, কার নিয়ন্ত্রণে কত জায়গা রয়েছে। বাশার আল আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৫৫ শতাংশ জায়গা, ন্যাশনাল কোয়ালিশনের অধিকারে রয়েছে ১২ শতাংশ জায়গা, দ্বিতীয় বৃহত্তম জায়গা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন অব নর্দান সিরিয়া অর্থাৎ কুর্দিদের সামরিক ইউনিট ওয়াইপিজির দখলে ২৭% শতাংশ। ইসলামিক স্টেটের দখলে আছে ৬% শতাংশ জায়গা। ইসলামিক স্টেটের নিয়ন্ত্রণে ইরাক আর সিরিয়ার বিরাট এলাকা ছিল। সব শক্তির সম্মিলিত আক্রমণে ইসলামিক স্টেটের সব উল্লেখযোগ্য নেতা নিহত হয়েছে। তাদের সৈন্যরা স্ব-স্ব দেশে পালিয়ে গেছে। অনেকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছে। সব মিলিয়ে ইসলামিক স্টেট এখন বিলুপ্তির পথে।

ন্যাশনাল কোয়ালিশনের অধিকারেও অনেক জায়গা ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাশিয়া বাশারের পক্ষ অবলম্বন করে বিমান ও সেনাবাহিনী পাঠালে তার অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং অনেক জায়গা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। বাশারের পক্ষে ইরানও সৈন্য পাঠিয়েছে আর লেবাননের হিজবুল্লাহও বাশারের পক্ষে রয়েছে।

এখন পূর্ব গৌতার দখল নিয়ে তীব্র যুদ্ধ চলছে সরকারি বাহিনী এবং ন্যাশনাল কোয়ালিশনের যোদ্ধাদের মাঝে। পূর্ব গৌতা ছোট ছোট কয়েকটা শহর ও খামার নিয়ে গঠিত ১০৪ বর্গকিলোমিটারের একটা এলাকা, লোকসংখ্যা ৪ লাখ। পূর্ব গৌতা রাজধানী দামেস্ক থেকে মাত্র ১০ মাইল দূরে। দীর্ঘদিন ধরে এলাকাটা অবরুদ্ধ। মানুষগুলো খুবই কষ্টে আছে। সরকারি বাহিনী প্রতিরোধ ভাঙতে না পেরে এখন বিমান আক্রমণ চালাচ্ছে। আমেরিকা গত শনিবার ১৪ এপ্রিল ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে পূর্ব গৌতায় ক্যামিকাল অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ তুলে। পূর্ব গৌতার পতন হলে ন্যাশনাল কোয়ালিশনের গুরুত্ব গৌণ হয়ে পড়বে।

সিরিয়ায় শিয়া সুন্নি বিরোধ রয়েছে। সরকারপ্রধান বাশার আল আসাদ শিয়াপন্থী। কোয়ালিশনের অংশীদার সকল সংগঠন, কুর্দি, ইসলামিক স্টেট,  আল-কায়দা সবাই সুন্নি আর তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সিরিয়ার শান্তি স্থাপন করতে হলে শিয়া সুন্নির সম্মতির ভিত্তিতে সমাধানে পৌঁছতে হবে। রাশিয়ার পুতিন, ইরানের হাসান রুহানি এবং তুরস্কের এরদোয়ান অনুরূপ একটা শান্তি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেউই নিজ নিজ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না বলে সিরিয়ার এ সমস্যাটা সমাধান হচ্ছে না।

ইরান এসেছে সিরিয়ায় শক্তিশালী একটি ঘাঁটি স্থাপনের জন্য, যেন তাকে সার্বক্ষণিক হুমকি প্রদানকারী ইসরায়েলকে শায়েস্তা করা যায় সিরিয়ার মাটি থেকে। সিরিয়া ও ইসরায়েল পাশাপাশি রাষ্ট্র। তুরস্কের মাথাব্যথা কুর্দিদের নিয়ে। কুর্দিরা স্বাধীন কুর্দিস্থান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছে গত ৮০/৯০ বছরব্যাপী। কুর্দিস্থানের জায়গা তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়ানদের মাঝে তিন টুকরা হয়ে রয়েছে। ইরানেও কিছু কুর্দি আছে।

সিরয়ার উত্তর-পশ্চিম এলাকায় কুর্দিদের অবস্থান, তার সংলগ্ন জায়গাটাতে ইরাকের কুর্দিরা বসবাস করে। ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন অব নর্দান সিরিয়া নাম দিয়ে সিরিয়ার কুর্দিরা সিরিয়ার মোট ভূমির ২৭% শতাংশ দখল করে আছে। পার্শ্ববর্তী ইরাকি কুর্দিরা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। দুই মাস আগে ইরাকি কুর্দিরা স্বাধীনতার ব্যাপারে গণভোট করেছে। কুর্দিরা গাজী সালাহউদ্দীনের বংশধর। যোদ্ধা জাতি। কুর্দিরা ইসলামিক স্টেট উচ্ছেদের ব্যাপারে খুবই সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে এবং তাদের অস্ত্রের জোগান দেয় আমেরিকা।

সিরিয়ান কুর্দিরা যদি তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে ইরাকি কুর্দি ও তুরস্কের কুর্দিদের আর রাখা যাবে না। কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাধাদানের জন্য তুরস্ক রাশিয়া ইরানের জোটভুক্ত হয়েছে, না হয় তুরস্ক তো ন্যাটোর সদস্য। রাশিয়া সিরিয়ায় এসেছে সিরিয়ান উপকূলে রাশিয়ার নৌঘাঁটি রয়েছে, তার নৌঘাঁটির সুরক্ষা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে ঝিমিয়ে পড়া সম্পর্ক সতেজ করার জন্য। ক্রিমিয়া দখলে নেওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার উপস্থিতি এবং শক্তিশালী ভূমিকা রাশিয়াকে পুনরায় বিশ্বনেতৃত্বের আসনে দৃশ্যমান করে তুলেছে।

সিরিয়া সমস্যার সমাধান খুবই জটিল। গত ৪ এপ্রিল তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মাঝে বৈঠক হয়েছে। সিরিয়ার সমস্যা নিয়ে ১৫ দিন আগে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় যে বৈঠক করেছিল তারই ধারাবাহিকতায় এ বৈঠক হয়। তারা সিরিয়া পরিস্থিতির মানবিক ও সামরিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে যুদ্ধের রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তারা পুনরায় যুদ্ধমুক্ত অঞ্চল গঠনের ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে আস্তানায় ছয় দফা বৈঠক করে যুদ্ধমুক্ত অঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু গত ৬ মাস আস্তানা প্রক্রিয়া মোটামুটি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ব্যর্থতার পরও তারা আস্তানা প্রক্রিয়ার মেয়াদ আরো ৬ মাস বাড়ানোর কী যুক্তিকতা খুঁজে পেলেন বলা মুশকিল। সিরিয়ায় পুতিনসহ তিন নেতা সর্বসম্মত একটা শাসনতন্ত্র রচনার উদ্যোগ না নিলে সমস্যাটার আশু সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে বাশার আল আসাদ সম্মত নয় বলে মনে হয়। অনুরূপ পরিস্থিতিতে তিন নেতাকেই শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে হবে।

সিরিয়ায় আমেরিকা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হচ্ছে একটা নিষ্ফলা আয়োজন। এ হামলায় তাদের চিন্তাভাবনার অসংলগ্নতাই প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অবস্থান খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার অবস্থান শক্তিশালী হবে। আমেরিকাকে সমর্থন করতে গিয়ে কুর্দিরা বিপদে পড়বে। এরই মাঝে কুর্দি অধ্যুষিত আফরিন এলাকায় তুর্কিরা ঢুকে পড়েছে। কুর্দিদের উচিত রাশিয়ার সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা করে কেবলা ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া। না হয় কুর্দিরা বাশার আর এরদোয়ান উভয়ের কু-দৃষ্টিতে পড়ে চারখার হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘অ্যাকটিভ অর্গানাইজেশন অ্যাওয়ার্ড’ পেলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
‘অ্যাকটিভ অর্গানাইজেশন অ্যাওয়ার্ড’ পেলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
সনদ বাণিজ্য: কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে
সনদ বাণিজ্য: কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে
পদ্মায় গোসল করতে নেমে ৩ মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যু
পদ্মায় গোসল করতে নেমে ৩ মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যু
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ